সন্জীদা খাতুন আছেন আমাদের সঙ্গে
Published: 26th, March 2025 GMT
সন্জীদা খাতুন নেই। সন্জীদা আপার কথা ভাবতে বসে সেই ষাটের দশকের অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছে।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় যে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটেছিল, সেটাই পরে ষাটের দশকজুড়ে বহু বিস্তৃত হয়ে দেশে অবিশ্বাস্য এক গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এর পেছনে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল বিরাট। সে সময়ের প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোও যৌথভাবে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এর সবকিছুই শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের এক ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে সব প্রস্তুতিতে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিল।
এসব আন্দোলনের পাশাপাশি বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও সংস্কৃতির জন্য সংগ্রামও অব্যাহত ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সে সময় একাধিক কমিটি করে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।
এর পরপরই সংগঠক ও শিল্পীরা সবাই মিলে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন আনন্দ-উত্সব করতে। সেখানেই বিকেলের আসরে মোখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া) প্রস্তাব করলেন, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই একমত হলে নতুন সংগঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। সুফিয়া কামাল সভাপতি ও ফরিদা হাসান সাধারণ সম্পাদক। কমিটিতে আরও ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সায়েদুল হাসান, শামসুন্নাহার রহমান, ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক প্রমুখ। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্জীদা খাতুনের নামটি প্রস্তাব করা হলেও তিনি কমিটিতে থাকেননি। তিনি তখন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। নবগঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক হয়েছিল—ছায়ানট।
সন্জীদা খাতুন আজীবন ছিলেন যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই পড়াশোনা, আবৃত্তি ও অভিনয়ের পাশাপাশি গানের চর্চা করেছেন। পাশাপাশি কিছু সাংগঠনিক কাজেও যুক্ত হয়েছেন।
শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মুকুল ফৌজে কাজ করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। তাঁর প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতি। পরে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত শিল্পী হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনসহ আরও অনেকের কাছে শিখেছেন রবীন্দ্রসংগীত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, অনার্সের পর শান্তিনিকেতনে যাবেন, বিশ্বভারতীতে এমএ পড়বেন। হয়েছিল তা-ই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সন্জীদা খাতুন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে বাসায় ফিরে ছাত্রহত্যার খবর পেয়েছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সবকিছু বন্ধ, সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নানা খোঁজখবর নিয়ে বিকেলে মাকে নিয়ে রওনা দিলেন অভয় দাশ লেনের এক বাসার উদ্দেশে নারীদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে। সেই ভয়াল পরিবেশে দূরপথ হেঁটে গেলেন সে বাসার চত্বরে। সেখানে গিয়ে দেখেন বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ উপস্থিত। কিন্তু সেদিন সে পরিস্থিতিতে কেউ সভার সভাপতি হতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সন্জীদা আপার মা সাজেদা খাতুনকে সভাপতির আসনে বসিয়ে দেওয়া হলো। মা গুটিসুটি হয়ে বসে থাকলেন। অন্যরা বক্তৃতা করলেন।
সেদিন সন্জীদা খাতুন প্রথম বক্তৃতা করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’
সংস্কৃতিই তাঁর সংগ্রামক্ষেত্রসন্জীদা খাতুনের সঙ্গে পরিচয় বা যোগাযোগের প্রথম স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে আমরা সে সময় ছায়ানটের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই যেতাম। সেসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সন্জীদা আপার সঙ্গে পরিচয় ও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
নানা কাজের সূত্রে সে সময়ের কিছু বামপন্থী নেতা–কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সন্জীদা খাতুনের। স্বল্প সময়ের জন্য কারও কারও গোপন আস্তানা ছিল তাঁর বাসা। সেই পঞ্চাশের দশকের কোনো এক সময় আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জি তাঁদের বাসায় থেকেছেন। সে সময়ের আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খোকা রায়ের স্ত্রী যুঁইফুল রায়—কখনো আয়েশা বা কখনো রাবেয়া পরিচয় ছিল—তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। একদিন তিনি এসে পল্টন ময়দানে শুধু নারীদের নিয়ে সভা করার জন্য সন্জীদা আপাকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন। ইতিমধ্যে বিএ অনার্স পাস করে সন্জীদা আপা শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন স্থির করে ফেলেছেন। এ সময় যুঁইফুল রায় এসে সন্জীদা আপাকে বললেন, ‘ওখানে গিয়ে কী করবে? পার্টির সদস্যপদ নাও। এখানেই কাজ করো।’
সন্জীদা আপা এ কথা শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘সেটা আমি পারব না।’ আরও বললেন, তিনি গান ছাড়তে পারবেন না। নিজের বিচার-বিবেচনা বাদ দিয়ে পার্টির নির্দেশ মেনে চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। পরে সন্জীদা আপা তাঁর আত্মজীবনী সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দেতে লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’ তিনি সেই নিজস্ব কাজের ধারা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
ছায়ানট শুধু নয়, তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় বা কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সন্জীদা আপা। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের বাংলাদেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনে ছিলেন তিনি।
যাত্রা শুরুর দিনসেদিন সকালের কথা কোনো দিন ভুলিনি। দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল, বাংলা সনের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। ছায়ানট রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছিল নববর্ষের অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেশ উত্সাহ তৈরি হয়েছিল। আমরা ৩১/১ হোসেনি দালান রোডের কার্যালয়ে সারা রাত জেগে ও আশপাশ থেকে কিছু ফুল, কিছু গাছের পাতা-ডালসহ কিছু বেলুন নিয়ে এক–দেড় শ ছাত্র মিছিল করে ছায়ানটের প্রথম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলাম। সামনে ছিল ব্যানার—‘এসো হে বৈশাখ/ এসো এসো’। দর্শক-শ্রোতারা হাততালি দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত করেছিলেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ছায়ানট বিদ্যায়তনে (ফুলার রোডের উদয়ন স্কুলে) নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছে নিয়মিত। প্রথমবারের সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছায়ানট বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর (১৯৬৭ সাল থেকে) শুধু একাত্তর সাল বাদ দিয়ে রমনার বটমূলে নববর্ষের বড় অনুষ্ঠান সফলভাবে করে চলেছে ছায়ানট। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ২০০১ সালে নববর্ষের প্রভাতের এই অনুষ্ঠানে বড় রকমের বোমা হামলা হলেও ছায়ানট বা সন্জীদা খাতুন এই অনুষ্ঠান থেকে সরে আসেননি; বরং আরও ভালোবেসে আমৃত্যু এই অনুষ্ঠান করে গেছেন। এই বিশাল সফলতার সামনে প্রথমে আছেন সন্জীদা খাতুন, যিনি অক্লান্ত এই মহৎ উদ্যোগে সর্বদা সক্রিয় থেকেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেদিন সন্জীদা খাতুন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ না করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে এ কথাও সত্য, ষাটের দশকজুড়ে ছায়ানট বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজে সে সময় বামপন্থী ছাত্র, বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক কর্মীদের তিনি তাঁর পাশে পেয়েছেন। তিনিও তাঁদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর বই, গান এবং সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধারাকে প্রভাবিত করেছে, শক্তিশালী করেছে। সে জন্য বাংলাদেশ সব সময় কৃতজ্ঞ থাকবে সন্জীদা খাতুনের কাছে।
সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীকষাটের দশকজুড়েই আমরা বাম ধারার ছাত্ররাজনীতি ও সংস্কৃতি সংসদের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। সন্জীদা খাতুন আর ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে যে আমাদের আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যোগাযোগ আছে, তা আমাদের জানা ছিল। সে জন্য ছায়ানটের নানা কার্যক্রম এবং এই সংগঠনের প্রতি আকর্ষণ ও সমর্থনও সহজাত ছিল। আসলে সেই দিনগুলোতে ছায়ানট বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
মনে পড়ে, সন্জীদা আপার আজিমপুরের ফ্ল্যাটে কত কাজে গিয়েছি। আমাদের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গোপন বৈঠকও হয়েছে সে বাসায়। সেই দিনগুলোতে সন্জীদা খাতুনকে আমরা মিনু আপা বলতাম।
ছায়ানট একটি অব্যাহত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চর্চারও একটি কেন্দ্র। ছায়ানট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে, দেশের মানুষকে সঞ্জীবিত করে এসেছে। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবিক বাংলাদেশ গঠনের কাজে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছে।
৯১ বছর ধরে সন্জীদা খাতুন বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণের কাজ করে গেছেন—এককভাবে, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। কথায়, গানে, লেখায়, সংগঠনে, আয়োজনে ও আন্দোলনে তিনি আমাদের সামনে ছিলেন সারাক্ষণ।
তিনি শারীরিকভাবে নেই; কিন্তু তিনি থেকে গেছেন আমাদের সঙ্গে, থাকবেন সব সময়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই অন ষ ঠ ন নববর ষ র আম দ র স স গঠন র র রহম ন র প রথম হয় ছ ল প রস ত র জন ত কর ছ ল ক জ কর সময় র
এছাড়াও পড়ুন:
সকালের সবচেয়ে বরকতময় সময় ব্যবহারের ৭ কৌশল
সকাল মানুষের জীবনের একটি মূল্যবান সময়, যা দিনের বাকি অংশের জন্য সুর নির্ধারণ করে। সকাল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার, শরীর ও মনকে প্রস্তুত করার এবং দিনের লক্ষ্য অর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ।
সামাজিক মাধ্যম, কাজের চাপ এবং পারিবারিক দায়িত্ব আমাদের অনেক সময় কেড়ে নেয়, তাই সকালকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা জীবনকে আরও উৎপাদনশীল করতে পারি।
১. আল্লাহর সঙ্গে দিনের শুরুফজরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া এবং দোয়া করা জীবনকে আমূল বদলে দিতে পারে। এই সময়টি শান্ত ও পবিত্র, যখন আল্লাহর সঙ্গে কোনো বাধা থাকে না।
কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি রাতে, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের রব নিকটতম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?”’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫)।
তাহাজ্জুদের সময় আপনার হৃদয়ের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করুন। এতে মানসিক শান্তি বাড়বে এবং দিনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। যদি আপনি নতুন হন, সপ্তাহে এক দিন থেকে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত করুন।
ফজরের আগে অবশিষ্ট সময়ে কোরআন তিলাওয়াত করুন, কারণ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ভোরে কোরআন পড়া (ফেরেশতাদের) দ্বারা প্রত্যক্ষ করা হয়।’ (সুরা ইসরা. আয়াত: ৭৮)।
আরও পড়ুনইশরাকের নামাজ: সকালের আলোয় আল্লাহর নৈকট্য ০৪ জুলাই ২০২৫২. ফজরের পর ঘুম থেকে দূরে থাকুনফজরের নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়া অনেকের অভ্যাস, কিন্তু এটি সকালের বরকতময় সময় নষ্ট করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১)।
এই সময়ে বড় বড় কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়, কারণ এতে আল্লাহর বিশেষ বরকত রয়েছে।
আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন। মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১ফজরের পর ঘুমের প্রলোভন এড়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। এই সময়ে পড়াশোনা, কোরআন মুখস্থ করা বা কোনো ব্যক্তিগত প্রকল্পে কাজ করা যায়। এটি দিনের বাকি সময়ে অবসরের জন্য সময় বাঁচায় এবং আগামী দিনে আরও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করে।
বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।
৩. করণীয় তালিকা তৈরি করুনএকটি করণীয় তালিকা তৈরি করা দিনের পরিকল্পনাকে সুসংগঠিত করে। আমরা প্রায়ই মনে মনে কাজের পরিকল্পনা করি, কিন্তু মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা সীমিত। একটি ডায়েরি বা ফোনের নোট অ্যাপে কাজের তালিকা লিখে রাখলে সময় ও শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। সম্পন্ন হওয়া কাজগুলো তালিকা থেকে কেটে দেওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে।
এই তালিকায় দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত করুন। যেমন কোরআনের একটি নির্দিষ্ট অংশ মুখস্থ করা বা একটি নতুন দক্ষতা শেখার পরিকল্পনা। এটি আপনাকে দিনের শুরুতে ফোকাসড রাখবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।৪. সকালে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুনসকালের মূল্যবান সময় সামাজিক মাধ্যমে বা ফোনে অযথা স্ক্রল করে নষ্ট করা উচিত নয়। অনেকে সকালে ফোন হাতে নিয়ে ‘শুধু একটু দেখে নিই’ ভেবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে ফেলেন। এটি মানসিক চাপ বাড়ায় এবং সকালের শান্তি নষ্ট করে।
নিয়ম করুন, সকালের নাশতা বা কিছু কাজ শুরু না করা পর্যন্ত ফোন বা সামাজিক মাধ্যমে যাবেন না। সকালে খবর পড়া এড়িয়ে চলুন। কারণ, এটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারে। যখন ফোন ব্যবহার করবেন, তখন ইতিবাচক ও প্রেরণাদায়ক কনটেন্ট দেখুন, যা আপনার দিনকে উজ্জ্বল করবে।
৫. শরীরচর্চা করুনশরীরচর্চার উপকারিতা আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন অনেকে বাড়ি থেকে কাজ করছেন, শরীরচর্চা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। বাড়িতে কাজ করার ফলে ঘাড়ে ও পিঠে ব্যথা, পেশির সমস্যা বাড়ছে।
সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।
ইউটিউবে হাজারো ধরনের ব্যায়ামের ভিডিও পাওয়া যায়, যা বাড়িতে সামান্য জায়গায় করা যায়। যদি বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সকালে ৩০ মিনিট হাঁটুন। লক্ষ্য হলো শরীরকে সচল রাখা এবং শক্তি বৃদ্ধি করা।
আরও পড়ুনসুস্থ জীবন যাপনে মহানবী (সা.)-এর ৯ অভ্যাস২৪ জুলাই ২০২৫সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।৬. পুষ্টিকর নাশতা গ্রহণব্যস্ততার কারণে অনেকে সকালের নাশতা বাদ দেন, কিন্তু গবেষণা বলছে, পুষ্টিকর নাশতা দিনভর মনোযোগ বাড়ায়, অপ্রয়োজনীয় চিনির লোভ কমায় এবং শক্তি জোগায়। নাশতায় উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, যেমন ওটস বা মাল্টিগ্রেইন রুটি, স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন অ্যাভোকাডো বা বাদাম, গ্রিক ইয়োগার্ট এবং ফল অন্তর্ভুক্ত করুন।
সময় কম থাকলে একটি স্মুদি তৈরি করুন—পালংশাক, আপেল এবং হিমায়িত কলা ব্লেন্ড করে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর নাশতা তৈরি করা যায়। এটি দিনের শুরুতে সবুজ শাকসবজি গ্রহণের একটি সহজ উপায়।
৭. নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনবাড়ি থেকে কাজ করার সময় অনেকে ক্যাজুয়াল পোশাকে থাকেন। বরং সকালে সুন্দর পোশাক পরুন, যা আপনার মেজাজ উজ্জ্বল করবে। একটু পছন্দের সুগন্ধি ব্যবহার করলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১নবীজি (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং এটি আপনার মানসিক প্রস্তুতি ও দিনের জন্য উৎসাহ বাড়ায়।
সকাল আমাদের দিনের ভিত্তি। ইসলাম আমাদের শেখায় যে সকাল আল্লাহর বরকত নিয়ে আসে। তাহাজ্জুদ, ফজরের পর জাগ্রত থাকা, করণীয় তালিকা তৈরি, স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা, শরীরচর্চা, পুষ্টিকর নাশতা এবং নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন—এই সাতটি অভ্যাস আমাদের সকালকে উৎপাদনশীল করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সূত্র: দ্য মুসলিম ভাইব ডট কম
আরও পড়ুনরহমতের দুয়ারে হাজিরা১৫ জুন ২০২৪