সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় নদীয়া পাকিস্তানের ভাগেই ছিল। নদীয়ার সদর কৃষ্ণনগরে ১৫ আগস্টের আগের দিন ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার জিলাপি বিতরণ হয়েছিল। উড়েছিল পাকিস্তানের মার্কা সবুজ চাঁদ–তারা পতাকা। দিন চারেক পরে ভ্রম সংশোধন হয়। বলা হয়, বাঁটোয়ারা ভুল হয়েছে। পাকিস্তান খুলনা পেলেও হারাতে হলো মুর্শিদাবাদ আর চিরতরে পদ্মার জান ফারাক্কা। নদীয়ার সবটা ভারতে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও অর্ধেকটা পাকিস্তান পেয়ে যায়। নদীয়ার তিনটি মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় নতুন জেলা কুষ্টিয়া।

প্রস্তাব ছিল নাম হবে পূর্ব নদীয়া, যেমন হয়েছিল দিনাজপুরে। ভারতভাগে পাওয়া খণ্ডিত দিনাজপুরকে অনেক দিন পর্যন্ত পশ্চিম দিনাজপুর বলেই ডাকত। যাহোক, কুষ্টিয়া মহকুমার নামেই জেলার নামকরণ হলেও জেলা সদরের কোনো অবকাঠামো সেখানে ছিল না। মহকুমা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন আর বড় হাইস্কুলটি সরকার কবজা করে পুলিশ লাইনস বানিয়ে ফেলে। ভারতভাগে চলে যাওয়া অংশ থেকে চলে আসে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহব্যবস্থাহীন এক মহকুমা শহরের জনমিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। হাটবাজার, রাস্তা, স্টেশন, খেয়াঘাট, মসজিদ ও মহল্লায় চেনার চেয়ে অচেনা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।

শহরের নাগরিক নেতৃত্বে নতুন বিভাজকরেখা তৈরি হয়। পৌর ও স্থানীয় নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। কিন্তু সবার অজান্তে মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে সবাই আবার এককাট্টা হয়ে যায়। নানা স্বাদের সবজি দিয়ে যেমন তৈরি হয় একটা সুস্বাদু তরকারি, অনেকটা সে রকম এক সামাজিক মূলধন তৈরি হয়ে যায় জান্তে–অজান্তে। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে সেই সামাজিক মূলধন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। গোলাবারুদ, রসদ, সংগঠিত–প্রশিক্ষিত লোকবল বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই ছিল না কুষ্টিয়াবাসীর পুঁজিতে। শুধু ছিল সামাজিক পুঁজি—একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার।

তখনো মুক্তিবাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ, সেক্টর, সেক্টর কমান্ডার—কোনো কিছুই গড়ে ওঠেনি। এসব শব্দ তখন শোনেনি কেউ। ঢাকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন নেতারা। মানুষ কিন্তু টের পাচ্ছিল, আলোচনার নামে ছলচাতুরী চলছে। বুঝে গিয়েছিল শত্রুদের সঙ্গে হবে না সমঝোতা। দেশটা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। হাতে সময় নেই।

জনযুদ্ধের প্রথম অগ্নিপরীক্ষার নাম ‘দ্য ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’। সেদিন কুষ্টিয়ার মতো একটি ছোট্ট শহর দেখিয়েছিল কীভাবে লড়াই করতে হয়। কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের মাঠে ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে লাল–সবুজের ছয়টি তারাখচিত একটি পতাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সেদিনই স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদী (পরে রক্ষীবাহিনী তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে গড়াই নদে তাঁর লাশ ফেলে রাখে)। ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত হয় জয় বাংলা বাহিনী।

সেদিনই কুষ্টিয়ার প্রতিটি গ্রামে জয় বাংলা বাহিনী গড়ে ওঠে, পরে যা মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন ইপিআর (পরবর্তীতে বিডিআর, এখন বিজিবি), পুলিশ, আনসার এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখলেও নেতৃত্ব আর ব্যবস্থাপনা ছিল ছাত্র–জনতার হাতে। ছাত্র–জনতা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। একদলের দায়িত্ব ছিল কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সেনার অবস্থান, সেনাসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সম্ভাব্য আক্রমণের একটি নকশা তৈরি করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও দৌলতপুর ইপিআরের ক্যাম্পগুলোয় সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এ কাজের নেতৃত্ব ছিল মূলত ছাত্রদের। তাঁরাই খুঁজে বের করেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় আধা সামরিক বাহিনী মুজাহিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কে কে অস্ত্র (রাইফেল) চালানো শিখেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ পাকিস্তানি বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া তথা পরাজয়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যা নিয়ে সাংবাদিক ড্যান কগিন বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যায় প্রচ্ছদকাহিনি রচনা করেন। সে কারণে কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক নজিরবিহীন উদাহরণই শুধু নয়, রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে এই বীরত্বগাথা। কুষ্টিয়ার যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রাথমিকভাবে একটি বড় ধরনের বিজয়। এই যুদ্ধ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে সাহস জোগায়।

ইপিআর নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলা, তাদের রাজি করানো, প্রশিক্ষিত যোদ্ধা সংগ্রহ ইত্যাদির দায়িত্ব নেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

ছাত্র–জনতা আরেকটি বড় দায়িত্ব নেয়—যোদ্ধাদের জন্য খাবার আর পানীয় সংগ্রহ এবং সেগুলো বণ্টন। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রুটি, গুড় ও ডাব সংগ্রহ শুরু হয়ে যায় ২৮ মার্চ থেকে। সংগ্রহকারীরা গ্রামে গিয়ে দেখেছেন মায়েরা রুটি বানাচ্ছেন। কোথায় তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়নি। বলতে হয়নি রুটি ও ডাব দিন। সবকিছু প্রস্তুত ছিল। গাছিরা গাছি সলেমানের নেতৃত্বে তাঁদের মনের নির্দেশে শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে গাছ থেকে ডাব নামিয়ে রাখার তাগিদ দেওয়া শুরু করেন ২৩ মার্চ থেকে। অনেকেই বুঝতে পারেননি সেই তাগিদের হেতু।

মেজর আবু ওসমান তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর মতো খাদ্য সরবরাহের কোনো রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলান্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোককে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাহায্যে আমাদের সব বাহিনীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমতো যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।’

স্বেচ্ছাসেবকেরা হয়ে ওঠেন যুদ্ধের প্রধান ভিত্তি বা চালিকা শক্তি। পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিল জিপে স্থাপিত ১০৬ এমএম রিকোয়েললেস রাইফেল (আরআর), পর্যাপ্তসংখ্যক চীনা এইচএমজি, এলএমজি, এসএমজি ও অটোমেটিক রাইফেল। তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ, গাড়ি ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানির ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের প্রায় সমপরিমাণ সাজসজ্জা।

অন্যদিকে সব কটি ইপিআর ক্যাম্প মিলিয়ে অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মরচে পড়া চারটা ৩.

৫ রকেট লঞ্চার। যেকোনো বিবেচনায় এগুলো ছিল একটা নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া যুদ্ধের সামরিক নেতৃত্বে থাকা মেজর আবু ওসমান বলেছিলেন, ‘তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সঙ্গে ছিল সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।’

যুদ্ধ করে কুষ্টিয়া মুক্ত করার ইচ্ছাটা এত প্রবল ছিল যে একটা কনভেনশনাল যুদ্ধের জন্য যা যা সরঞ্জাম লাগে, বলতে গেলে তার কিছুই ছিল না। ছিল শুধু প্রতিজ্ঞা আর আর বিশ্বাস—‘আমরা পারব’। কোনো রকম ফিল্ড ওয়্যারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কমিউনিকেশনের ব্যবস্থা ইপিআরের ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। কুষ্টিয়া টেলিফোন অফিসের কর্মীরাই সেটা করেন। তরুণ–প্রবীণ চিকিৎসকেরা গড়ে তোলেন ফিল্ড চিকিৎসাকেন্দ্র। ফার্মেসির মালিকেরা ওষুধের ব্যবস্থা করেন।

২৫ মার্চ রাতেই কুষ্টিয়াও দেশের অন্যান্য শহরের মতো পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ওই দিন রাত পৌনে ১২টায় যশোর সেনাছাউনি থেকে পাকিস্তানি মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে এবং ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহর উপ–অধিনায়কত্বে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের ডি-কোম্পানির ২১৬ জন সেনা এসে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন আক্রমণ করে।

কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা আগে থেকেই আঁচ করতে পারেন। তাঁরা তাঁদের অস্ত্র নিয়ে পাশের গড়াই নদ সাঁতরে পার হয়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেন। বাকি পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরপর পুলিশ লাইনস, জিলা স্কুল, টেলিগ্রাফ অফিস, থানা ও আড়ুয়াপাড়া ওয়্যারলেস অফিস দখল করে তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে।

কুষ্টিয়ার বেসামরিক প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রসাশক পরিবার নিয়ে তাদের ঘাঁটিতে যোগ দেয়। পরদিন ২৬ মার্চ সারা শহরে ৩০ ঘণ্টার লাগাতার কারফিউ জারি করে। শুরু হয় শহরময় সেনাটহল। সেনাটহল আর কারফিউয়ের মধ্যেই কুষ্টিয়ার ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদেনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রথম প্রতিরোধ আসে ছাত্রদের তরফ থেকে। তাঁরা টহলরত সেনাযানের ওপর পেট্রলবোমা নিক্ষেপের চেষ্টা করেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে রংপুর থেকে কুষ্টিয়ায় বোনের আশ্রয়ে চলে আসা ছাত্র দেওয়ান মিজানুর রহমান (রনি) বা রনি রহমান এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

কুষ্টিয়ার ছাত্র–জনতার পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে ২৮ মার্চ রাতে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর সেক্টর কামন্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর সঙ্গে কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানি ঝিনাইদহ এসে পৌঁছায় এবং যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে। যশোর সেনাছাউনি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আসতে চাইলে তা প্রতিহত করাই ছিল এই অবরোধের উদ্দেশ্য। ২৯ মার্চ ভোর চারটায় আক্রমণ করার কথা ছিল, কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সুবেদার মোজাফফর কোম্পানি যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেনি, তারপর ৩০ মার্চ ভোর চারটায় তিন দিক থেকে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলো সংযুক্তভাবে আক্রমণ করা হয়।

কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, পুলিশ লাইনস, আড়ুয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশন—এগুলো ছিল পাকিস্তানিদের প্রধান ক্যাম্প। এ ছাড়া ছিল থানা ও টেলিফোন একচেঞ্জ। তিন দিক থেকে একই সময় তিনটি পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর প্রবলভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীকে জিলা স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করতে আদেশ দেওয়া হয়। নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) আড়ুয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশন আক্রমণ করতে আদেশ দেওয়া হয়।

ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয় ছাত্র–জনতার লাঠি বা জয় বাংলা বাহিনী। পুলিশ লাইনস আক্রমণের নেতৃত্ব দেন সুবেদার মোজাফফর। এই গ্রুপে লাঠি বাহিনীসহ ছাত্র–জনতা পুলিশ লাইনস–সংলগ্ন জজ সাহেবের বাড়ি ও আশপাশে অবস্থান নেয়। কুষ্টিয়া থানা ও টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমণের প্রধান ভূমিকা পালন করে ২৫ মার্চ গড়াই নদ পার হয়ে হরিপুরে আশ্রয় নেন পুলিশ সদস্যরা।

সব প্রস্তুতি শেষ হলে ৩০ মার্চ ভোর চারটায় পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কুষ্টিয়া শহরকে বিচ্ছিন্ন করার পর একটি ওপেনিং ফায়ারের সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সামান্য রাইফেল, কয়েকটি এলএমজি আর অফুরন্ত মনোবল, অদম্য সাহস ও দেশপ্রেম নিয়ে ছাত্র–জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অস্ত্রের ঘাটতি পূরণ হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের গগনবিদারী চিৎকারে। পাকা ফসলের মাঠে পাখি তাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত বাঁশ ফাটানো আওয়াজ এই যুদ্ধে সফল অস্ত্র হয়ে ওঠে।

দূর থেকে এই শব্দ শুনলে মনে হয় যেন মেশিনগানের আওয়াজ। আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। সারা দিন যুদ্ধের পর বিকাল পাঁচটায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ভোর থেকে শুরু হয়ে বিকাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের অধিকাংশই নিহত হয়। কুষ্টিয়া শহরের তিনটি প্রধান ঘাঁটি পুলিশ লাইনস, জিলা স্কুল ও ওয়্যারলেসের মধ্যে শুধু জিলা স্কুল ছাড়া সব মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।

বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জিলা স্কুল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং অবিরাম আঘাত হানতে থাকেন। রাতের অন্ধকারে জীবিত ৪০ থেকে ৪৫ জন পাকিস্তানি সেনা দুটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়িতে করে ঝিনাইদহের পথে পালানোর চেষ্টা করে। পলায়নকালের আগেই শৈলকুপার (ঝিনাইদহ) সেতুর কাছে ছাত্র–জনতা আগে থেকেই অ্যাম্বুশ করে রাখে।

সেতুটি ভেঙে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতরা দিয়ে রং করে পিচঢালা রাস্তার মতো করে রাখে। পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি দুটি গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে ছাত্র–জনতা অতর্কিত আক্রমণ করে। এখানে মেজর শোয়েবসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনা আহত অবস্থায় আশপাশের গ্রামে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসীর হাতে তারা নিহত হয়। ৩১ মার্চ আহত অবস্থায় লে. আতাউল্লআহ শাহ ধরা পড়ে। ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন।

শহীদ মুক্তিযযোদ্ধারা হলেন হামেদ আলী, পিতা: ওমোদ আলী, গ্রাম: দুধকুমড়া, কুমারখালী; দেলোয়ার হোসেন, পিতা: আলম হোসেন, মিরপুর; খন্দকার আবদুর রশিদ, পিতা: আবদুর রহমান, গ্রাম: বামনপাড়া, মেহেরপুর; ফজলুর রহমান, পিতা: নাসির উদ্দিন, গ্রাম: মেহেরপুর; আশরাফ আলী খান, পিতা: হাছেন আলী খান, বামনপাড়া, মেহেরপুর; গোলাম শেখ, পিতা: নজীর শেখ, গ্রাম: মশান, মিরপুর।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ পাকিস্তানি বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া তথা পরাজয়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যা নিয়ে সাংবাদিক ড্যান কগিন বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যায় প্রচ্ছদকাহিনি রচনা করেন। সে কারণে কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক নজিরবিহীন উদাহরণই শুধু নয়, রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে এই বীরত্বগাথা। কুষ্টিয়ার যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রাথমিকভাবে একটি বড় ধরনের বিজয়। এই যুদ্ধ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে সাহস জোগায়।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক এবং ‘একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক।

ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব চ ছ স বক প ল শ ল ইনস ছ ত র জনত র ব যবস থ এই য দ ধ অবস থ ন ঝ ন ইদহ র জন য র পর ক প রস ত শহর র র ওপর রহম ন প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ