রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধে যেভাবে জড়িয়ে পড়ল চার্চ
Published: 30th, March 2025 GMT
২০২২ সালের শীতের এক দুপুর। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পেচার্স্ক লাভ্রা গির্জার বিশাল সোনালি গম্বুজের ওপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। ইতিহাসের এই সাক্ষীস্থল কখনই কেবল প্রার্থনার জায়গা ছিল না, ছিল ইউক্রেনীয় জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু আজ এর চারপাশে উত্তেজনা। মঠের ভেতরে রুশ ও ইউক্রেনীয় পাদরিদের মধ্যে ঠান্ডা বাগ্যুদ্ধ চলছে। বাইরের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখেও একই রকম উত্তেজনা। তারা সবাই জানে, এই তর্ক শুধু ধর্মীয় নয়, এটি শতাব্দীপ্রাচীন জাতিগত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অংশ।
আসলেও তা–ই। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুধুই ট্যাংক, বন্দুক আর ক্ষেপণাস্ত্রের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসের গহিনে গাঁথা এক বিশ্বাসের লড়াইও বটে। চলছে চার্চের অন্দরে, ধর্মীয় গোঁড়ামির পটভূমিতে। হয়তো বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধুই ভূখণ্ড ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কিন্তু যদি চার্চের দিকে তাকান, তাহলে বুঝবেন—এখানেও চলছে আরেকটি সমান্তরাল যুদ্ধ।
যখন থেকে শুরুএ কাহিনির শুরু অনেক আগে। একেবারে এক হাজার বছর পেছনে গেলে দেখা যাবে এক অন্য রকম ইউরোপ। তখন কিয়েভান রাস ছিল পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। ৯৮৮ সালে গ্র্যান্ড প্রিন্স ভ্লাদিমির খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রজাদেরও একই ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। কিয়েভ এ সময় থেকেই রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এরপরই আসে ধ্বংসের কাল।
মোগলদের আক্রমণে কিয়েভের গৌরব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ১২৪০ সালে এই নগরী সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে ক্ষমতার ভার চলে যায় উত্তরের মস্কোর হাতে। মস্কো ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে এবং রুশ চার্চ নিজেকে পূর্ব ইউরোপের প্রধান ধর্মীয় কর্তৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু ইউক্রেনের মানুষ মস্কোর এই আধিপত্যকে কখনোই মেনে নেয়নি। কিয়েভের চার্চ বহুদিন ধরে কনস্ট্যান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্কের অধীন ছিল। ১৬৮৬ সালে রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট এই চার্চকে মস্কোর অধীন নিয়ে আসেন। ইউক্রেনের জন্য তা ছিল এক অপমানজনক ঘটনা।
কালের পরিক্রমায় ইউক্রেনীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু চার্চের প্রশ্ন তখনো অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল। মস্কোর জ্যেষ্ঠ পুরোহিতেরা ইউক্রেনের চার্চের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চান। কিন্তু অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা চাইছিল, একটি স্বতন্ত্র অর্থোডক্স চার্চ। বহুদিনের চেষ্টার পর ২০১৮ সালে কনস্ট্যান্টিনোপলের ইকিউমেনিক্যাল পেট্রিয়ার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চকে স্বীকৃতি দেন। এ ঘটনায় মস্কো প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। তারা কনস্ট্যান্টিনোপলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
যুদ্ধ শুরুর পর এ গল্পের শেষ কোথায় কেউ জানে না। হয়তো একদিন গির্জাগুলোতে যুদ্ধের গর্জন নয়, আবার শুধু প্রার্থনার ধ্বনি শোনা যাবে। কিন্তু সেই দিন যে খুব কাছে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে।রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলে চার্চের বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। রুশ অর্থোডক্স চার্চ খোলাখুলিভাবে পুতিনের আগ্রাসনকে সমর্থন জানায়। এ সমর্থন ইউক্রেনীয়দের ক্ষোভের কারণ হয়। ইউক্রেনের চার্চ মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষ নেয়। দুই দেশের চার্চের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। এতটাই খারাপ যে অনেক জায়গায় মঠ ও গির্জা নিয়ে উভয় পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
রাশিয়া যখন ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তখন রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান পেট্রিয়ার্ক কিরিল এ হামলাকে ধর্মীয়ভাবে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন পশ্চিমা সংস্কৃতির শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের সত্যিকারের অর্থোডক্স বিশ্বাস রক্ষা করা দরকার। পেট্রিয়ার্ক কিরিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ। তাঁর বক্তব্য প্রায়ই পুতিনের যুদ্ধনীতির সঙ্গে মিলে যায়। অন্যদিকে ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চ এ আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের চার্চ রাশিয়ার চার্চ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দেয়। অনেক ইউক্রেনীয় ধর্মযাজক প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করেন, রাশিয়ার চার্চের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলেন।
ইউক্রেন সরকারও এই ধর্মীয় লড়াইকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছে। তারা রাশিয়াসমর্থিত চার্চের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং রাশিয়ার চার্চের সম্পত্তির কিছু অংশ বাজেয়াপ্ত করেছে। এমনকি রাশিয়াঘনিষ্ঠ চার্চ নেতাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগও আনা হয়েছে।
এটি শুধু ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং এটি গির্জার অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইও বটে। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাদের উপাসনালয় দখলের চেষ্টা চলছে। ইউক্রেনের কিছু শহরে দেখা গেছে, রুশ চার্চের যাজকদের গির্জা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে দাবি করছেন, রুশ চার্চ গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িত।
রাশিয়ায় যাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। এমনকি যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলা কিছু রুশ যাজককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাউকে চার্চ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।
ইউক্রেনে বোমায় বিধ্বস্ত একটি চার্চ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ইউক র ন য় ও ইউক র ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলের হামলা চলতে থাকলে পারমাণবিক আলোচনা হবে না: ইরানের প্রেসিডেন্ট
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। মাখোঁ তাকে ‘উত্তেজনা এড়াতে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের’ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইরানকে পারমাণবিক আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। খবর বিবিসির
পেজেশকিয়ান মাখোঁকে বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত থাকলে ইরান আলোচনার টেবিলে বসবে না।
রোববারের নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনা বাতিল ঘোষণা করার পরে ইরানের প্রেসিডেন্ট এ কথা বলেছেন।