রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধে যেভাবে জড়িয়ে পড়ল চার্চ
Published: 30th, March 2025 GMT
২০২২ সালের শীতের এক দুপুর। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পেচার্স্ক লাভ্রা গির্জার বিশাল সোনালি গম্বুজের ওপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। ইতিহাসের এই সাক্ষীস্থল কখনই কেবল প্রার্থনার জায়গা ছিল না, ছিল ইউক্রেনীয় জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু আজ এর চারপাশে উত্তেজনা। মঠের ভেতরে রুশ ও ইউক্রেনীয় পাদরিদের মধ্যে ঠান্ডা বাগ্যুদ্ধ চলছে। বাইরের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখেও একই রকম উত্তেজনা। তারা সবাই জানে, এই তর্ক শুধু ধর্মীয় নয়, এটি শতাব্দীপ্রাচীন জাতিগত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অংশ।
আসলেও তা–ই। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুধুই ট্যাংক, বন্দুক আর ক্ষেপণাস্ত্রের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসের গহিনে গাঁথা এক বিশ্বাসের লড়াইও বটে। চলছে চার্চের অন্দরে, ধর্মীয় গোঁড়ামির পটভূমিতে। হয়তো বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধুই ভূখণ্ড ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কিন্তু যদি চার্চের দিকে তাকান, তাহলে বুঝবেন—এখানেও চলছে আরেকটি সমান্তরাল যুদ্ধ।
যখন থেকে শুরুএ কাহিনির শুরু অনেক আগে। একেবারে এক হাজার বছর পেছনে গেলে দেখা যাবে এক অন্য রকম ইউরোপ। তখন কিয়েভান রাস ছিল পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। ৯৮৮ সালে গ্র্যান্ড প্রিন্স ভ্লাদিমির খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রজাদেরও একই ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। কিয়েভ এ সময় থেকেই রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এরপরই আসে ধ্বংসের কাল।
মোগলদের আক্রমণে কিয়েভের গৌরব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ১২৪০ সালে এই নগরী সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে ক্ষমতার ভার চলে যায় উত্তরের মস্কোর হাতে। মস্কো ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে এবং রুশ চার্চ নিজেকে পূর্ব ইউরোপের প্রধান ধর্মীয় কর্তৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু ইউক্রেনের মানুষ মস্কোর এই আধিপত্যকে কখনোই মেনে নেয়নি। কিয়েভের চার্চ বহুদিন ধরে কনস্ট্যান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্কের অধীন ছিল। ১৬৮৬ সালে রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট এই চার্চকে মস্কোর অধীন নিয়ে আসেন। ইউক্রেনের জন্য তা ছিল এক অপমানজনক ঘটনা।
কালের পরিক্রমায় ইউক্রেনীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু চার্চের প্রশ্ন তখনো অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল। মস্কোর জ্যেষ্ঠ পুরোহিতেরা ইউক্রেনের চার্চের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চান। কিন্তু অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা চাইছিল, একটি স্বতন্ত্র অর্থোডক্স চার্চ। বহুদিনের চেষ্টার পর ২০১৮ সালে কনস্ট্যান্টিনোপলের ইকিউমেনিক্যাল পেট্রিয়ার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চকে স্বীকৃতি দেন। এ ঘটনায় মস্কো প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। তারা কনস্ট্যান্টিনোপলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
যুদ্ধ শুরুর পর এ গল্পের শেষ কোথায় কেউ জানে না। হয়তো একদিন গির্জাগুলোতে যুদ্ধের গর্জন নয়, আবার শুধু প্রার্থনার ধ্বনি শোনা যাবে। কিন্তু সেই দিন যে খুব কাছে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে।রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলে চার্চের বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। রুশ অর্থোডক্স চার্চ খোলাখুলিভাবে পুতিনের আগ্রাসনকে সমর্থন জানায়। এ সমর্থন ইউক্রেনীয়দের ক্ষোভের কারণ হয়। ইউক্রেনের চার্চ মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষ নেয়। দুই দেশের চার্চের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। এতটাই খারাপ যে অনেক জায়গায় মঠ ও গির্জা নিয়ে উভয় পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
রাশিয়া যখন ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তখন রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান পেট্রিয়ার্ক কিরিল এ হামলাকে ধর্মীয়ভাবে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন পশ্চিমা সংস্কৃতির শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের সত্যিকারের অর্থোডক্স বিশ্বাস রক্ষা করা দরকার। পেট্রিয়ার্ক কিরিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ। তাঁর বক্তব্য প্রায়ই পুতিনের যুদ্ধনীতির সঙ্গে মিলে যায়। অন্যদিকে ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চ এ আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের চার্চ রাশিয়ার চার্চ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দেয়। অনেক ইউক্রেনীয় ধর্মযাজক প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করেন, রাশিয়ার চার্চের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলেন।
ইউক্রেন সরকারও এই ধর্মীয় লড়াইকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছে। তারা রাশিয়াসমর্থিত চার্চের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং রাশিয়ার চার্চের সম্পত্তির কিছু অংশ বাজেয়াপ্ত করেছে। এমনকি রাশিয়াঘনিষ্ঠ চার্চ নেতাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগও আনা হয়েছে।
এটি শুধু ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং এটি গির্জার অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইও বটে। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাদের উপাসনালয় দখলের চেষ্টা চলছে। ইউক্রেনের কিছু শহরে দেখা গেছে, রুশ চার্চের যাজকদের গির্জা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে দাবি করছেন, রুশ চার্চ গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িত।
রাশিয়ায় যাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। এমনকি যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলা কিছু রুশ যাজককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাউকে চার্চ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।
ইউক্রেনে বোমায় বিধ্বস্ত একটি চার্চ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ইউক র ন য় ও ইউক র ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।