বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে দাবি করেছেন যে, তাঁর দেশই এ অঞ্চলের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের ‘একমাত্র’ অভিভাবক। ভারতের তরফ থেকে তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এমন কি ভারত ‘মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট কোঅপারেশন প্যাক্ট’-এ জোর দিচ্ছে এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে এ চুক্তিতে স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। বস্তুত ইউনূসের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটি নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে।

গত সপ্তাহে চীনে মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় বিদেশ সফরের সময় বলেন যে, চীনের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ ‘স্থলবেষ্টিত’ তথা ল্যান্ডলকড। তিনি বেইজিংকে আহ্বান জানান, বাংলাদেশকে চীনের অর্থনীতির একটি ‘এক্সটেনশন’ হিসেবে গড়ে তুলতে–যেখানে বাংলাদেশ চীন ও বৈশ্বিক বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করবে।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। ঢাকা ক্রমেই চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যাহোক, সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ইউনূসের এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এবারের বিমসটেক সম্মেলনে বাংলাদেশ সংস্থাটির সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে।

গত এক দশকে বিমসটেক নয়াদিল্লির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, এ সংস্থায় শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানও অন্তর্ভুক্ত। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিমসটেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যেখানে অন্য আঞ্চলিক সংস্থা তথা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) অচল হয়ে থাকায় বিমসটেকের গুরুত্ব বেড়েছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানও সার্কের সদস্য।

বাংলাদেশ যখন বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে তখন ভারত কী ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জয়দীপ মজুমদার বলেছিলেন, ‘বিমসটেকের চেয়ারম্যানশিপের বিষয়ে বলতে গেলে, আমি মনে করি বিমসটেকের সাতটি দেশই সমানভাবে আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ একই দিনে একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনে বিমসটেকের মহাসচিব ইন্দ্রমণি পাণ্ডে বলেন, আঞ্চলিক সংস্থাটির নেতারা আসন্ন সম্মেলনে প্রথম ভিশন নথি–ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ গ্রহণ করবেন। এই ভিশন হলো সামুদ্রিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং একাধিক সমঝোতা স্মারক। বিমসেটেকে এ সম্মেলন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভিশন নথির মাধ্যমে আঞ্চলিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, সেখানে সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা সংস্থা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে।
 
ভারতের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সংযুক্তি জরুরি এ কারণে যে, এ অঞ্চল ভারতের নিরাপত্তার কৌশলগত দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত এই অঞ্চলে কৌশলগত নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্প, যা মণিপুরের মোরেহকে থাইল্যান্ডের মাই সটের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ভারত মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর কাঠামোও নির্মাণ করেছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বিকল্প এবং তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সমুদ্রপথ তৈরি করবে। এটি কলকাতার সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করবে। তবে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের চলমান কারণে উভয় প্রকল্পই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ স্থাপনের একমাত্র স্থলপথ হলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর।

বিমসটেক সম্মেলন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন। নেপালে গত সপ্তাহে রাজতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়, যেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন। ২০০৮ সালে এক দশকের মাওবাদী বিদ্রোহের অবসান ঘটানোর চুক্তির পর নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়। গত ১৭ বছরে ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান চতুর্থ বছরে প্রবেশ করেছে এবং থাইল্যান্ডে যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে গত বছর আদালত বরখাস্ত করেছিল, সেখানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ৭.

৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত অন্তত তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ভারত মিয়ানমারের মান্দালয়ে একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেছে এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর ৮০ জন উদ্ধারকর্মী মোতায়েন করেছে। এছাড়া, আকাশ ও সমুদ্রপথে মানবিক সহায়তা প্রদান করছে। বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপস্থিতি আশা করা যাচ্ছে। তবে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং সম্মেলনে অংশ নেবেন কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

থাইল্যান্ডে পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রা গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর আগে শ্রেথা থাভিসিন দেশটির সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক বরখাস্ত হন। ১৬ বছরের মধ্যে চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রেথা বরখাস্ত হন। শ্রীলঙ্কায় আনুরা কুমারা দেসানায়েকে গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন, যেখানে তার রাজনৈতিক জোট–ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার তথা এনপিপি সংসদীয় নির্বাচনে ২২৫টির মধ্যে ১৫৯টি আসন লাভ করে। তবে তিনি ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে অংশ নেবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী হারিনি আমারাসুরিয়া শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেবেন।

শেষবার বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলন ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার উদ্যোগে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরাসরি হিসেবে ২০১৮ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ছিল সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলন। গত বছর বিমসটেকের জন্য একটি সনদ কার্যকর হয়, যা বিমসটেককে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। এই সনদ সংগঠনের মূলনীতি, উদ্দেশ্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্ধারণ করে। বিমসটেক বর্তমানে নিরাপত্তা (সমুদ্র ও সাইবার নিরাপত্তাসহ), খাদ্য ও মানব নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পাশাপাশি যোগাযোগ ও জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানোর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান গঠনে মনোযোগ দিচ্ছে।

[দ্য প্রিন্ট অবলম্বনে]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব মসট ক র অন ষ ঠ ত সহয গ ত গত বছর ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ