ধৈর্য ধরার আহ্বান কুয়েট কর্তৃপক্ষের, হলে ওঠার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
Published: 8th, April 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে ১৫ এপ্রিল। তবে এখনই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। এ জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আনিছুর রহমান ভূঞা এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আজ মঙ্গলবার এসব তথ্য জানান।
এদিকে আগামী রোববার ক্যাম্পাসে ফিরে সবাই একসঙ্গে হলে ওঠার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ‘কুয়েট ১৯’ নামের একটি ফেসবুক পেজে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল সোমবার ওই ঘোষণা দেন। ওই পেজ থেকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো.
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে অতি দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ও হলগুলো খোলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আশাবাদী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী–শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কুয়েটের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শেখ শরীফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দাপ্তরিক কার্যক্রম ১৫ এপ্রিল শুরু হবে, এটা আগেই সিদ্ধান্ত ছিল। আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তী নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটে হয়েছে; তাই সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমেই এ দুই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীফুল আলম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা হয়নি। আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করা আছে।
এদিকে কুয়েট ১৯ নামে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘কুয়েটের হল কমিটি, সব বিভাগের ভিপি ও সিআরদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৩ এপ্রিল নিরাপদ ক্যাম্পাসের প্রত্যাশায় আমরা আমাদের কুয়েট ক্যাম্পাসে প্রত্যাগমন করব এবং সবাই একসঙ্গে হলে উঠব।’
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সব শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ জেলা অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংঘবদ্ধভাবে ক্যাম্পাসে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে ফেসবুক পোস্টে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুয়েট ১৯ ফেসবুক পেজে আরও একটি পোস্ট করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান প্রশাসনকে কুয়েটিয়ানরা পরিহার করেছে। কুয়েটিয়ানদের ১৩ এপ্রিল হলে ফেরার ঘোষণার মুখে প্রশাসন থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিকে আমরা পরিহার করছি। ১৩ এপ্রিল সারা দেশ থেকে কুয়েটিয়ানরা তাদের নিজ নিজ হলে ফেরত আসবে।’
১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হন। পরের দিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ওই ঘটনার তদন্তে কমিটিও করা হয়। ওই দিন রাতেই খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে লাল কার্ড দেখান শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ সব ক প অন য য বন ধ র র জন ত র জন য তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
‘বেগম’ রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ধারণ করেছে
আমার জন্ম ১৯৫২ সালে। এই জন্যই বলছি যে, ‘বেগম’ পত্রিকা আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমার মা ‘বেগম’ পত্রিকা পড়তেন। সেটা বলছি এই কারণে যে, আমি যে পাড়ায় জন্মেছি সেই পাড়ার নাম টিকাটুলি। আমি দেখেছি গবেষণা করতে গিয়ে, অনেকগুলো পাড়ার মধ্যে যে সমাজ এবং সংস্কৃতি দেখা যায় সেটাই কিন্তু পরবর্তীকালে নির্ধারণ করে বড় ও বৃহৎ আকারে কোন ইতিহাসটা সৃষ্টি হবে। টিকাটুলি নতুন ঢাকা এবং পুরোনো ঢাকার মাঝামাঝি একটা জায়গায় পড়ে। টিকাটুলিতে যেসব মানুষ থাকতেন তাদের মধ্যে অনেক বড় একটা অংশ ছিল কলকাতা থেকে আসা মুসলমান জনগোষ্ঠী। তথ্যটা এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘বেগম’ পত্রিকা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। শুরু থেকেই নারীদের লেখা ও ছবি পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়।
‘বেগম’ এ সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, কবিতা, জীবনী, গল্প, উপন্যাস, নারীর স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য, সেলাই, রান্না, ভ্রমণকাহিনীসহ নানা বিভাগে আলাদা আলাদা মেজাজের লেখা প্রকাশ হয়। এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৎকালীন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। শুরুতে সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল, পরে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নূরজাহান বেগম। ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার পরে ১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকার অফিস ঢাকায় চলে আসে। বেগম পত্রিকার নতুন ঠিকানা হয় বর্তমানে পুরোনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে। সেই দিক থেকে পত্রিকাটাও কিন্তু কলকাতা থেকে চলে আসা মানুষের সংস্কৃতি। এটাই হচ্ছে প্রধান সূত্র। কলকাতা থেকে চলে আসা মানুষ তাহলে কারা? এই মানুষগুলো হচ্ছে, তারা যারা বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল এবং বঙ্গীয় মুসলীম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত পূর্ব বঙ্গের মানুষ। যেহেতু কলকাতা শিক্ষা-দীক্ষা এবং চাকরি-বাকরির কেন্দ্র ছিল, সেই কলকাতার কেন্দ্রে থেকে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন সূচিত হওয়ায় এই মানুষদের অনেকে রাজনীতিবিমুখ হন।
১৯৪৭ সালের যে রাজনীতি, সেটা যৌথ বাংলার রাজনীতি। ওই রাজনীতি কংগ্রেসের কারণে সফল হয়নি। ‘বেগম’ পত্রিকার চিন্তা-চেতনার ধারক যারা তারা এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন। একইসঙ্গে তারা কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের প্রতিও ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই একটা জনগোষ্ঠী অর্থাৎ কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী যারা কংগ্রেসকেও পছন্দ করে না, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগকেও পছন্দ করে না। এটা খুব মৌলিক একটা বিষয় তাদের সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে। এই পত্রিকায় শুধু সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে সেটা না, ‘বেগম’ পত্রিকার একটি বড় দিক ছিল এটি একটা প্রতিনিধিত্বমূলক কণ্ঠস্বর। আমরা যদি প্রথম প্রচ্ছদটা দেখি বেগমের, তাহলে দেখবো যে, প্রথম প্রচ্ছদটি করা হয়েছিল বেগম রোকেয়ার। তাহলে বোঝায় যাচ্ছে যে, এরা হচ্ছে মোটামুটি উন্মুক্ত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীর পত্রিকা। এই বাস্তবতাটা হলো খুব বড়।
দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে টিকাটুলিতে যে মানুষগুলো এসে থাকলো, আমরা যদি তাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো তাদের জীবনচিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে। এবং তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিফলন হচ্ছে, বেগম সুফিয়া কামাল নিজে। তিনি থাকতেন টিকাটুলিতে। আমরা যখন বড় হচ্ছি, যে সংস্কৃতির মধ্যে বড় হচ্ছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। টিকাটুলির ওই গোষ্ঠীটা যে মনোভাব ধারণ করতো, এ সময়ের মানুষের মধ্যে হয়তো এতোটা ধারণ করা সম্ভব না। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা থেকে আসা মানুষগুলোর কেউ পাকিস্তানপন্থী ছিল না। তাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি যে ক্ষোভ বা জিন্নাহ’র প্রতি ক্ষোভ ছিল বা করাচিভিত্তিক যে পাকিস্তান- সেই পাকিস্তানের প্রতি ক্ষোভ ছিল। সেই পাকিস্তান কিন্তু আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার। একই সঙ্গে আমরা বুঝতাম এই মানুষগুলো হিন্দুবিরোধী না। এটা এখনকার দিনে সম্ভব না। সেই সময়ের এই মানুষগুলো ভারতবিরোধী ছিল কিন্তু হিন্দুবিরোধী ছিল না। এই মানসিকতাটা আমরা মনে হয় না যে এখন আমরা এতোটা প্রবলভাবে দেখতে পাবো।
আমি টিকাটুলির ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, এই পাড়াতে যে শ্রেণীর মানুষ ছিল এরা কলকাতাতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তারা বাংলাদেশে চলে এসেছে, পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছে। তার মানে তারা মানসিকভাবে ওই কলকাতাকেন্দ্রীক জীবনের সঙ্গে একাত্ম ছিল না। যদিও কলকাতাকেন্দ্রীক জীবনই তাদের তৈরি করেছে। সেটা শেখ মুজিবুর রহমানই হোক আর মওলানা ভাসানীই হোক বা অন্যান্য শিক্ষিত মানুষ হোক। তো এই যে নতুন জনগোষ্ঠী তৈরি হলো, শিক্ষিত, রাজনৈতিক সচেতন জনগোষ্ঠী, ‘বেগম’ পত্রিকা হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠীর নারী অংশের জন্য। তখন সমাজে নারী-পুরুষের সমান পরিসরে ছিল না।
ছোটবেলায় বেগম সুফিয়া কামালকে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম। এবং এই টিকাটুলি পাড়ার মধ্যে আমি বলবো, তিনি ক্ষুদ্র প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে একটা প্রতীক। টিকাটুলিটা সেই অর্থে ‘বেগম’ পত্রিকার একটার পাড়াভিত্তিক প্রতিভূ। একইসঙ্গে এটি যে শুধু বেগম সুফিয়া কামালের তা নয়, সুফিয়া কামালের সঙ্গে আরেকটা জিনিস হয়তো আমরা খেয়াল করি না; আজকের এই যে ‘সমকাল’ পত্রিকা, এই পত্রিকাটা কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা বা পূর্ব পাকিস্তানের। সমকালের সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরও টিকাটুলির বাসিন্দা। এখন এটাই আমি মনে করি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, গোটা বাংলাদেশের একটা পরবর্তীকালের যে বাংলাদেশ সেই বাংলাদেশের চিত্র কিন্তু এখানে পাওয়া যায়।
এরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পরিবর্তীত হয়ে যে চিত্রটা নিয়ে সামনে আসছে সেটা ৪৭-এর পরের বাংলাদেশের আন্দোলন। ১৯৪৭-এর আগেও বাংলাদেশের আন্দোলন ছিল; ১৯৪৬-এ যখন জিন্নাহ একটা পাকিস্তান বলে দুইটা পাকিস্তানের বদলে, তখন সেই আন্দোলন স্তিমিত হয়। তখন যৌথভাবে বাংলার আন্দোলন হয় আবুল হাশেমের নেতৃত্বে। কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয় কংগ্রেসের জন্য। যৌথ বাংলার আন্দোলন একবার মুসলিম লীগ ব্যর্থ করেছে, একবার কংগ্রেস ব্যর্থ করেছে। এটা আমার স্মরণ রাখা দরকার। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যে তারা থেমে গেছে তা না। এটা আমি বুঝতে পারি আমার তৈরি হওয়ার সময় বা আমার ছোটবেলায়। কারণ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি, আমরা যে বাড়িটাতে থাকতাম সেটা ছিল কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের উল্টো দিকে। আমার মা দেখেছেন, মুনীর চৌধুরীর বোন দেয়াল টপকাচ্ছে। এটা কিন্তু একটা চিত্র। মায়ের কাছে শুনেছি আমার নানী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এই দেশে চলে এসেছিলেন। ১৯৫২ সালে নানী রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। কারণ ছেলেদের ওপর গুলি করা হচ্ছে। এই যে পথ-প্রক্রিয়া এই প্রক্রিয়াটা খুব সজীব চিত্র ছিল ৫২ সালেও। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে টিকাটুলি একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। টিকাটুলির অভয় লেনে শেখ সাহেবের বাবা এসে থাকতেন। তার মানে এটা একটা মধ্যবিত্ত পরিসর। তো সেখানে জন্ম ‘বেগম’ পত্রিকার।
ছোটবেলায় যখন ‘বেগম’ পত্রিকা দেখতাম, আমি ভাবতাম এটা সারাজীবন ধরেই আছে। পত্রিকাটা সবাই পড়তো। ঈদ সংখ্যাটা খুব মোটা হতো। ওই পত্রিকাতে যারা লিখতেন তাদের অনেকেই টিকাটুলিতে থাকতেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হতো। পত্রিকার লেখকদের নিয়ে কাছের মানুষ হিসেবে বাসায় আলাপ হতো, দূরের মানুষ হিসেবে নয়। সেদিক থেকে ঢাকা শহরের যে কয়টা মধ্যবিত্ত এলাকা ছিল তার মধ্যে টিকাটুলি গুরুত্বপূর্ণ। যারা ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে আসছে তাদের বসতি গড়ে উঠেছিল ওই টিকাটুলিতে। অর্থাৎ অভিবাসীদের আবাসস্থল হয়ে উঠেছিল। আগেই বলেছি, টিকাটুলিতে সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফরসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকতেন। সব মিলিয়ে টিকাটুলির এই সংস্কৃতি হচ্ছে ‘বেগম’ পত্রিকার সংস্কৃতি। অভিনেতা আলী যাকের, বুলবুল আহমেদ টিকাটুলিতে থাকতেন। টিকাটুলির অনেক পরিবার পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হয়।
টিকাটুলির ফিনোমেনোটা হচ্ছে একটা বড় সূত্র ‘বেগম’ পত্রিকার জন্য। নতুন যে বাংলাদেশ, আমার কাছে ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে যা মনে হয়েছে যে এই বাংলাদেশটা আগেই নির্মিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪০-এর দিকেই নির্মিত হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল সেই নির্মিত বাংলাদেশটা জন্ম লাভ করবে ১৯৪৬ সালের পরে। কিন্তু জিন্নাহ’র রেজ্যুলেশনে এটা পাল্টে গেলো। বাংলাদেশ নির্মিত হলো কিন্তু বাস্তবায়িত হলো না। আইনিভাবে এটা বড় ধাক্কা ছিল। ১৯৪৭ সালে আবার চেষ্টা করা হলো বাস্তব বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তখন ব্যর্থ হলো কংগেসের জন্য। বঙ্গের হিন্দুরা, যারা কলকাতার বাবু শ্রেণি তারা এটার সঙ্গে ছিল। এই যে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ‘বেগম’-এর জন্য। ‘বেগম’ এই ধারাবাহিকতা অর্থাৎ রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। আমি বলবো, ১৯৩৭ সালের নির্বাচন, ৪০-এর লাহোর প্রস্তাব, ৪৬-এর নির্বাচন এবং লাহোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, ৪৭-এর যৌথ বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান হওয়াÑ এ ঘটনাগুলোর যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়েছে সেটা পৌঁছে দিচ্ছে ১৯৫০-এর দোরগোড়ায়। ৪৭, ৪৮-এর মধ্যেই ভাষা আন্দোল নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনে ‘বেগম’ পত্রিকার চেতনা ধারণকারী এইসব মানুষ প্রচ-ভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল।
মুসলিম লীগের যে চরিত্র এটা ‘বেগম’ ধারণ করেনি। ‘বেগম’ ধারণ করেছে এখনকার বাংলাদেশ, অর্থাৎ একাত্তরের বাংলাদেশের যে ধারণা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে ধারণা সেটা। যার শুদ্ধতা ও চিত্রতা আমরা জীবনের মধ্যে দেখতে পাই। এই পত্রিকায় যারা লিখতেন তাদের মধ্যে ছিলেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ। তিনি যে ‘বেগম’ পত্রিকায় লিখতেন, সেটা সাংস্কৃতিকভাবে সবার পত্রিকায় পরিণত হলো। পত্রিকাটি ধারাবাহিক রাজনীতির প্রতীকে পরিণত হলো।
এই দিকটা না দেখে শুধু সংস্কৃতি আর সংখ্যার দিকটিই আমরা দেখি। ‘বেগম’-এর ভূমিকা এতোটা সীমাবদ্ধ ছিল না। পত্রিকাটি তাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, যারা বাংলাদেশপন্থী। সচেতনভাবে কথাটি বলছি, আমাদের ইতিহাসে কোনোদিন পাকিস্তান আসেনি। আমাদের ইতিহাসে সবসময় বাংলাদেশ এসেছে। সেই ধারাবাহিকতাই ‘বেগম’ ধারণ করেছে।
আমার মনে আছে পত্রিকাটির বাৎসরিক সভা হতো। ওই বাৎসরিক সভায় আমার মা যেতেন। সাধারণত মা খুব একটা বাইরে বের হতেন না। কিন্তু ‘বেগম’-এর বাৎসরিক আয়োজনে পুরান ঢাকায় যেতেন। আমি আমার মায়ের সঙ্গে দুইবার গিয়েছি। এই পত্রিকার যে মূল মেজাজ সেটা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে। যেটা ঐতিহাসিক বাংলাদেশ। আমি ‘বাঙালি’ বলছি না, খুব সচেতনভাবে ‘বাংলাদেশি’ বলছি। তার অর্থ আমি বা আমরা ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। মুসলিম লীগ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কংগ্রেস। এজন্য আমাদেরকেই আমাদের আলাদা ইতিহাস বানাতে হবে। এটাই ‘বেগম’ ধারণ করেছিল।
একাত্তরের আগে পাকিস্তানে ‘অজগর’ পত্রিকা ছিল। এই অঞ্চলের সাহিত্যিকরা ইন্ডিয়ার পত্রিকাতে লিখতো। আমি যখন সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েছি, দেখেছি হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান সবাই কলকাতার পত্রিকাতে লিখতেন। কলকাতায় যদি লেখা প্রকাশ হতো, তার অর্থ কলকাতার স্বীকৃতি। কিন্তু ‘বেগম’ নারীদের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হতো। এখানে লেখা ছাপা হওয়াটা স্বীকৃতি ছিল। এই স্বীকৃতি ‘বেগম’ দিতে পেরেছে, তার কারণ বেগমের যে লোকাল স্ট্যান্ডার্ড, তার যে ধারণা, তার সম্পর্কে ধারণা, সে যা বহন করে, তার যে ইমেজ, তার যে ব্র্যান্ড; তা ছিল গ্রহণযোগ্য।
এখন গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখি, বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ পড়ে। কোন স্বল্পসংখ্যক? সেদিক থেকে যদি ‘বেগম’ চারশো, পাঁচশো কপিও বিক্রি হয়ে থাকে তাহলে বিশাল ব্যাপার। ‘বেগম’-এ লেখার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের ছবি প্রকাশ হতো। পত্রিকাটি পাঠকের সঙ্গে একাত্মতা তৈরি করতে পেরেছিল। মানুষগুলোকে এক তাঁবুর ভেতরে নিয়ে বলতে পেরেছে, ‘এটা বেগমের তাঁবু; তোমরা এখানে আসতে পারো।’ এবং মানুষ এসেছে।
‘বেগম’-এর প্রতিপক্ষ কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘বেগম’কে কখনও কোথাও বোঝাতে হয়নি, বলতে হয়নি যে, আমি এখানে আছি, এটা বলতে পারছি। ‘বেগম’ সমস্ত কিছুই বলেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পত্রিকাটিকে মানুষ গ্রহণ করেছে। এই গ্রহণযোগ্যতা আজকের দিনের বাংলাদেশের কোনো পত্রিকার নাই। বাংলাদেশের বাঙালি মধ্যবিত্ত নারী শ্রেণির কাছে যতটা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, বাংলাদেশের কোনো পত্রিকা, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কারও কাছে দাঁড়াতে পারেনি।
সেদিক থেকে ‘বেগম’র গণমাধ্যমভিত্তিক যে সাফল্য এই সাফল্যের তুলনা হয় না। পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকটি পত্রিকা বের হয়েছে। ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘অনন্যা’ প্রকাশ হতে থাকে। সেটা জনপ্রিয় হয়েছে, আধুনিক হয়েছে। কিন্তু ‘বেগম’ যে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯৭১ পর্যন্ত (তার পরবর্তীতে ততটা বলছি না) তার তুলনা করা যায় না।
একাত্তরের আগে ‘দৈনিক বাংলা’ প্রকাশিত হতো। পত্রিকার মালিকানা ছিল পাকিস্তান সরকারের হাতে। ‘বেগম’ সরকারি পত্রিকা না। বেগম নাসির উদ্দিন সাহেবের পত্রিকা, নূরজাহান বেগমের পত্রিকা, সুফিয়া কামালের পত্রিকা। এই যে ব্র্যান্ডিং বা এই যে ভাব তৈরি করা, এই ভাব বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটারও নেই। ‘বেগম’ কেবলমাত্র সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের, শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের কণ্ঠস্বর হয়নি, একটা জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হয়েছে। যে নিজের স্বকীয়তা আগেই ধারণ করেছে কিন্তু প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যে প্রস্ফুটিত হয়েছে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নয়, সেই চরিত্রটা ‘বেগম’ ধরেছে এবং এই শ্রেণিকে বেগম সামনে নিয়ে এসেছে। এটাই হচ্ছে ‘বেগম’-এর সবচেয়ে বড় সাফল্য।
দায়িত্ব নিয়ে বলছি, অন্য কোনো পত্রিকা এই কাজটি করতে পারেনি। সেটা সাহিত্যে হোক, গণমাধ্যমে হোক অন্য কোনো ক্ষেত্রেই হোক। এভাবে এতোটা আস্থার সাথে একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচরণ বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম করেনি। এটাই হচ্ছে ‘বেগম’-এর সবচেয়ে বড় সাফল্যগাঁথা।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক