কিছুদিন আগে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফের হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এরই মধ্যে তিন সপ্তাহ পার হয়েছে। প্রাণ গেছে সহস্রাধিক মানুষের। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র চাপ সৃষ্টির কথা ছিল। প্রকাশ্য ও গোপনে নিন্দার ঝড় বয়ে যেতে পারত। নেতানিয়াহু যাতে গাজায় হামলা চালানোর ক্ষেত্রে লাগাম টানেন, সে বার্তা আসত ইউরোপ ও হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে।

গতকাল মঙ্গলবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০ জানুয়ারি পদত্যাগের আগ পর্যন্ত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাঝেমধ্যেই নেতানিয়াহুকে চাপ দিতেন। এ নিয়ে প্রায়ই তিনি ব্যর্থও হয়েছেন। এখন বাইডেন ক্ষমতায় নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর পূর্বসূরির মতো আঙুল তোলার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে এখন ইউরোপ বিভ্রান্ত। সে সুযোগে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের সংসদে তাঁর জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সুসংহত করেছেন, যা তাঁকে গাজায় পদক্ষেপ নেওয়ার আরও রাজনৈতিক সুযোগ করে দিয়েছে।

সোমবার নেতানিয়াহু ওভাল অফিসে ট্রাম্পের পাশে যখন বসেছিলেন, তখন প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘এক মহান নেতা’ বলে প্রশংসা করেন। তবে যে দুটি প্রধান দাবি নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, সেগুলো অর্জিত হয়নি। তাঁর সফরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ওপর আরোপিত ১৭ শতাংশ মার্কিন শুল্ক থেকে ছাড় পাওয়া এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক পদক্ষেপের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন সমর্থন অর্জন।

এ দুটি বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন তাঁর জোটেনি। বৈঠকে একসময় যখন ট্রাম্প বাণিজ্য, অভিবাসন ও মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন নেতানিয়াহুকে বেশ খানিকটা মনোযোগহীনও দেখা যায়।

কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে সামরিক অভিযান শুরুর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ট্রাম্প বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নীরব ছিলেন। তিনি গত সপ্তাহে প্রকাশিত অ্যাম্বুলেন্স ও একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ওপর ইসরায়েলের হামলার কোনো উল্লেখ করেননি, যেখানে ১৫ জন জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী নিহত হয়েছিলেন।  ৩ এপ্রিল স্কুল গড়ে ওঠা আশ্রয়কেন্দ্রে হামলায় শিশুসহ কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন। এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেননি ট্রাম্প।

চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক সানাম ওয়াকিল বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, নেতানিয়াহু কৌশল হিসেবে বাড়তি চেয়ে প্রাপ্তির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। মাত্র দুই মাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর গাজার অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি হামলার মুখে ট্রাম্পের এমন নীরবতা নেতানিয়াহুকে এ কাজে আরও উৎসাহিত করছে।

ট্রাম্প-নেতানিয়াহু বৈঠকের বিস্তারিত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেকটা হঠাৎ করেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান। হাঙ্গেরি সফর শেষে তড়িঘড়ি করে সরাসরি ওয়াশিংটন যান নেতানিয়াহু। দ্য টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে সাংবাদিকদের উদ্দেশে ট্রাম্প জানান, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে ওয়াশিংটন। সেই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ‘ওই আলোচনা সফল না হলে ইরানের জন্য চরম দুর্দিন নেমে আসবে।’ 

বিশ্লেষকদের মতে, এ বক্তব্যে ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ‘প্রয়োজনে’ ইসরায়েলের সামরিক অভিযান চালানোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। 

নেতানিয়াহু বলেন, ইরানের পরমাণু প্রকল্প বন্ধ করতে কূটনীতিক সমাধান পাওয়া গেলে ভালো হবে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, ওই প্রকল্প বন্ধ করতেই হবে। 

ট্রাম্পের ঘোষণার পরই ইরানের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সরাসরি নয়, ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা হবে। পরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জানান, ওমানে দুই দেশ ‘উচ্চ পর্যায়ের পরোক্ষ আলোচনায়’ অংশ নেবে। এটা একই সঙ্গে একটি সুযোগ ও একটি পরীক্ষা। বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে। 

ইরানের তিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, পরোক্ষ আলোচনা ভালোভাবে এগোলে পরবর্তী সময় সরাসরি আলোচনায় রাজি হতে পারে তেহরান। তবে দেশটি সম্প্রতি ৬০ শতাংশ খাঁটি ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে সক্ষম হয়েছে, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয় না। পাশাপাশি, তেহরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের তাদের পরমাণু অবকাঠামো পরীক্ষা করতে বাধা দিয়েছে। 

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে গাজায় নতুন জিম্মি মুক্তির চুক্তির প্রসঙ্গ আসে। নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা এখন (গাজায়) আরেকটি চুক্তি নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, সফল হবো। আমরা সব জিম্মির মুক্তি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ লন্ডনভিত্তিক সৌদি সংবাদমাধ্যম আশার্ক আল-আওসাত জানায়, মিসর একটি নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। তবে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা জানান, তারা এখনও কায়রোর কাছ থেকে কিছু পাননি। ট্রাম্প জানান, গাজা যুদ্ধ বন্ধের দিন বেশি দূরে নয়।

এ অবস্থায় গাজায় অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। মঙ্গলবার এক দিনে গাজায় বিমান হামলায় আরও ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১৩ জন। এদিন গাজা সিটির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত দু’জন নিহত হন। দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। মধ্যাঞ্চলের দায়ের আল বালাহ সিটিতে ইসরায়েলের বোমায় এক পরিবারের ১১ সদস্য নিহত হয়েছেন।   

গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৪৭ জন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজায় ৫০ হাজার ৮১০ জন নিহত ও ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৮ জন আহত হয়েছেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল গ জ গণহত য ইসর য় ল র পর ক ষ ইসর য পরম ণ

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ