গো ট্রেনে পিকারিং থেকে উঠি। ডাউনটাউনে যাব অসম বয়সের তিনজন। আমি একা বসলাম। অন্যপাশে তরুণ দম্পতি। পাশ্চাত্যে যে কোনো জায়গায় বা যে কোনো অবস্থায় যুগল দম্পতি বা প্রেমিকের নানাভাবে তাদের ভালোবাসা প্রকাশে কোনো সংকোচ বা দ্বিধা নেই। আমার কাছে কখনও অশ্লীলও মনে হয়নি। কারণ, ওদের একটা আর্ট আছে। আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পরের স্টেশনে আরও একটি মাঝবয়সী দম্পতি উঠল। একটি মাঝবয়সী দম্পতির রোমান্টিকতা আমাকে আরও বিস্মিত করল। পরে জানলাম এ ধরনের দম্পতির নতুন রিলেশনশিপ। তবুও ভালো লাগল। আমাদের দেশে এমন করলে মানুষ বলত বুড়ো বয়সের ভীমরতি। জীবন যেন সব বয়সে উপভোগ্য, এটা উপলব্ধি করলাম।
দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম ট্রেনের জানালায়। বাইরের দিকে তাকালাম। ঝরা পাতার ঋতু আমাকে বিমর্ষ করে তুলল। কিছুদিন আগেও এ পথে বর্ণিল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বিমুগ্ধ করেছে। কত সুন্দর হতে পারে প্রকৃতির যে ঋতুকে ওরা ফল বা পতিত বলে। অর্থাৎ মরার আগে জেগে ওঠার মতো। এত বর্ণ প্রকৃতির হতে পারে, আমার জানা ছিল না। লাল-হলুদ-সবুজের মাখামাখি প্রকৃতির গায়ে। নববধূও এতটা বর্ণময় হয় না। কেমন করে হারিয়ে গেল প্রকৃতির বর্ণিল সাজ একটু একটু করে। এখন যেন ‘মাঘের সন্ন্যাসী’। আমিও নস্টালজিক হয়ে পড়লাম।
শহরে আসা কলেজ জীবন, ইউনিভার্সিটি জীবন আরও এক ধরনের বোধসম্পন্ন মধুময় সময়। নতুন নতুন মুখের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন কিছু শেখা বোঝা। স্যারদের লেকচারের ভাষা অন্যরকম; আগে কথাগুলো অশ্লীল মনে হতো। কত সহজভাবেই-না আকরাম স্যার ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস পড়ালেন। কুমুর গভীর উপলব্ধি নিজের মাঝে ধারণ করে ফেললাম। তবুও কোথায় যেন আশির দশকীয় একটি সংকোচ রয়েই গেল। হঠাৎ একদিন রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে আসার পথে পেছন থেকে একটি ছেলে আওড়াতে লাগল ‘ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে/ মুক্ত বেণী পিঠের ’পরে লোটে/ কালো? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’। পেছনে তাকানোর সাহস পাইনি কিন্তু বুকের ভেতরে এক শিহরণ ধুকধুক করতে লাগল। অনেক দিন পর তার নাম জানলাম, যাকে দেখলে আমি ভূত দেখার মতো চমকাতাম। কারণ, আমি আশির দশকের দুর্বল চিত্তের এক কালো মেয়ে, যার অনেক লম্বা চুল। আর একজন পেছনে নয়, সামনেই আবৃত্তি করল– ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। আমি অভিভূত হই, শিহরিত হই, কিন্তু ভীতু মফস্বলের আদর্শ আমাকে বলে– পালা পালা।
আরও তিনটি মেয়ে পরের স্টেশনে গো ট্রেনে উঠল। ওদের চুটিয়ে আড্ডা আড়চোখে দেখলাম। জীবন তো বৃক্ষ নয়, জীবন জীবন্ত প্রাণবন্ত। আমার মতো জীবনের সাথে প্রতারণা করে না ওরা। এটাই পাশ্চাত্য জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগা আমার। গো ট্রেনের এক ঘণ্টা আমার কাছে নস্টালজিক হলেও উপভোগ্য মনে হয়েছে। ছাত্রজীবনেই একজনের গলায় মালা পরালাম বলতে গেলে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও এই মেনে নেওয়ার স্বভাবের সনাতনী ভাবনায় মেনে নিলাম। কিন্তু গো ট্রেনের দম্পতিদের মতো রোমান্স প্রকাশ্যে করার সাহস হলো না। একটি চুম্বনের জন্য রিকশার হুড কত টানতে হয়েছে। তখন আমরা ছিলাম বিবাহিত। হঠাৎ কলকাকলিতে সম্বিত ফিরে এলো। দৃষ্টি ফেরালাম ট্রেনের কামড়ায়। নজর পড়লো একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার ওপর। আমরা প্রেগন্যান্সি ঢাকবার জন্য শাড়ি ওড়না কতভাবে পেটের ওপর টেনেছি। ওরা প্রেগন্যান্সি দেখানোকে আনন্দ বা গর্ববোধ করে। ছোট টিশার্ট আর ট্রাউজার পরা মহিলা কি উল্লাস চোখেমুখে সাথে আরও একজন মেয়ে। আমার সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের লজ্জা করে না। সে বলল, এটাতে লজ্জার কী আছে। এটা তো ওদের আনন্দময় প্রাপ্তি বলে ভাবে। একজন বৃদ্ধ মহিলা উঠল। একটি ছেলে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওনাকে এনে বসালেন। কুশল বিনিয়ম করলেন হাসি মুখে ওরা; কিন্তু শুধু সহযাত্রী। একটি কথা না বললেই নয়। পাশ্চাত্য শহরে রাস্তাঘাটে যার সাথেই দেখা হয় হাই বা হ্যালো বলে মৃদু হাসি হেসে সম্ভাষণ করে। আরও ভালো লাগলো ওদের ডিসিপ্লিন। প্রত্যেক যাত্রী সুন্দরভাবে সিটে বসে চোখাচুখি হলে মৃদু হাসি দেয়, যেন কত চেনা। ট্রেনের কামড়ায় ওরা বই নিয়ে ওঠে। বিশেষ করে একটু বয়স্ক মানুষদের দেখলাম নিবিষ্ট চিত্তে বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন। ছাত্রছাত্রী বা কর্মজীবী টাইপের অনেকে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে ট্রেনের কামরায়। ওদের গতিময় জীবনে যেন স্থবিরতার ঠাঁই নেই। একেবারে অল্পবয়সীরা একটু হাসিঠাট্টায় মেতে যাচ্ছে। ওখানে একটি জিনিস আমার কাছে অবাক লেগেছে, ট্রেন জ্যামে পড়ে। সাথে সাথে অ্যানাউন্স করে যাত্রীদের জানিয়ে দেয়। আরও একটা ব্যাপার দেখলাম, ট্রেনে দু’একজন গাঁজাখোর উঠেছে। সবাই বেশ সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকায়। এসব গাঁজা আসক্ত লোকেরা শহরেও কিছু কিছু গর্হিত কাজ করে। কিন্তু ওদের প্রতি কেউ খারাপ ভঙ্গি পোষণ করে না। ট্রেনের কামড়ায় দেড় ঘণ্টা সময় বিচিত্র জীবন অবলোকন করলাম। বিশেষ করে ওরা কাউকে ন্যূনতম ডিস্টার্ব করে না। যার যার রুচিমতো সে আনন্দ করছে, কাজ করছে– আমাদের মতো সমালোচনায় কেউ লিপ্ত হয় না। যথা সময়ে ট্রেন স্টেশনে থামল। হুড়োহুড়ি নেই। ধীরে ধীরে সবাই নামল।
ভাবলাম একই বিশ্বগ্রামের মানুষ আমরা, জীবন যাপনে কত ভেদ। ওদের জীবনে প্রচণ্ড রকমের ডিসিপ্লিন আছে, আছে প্রচণ্ড মুক্তি। প্রত্যেকে প্রত্যকের রুচিশীলতা, আনন্দময়তা যেভাবে উপভোগ করলো ট্রেনের একটি কামরায়; কেউ কারোর বিনোদনের অন্তরায় হলো না। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতি মেয়ে
ফরিদপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর কমিটি গঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা।গত মঙ্গলবার এনসিপির সদস্যসচিব আক্তার হোসেন ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ওই চিঠিতে ফরিদপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছে মো. আব্দিুর রহমানকে এবং সংগঠক করা হয়েছে মো. রাকিব হোসেনকে।
এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের পাঁচটি জেলা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী জেলার দু’জন করে ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফরিদপুর জেলার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যে দু’জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের একজন হলেন সৈয়দা নীলিমা দোলা। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে এবং জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ নাসিরের ভাগনি। দোলার বাবা সৈয়দ গোলাম দস্তগীর পেশায় ব্যবসায়ী।
সৈয়দা নীলিমা ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। বর্তমানে ‘সিনে কার্টেল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী।
এ বিষয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী রাজনীতি করা সংক্রান্ত কিছু পোস্ট আপনাদের সামনে আসতে পারে। আমি নিজে এর একটা ব্যাখ্যা রাজপথের সহযোদ্ধাদের দিয়ে রাখতে চাই। আমি ১০ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করছি। নো মেট্রো অন ডিইউ মুভমেন্ট, রামপাল বিরোধী আন্দোলন, ডিএসএ বাতিলের আন্দোলন, সুফিয়া কামাল হলকে ছাত্রলীগ মুক্ত করাসহ অন্যান্য সকল আন্দোলনে আমি পরিচিত মুখ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লেখালেখিও পুরনো। ২০১২ সালে পরিবার ছাড়ার পর রাজপথই আমার আসল পরিবার। জুলাইয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অন্যতম মামলা তাহির জামান প্রিয় হত্যা মামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরাসরি ছাত্রলীগ করে অনেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আমি কখনও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তাই আমার নাগরিক কমিটির সদস্য হতে বাধা কোথায়? এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেনে-বুঝে এবং আমি ‘লিটমাস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ নেত্রীর মেয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন জেলার এনসিপি কমিটি গঠনে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব সোহেল রানা বলেন, ‘তার (সৈয়দা নীলিমা) পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড আওয়ামী লীগ। আমরা দেখেছি, গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে তার মামা গোলাম নাসির কিভাবে আমাদের ওপর নির্বিচার গুলি ছুড়েছিল। তার মায়ের কর্মকাণ্ডও আমাদের অজানা নয়।’
সৈয়দা নীলিমা দোলার সঙ্গে আমাদের পরিচয় পর্যন্ত নেই মন্তব্য করে সোহেল রানা বলেন, ‘আসলে দায়িত্ব দেওয়ার আগে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হলে ভাল হতো। যাচাই-বাছাই করা হলে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’