যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি, কেন এত দাম বাড়ল
Published: 11th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ছুঁয়েছে ডিমের দাম। মার্চ মাসে দেশটিতে এক ডজন ডিমের দাম দাঁড়িয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৩ ডলার। মার্চের শেষে পাইকারি দাম কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এর তেমন প্রভাব পড়েনি।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকেই ডিমের দাম বাড়ছে। ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম পৌঁছায় ৫ দশমিক ৯০ ডলারে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিলো গড়ে দুই ডলার।
গত মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দাম ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে। তিনি এর জন্য কৃষিমন্ত্রী ব্রুক রোলিন্সের প্রশংসা করে বলেন, দাম কমানোর ক্ষেত্রে তিনি ‘ভালো কাজ’ করেছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের তথ্যমতে, এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের (মুরগির মাংস, কমলার রস, গরুর কিমা, বেকন ও পাউরুটি) তুলনায় ডিমের দাম এখনো ৭৫ শতাংশ বেশি।
ডিমের দামে বড় ধরনের ওঠানামায় ডিম পাচারের ঘটনা বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশকে ডিম রপ্তানি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকার ইতিমধ্যে ডেনমার্ক, তুরস্ক ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো থেকে ডিম আমদানির চেষ্টা করছে। আর ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে দেশটির বিচার বিভাগ।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিমের দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব। ২০২২ সাল থেকে দেশটি এ সংকট মোকাবিলায় ধুঁকছে। চলতি বছরে বার্ড ফ্লুর সংক্রমণে একজনের মৃত্যু হয়েছে। খামারিরা তিন কোটির বেশি ডিম দেওয়া মুরগি নিধন করেছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, যদি কোনো খামারে একটি মুরগিও আক্রান্ত হয় তাহলে পুরো খামারের সব মুরগি মেরে ফেলতে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে নতুন করে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। তবে এরপরও ডিম উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাডা থম্পসন স্কাই নিউজকে বলেন, একটি মুরগি ডিম দিতে শুরু করতে সাধারণত ছয় মাস সময় লাগে।
স্কাই নিউজ জানায়, কিছু অঞ্চলে ডিমের দাম আরও বেশি বেড়ে গেছে। কোথাও প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ৮ দশমিক ৯৬ ডলারে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এক সংবাদে জানায়, ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছু দোকানে ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বাড়তি দাম সামলাতে অনেক রেস্তোরাঁ, যেমন ডেনিস ওয়াফেল হাউস চেইন তাদের মেনুতে ডিমের তৈরি খাবারের পদে অতিরিক্ত দাম যুক্ত করেছে।
ডিমের দাম বাড়ার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দুষছেন ট্রাম্প। মার্চের শুরুতে কংগ্রেসে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, জো বাইডেন ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়েছেন। ডিমের দাম এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দাম কমানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন তাঁরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ডজন ড ম
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।