গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার পর থেকে আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের এজেন্ডা এবং সে এজেন্ডা আমেরিকা, আর্থিক বাজার ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে নিয়মিতভাবে মন্তব্য করে আসছি।

ট্রাম্প আসার পর অস্থিরতার অভাব হয়নি, তবে তা ছিল অনেকটাই প্রত্যাশিত। কারণ, ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া যে অগোছালো ও অপ্রত্যাশিত হবে, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল।

আমি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে উল্লেখ করেছিলাম, ট্রাম্পের আগ্রাসনের জবাবে অন্যান্য অর্থনীতি যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা ও আর্থিক বাজারের ওপর নির্ভরতা কমায়, তাহলে এটি ইতিবাচক একটি দিক হতে পারে। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও আশার কথা হলো, ইউরোপ ও চীন ইতিমধ্যেই এ ধরনের পরিবর্তনের দিকে এগোতে শুরু করেছে। জার্মানি তাদের ‘ঋণসীমা’ কিছুটা শিথিল করে অতিব্যবস্থাপনার বাইরে গিয়ে জরুরি বিনিয়োগের অনুমতি দিচ্ছে। আর চীন বলছে, তারা অভ্যন্তরীণ ভোক্তা খরচ বাড়ানোর উপায় খতিয়ে দেখছে।

যে দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বাজারের ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য এটা পরিষ্কার, যদি যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যযুদ্ধের নীতি একটু কমায়ও, তারপরও নতুন ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দরকার হবে। অনেক দেশ এখন নিজেদের মধ্যে বেশি বাণিজ্য করতে চাচ্ছে এবং দ্রুত বাড়তে থাকা সেবা খাতে যেসব নিয়মকানুন বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেগুলো কমাতে তারা নতুন চুক্তি করার চেষ্টা করছে।

একটি জোট হিসেবে জি-৭-এর বাকি দেশগুলো (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাজ্য) একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান শক্তিশালী। এর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ‘ইচ্ছুকদের জোট’-এর অন্য সদস্যদের যোগ করলে ট্রাম্পের আনা অনেক ক্ষতিই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে।

একইভাবে যদি চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ভারত ও অন্যান্য বড় উদীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে সমন্বয় করে পুনর্গঠন করতে পারে, তাহলে তা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে।

এ ধরনের পদক্ষেপগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও হুমকির প্রভাব কিছুটা কমাতে পারবে। তবে এ কাজগুলো সহজ হবে না, যদি সহজ হতো, তাহলে ইতিমধ্যেই হয়ে যেত। আজকের বাণিজ্য ও আর্থিক কাঠামো গড়ে উঠেছে নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং চীনের উপকারে আসতে পারে, এমন যেকোনো পরিবর্তন ট্রাম্প প্রশাসন ঠেকাতে চাইবে।

বড় বড় অন্য অর্থনীতিগুলো কীভাবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায়, বিনিয়োগ সক্রিয় করে এবং নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, তা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ব্রুগেল নামের থিঙ্কট্যাংক ও নেদারল্যান্ডসের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয়োজিত এক সম্মেলনে (গ্লোবালাইজেশন ও ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজন) আমি আবার মনে করিয়ে দিলাম, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা একপাক্ষিকভাবে হয়েছে।

২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বার্ষিক নামমাত্র জিডিপির একটি সরল বিশ্লেষণে দেখায়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরো জোন ও ভারত—এই চারটি দেশ মিলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী, যার মধ্যে আবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীনই প্রায় ৫০ শতাংশ শেয়ার করেছে।

এ তথ্য আবারও প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকির জবাব হিসেবে অন্যত্র আরও বেশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরি করতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব অর্থনীতিতে অংশ কমে যাওয়ার ক্ষতি একা পুষিয়ে দিতে সক্ষম একমাত্র দেশ চীন।

কিন্তু যদি চীন একা কাজ না করে? ধরো, ইউরোপ যেমন এখন বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াচ্ছে, এতে শুধু ইউরোপ নয়, বরং যুক্তরাজ্যের মতো অন্য দেশগুলোরও উপকার হবে। আর ভারতও গত কয়েক বছরে অনেক দেশের তুলনায় বেশি গতিতে এগোচ্ছে, তাই ওরাও চাইলে দেশের ভেতরে চাহিদা বাড়ানোর কিছু সুযোগ পেতে পারে। তাহলে যদি এই দেশগুলো একসঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করে আর একে অপরের সঙ্গে নীতি ঠিক করে নেয়, তাহলে কি আরও ভালো কিছু হতে পারে না?

এ ধরনের সমন্বয় হয়তো ২০০৯ সালের লন্ডন জি-২০ সম্মেলনের মতো বিশাল বৈশ্বিক প্রভাব ফেলবে না, যেখানে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও তার পরিণতি মোকাবিলায় ব্যাপক সংস্কার ও নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে যদি এই দেশগুলো বিশ্বকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে তারা নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক নীতি সমন্বয় ও অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে, তাহলে সেটি বিশ্বজুড়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সর্বশেষ কথা হলো, ব্রুগেল সম্মেলনে উপস্থাপিত একটি বিষয় আমার মনে গেঁথে আছে। এটি ছিল ব্রুগেলের সিনিয়র ফেলো আন্দ্রে সাপিরের উপস্থাপিত একটি চার্ট। সেই চার্টে জাপানের অর্থনৈতিক উত্থান এবং চীনের বর্তমান উত্থানের মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধরা হয়। ১৯৯০-এর দশকে জাপানের জিডিপি যখন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, তখন আমেরিকার বড় একটি ভয় ছিল—তারা পিছিয়ে পড়বে। এখন চীনকে নিয়েও একই ভয় দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু আসলে যুক্তরাষ্ট্র কী চায়? তারা কি শুধু এই প্রমাণ দিতে চায়, নামমাত্র হিসাবে তাদের অর্থনীতি সবচেয়ে বড়, নাকি তারা নিজেদের নাগরিকদের জন্য ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চায়?

এই দুটি বিষয় এক নয়। বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের যে বিষয়টি বোঝার দরকার, তা হলো অন্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন আসলে আমেরিকানদেরও আরও বেশি সম্পদশালী করে তুলতে পারে। হয়তো একদিন আমেরিকার নাগরিকেরা এমন কোনো নেতৃত্ব বেছে নেবে, যারা এই মৌলিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাটি বুঝতে পারবে। তবে আপাতত তারা হয়তো আরও অনেক বছর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় ভুগতেই থাকবে।

জিম ও’নিল গোল্ডম্যান স্যাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর থ ক আম র ক ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 

বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা/নাজমুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 
  • কুবিতে খেলার মাঠে মারামারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন
  • খুলনায় বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল, ভোলা সদরে কার্যক্রম স্থগিত
  • জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
  • বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের আবেদন করুন
  • নোবিপ্রবিসাসের বর্ষসেরা সাংবাদিক রাইজিংবিডি ডটকমের শফিউল্লাহ
  • এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ
  • ১০০ কোটির সম্পদ, স্বামীর প্রতারণা, ৪৭ বছর বয়সেই মারা যান এই নায়িকা
  • তানজানিয়ায় ‘সহিংস’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী সামিয়া
  • শিল্পের আয়নায় অতীতের ছবি