সম্প্রতি পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রায় ফ্যাসিস্টের প্রতিমূর্তি মোটিফের প্রতিক্রিয়ার এক নারীর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যেখানে নারীটি মোটিফটির রূপের সঙ্গে তাঁর শাশুড়ির চেহারার মিল খুঁজে পাওয়ার প্রসঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি শুধু তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং সামগ্রিকভাবেই তিনি শাশুড়িদের দানব রূপটির কথা বলেছেন।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই অনেক সমালোচনা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নারীটিকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়েছে, নারীটির স্বামীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ নারীটিকে আইনের আওতায় আনার দাবি পর্যন্ত তুলেছেন।

‘নারীই নারীর শত্রু’ কথাটি যেন এক স্বীকৃত সত্য। অথচ পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধের শীর্ষে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষের জয়জয়কার। ঘটে যাওয়া অপরাধের মাত্রায় পুরুষের আশপাশেও নেই নারী। ঘরের মধ্যে কিংবা বাইরে এক পুরুষ অন্য পুরুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে, মারামারি করছে, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করছে প্রতিনিয়ত। অথচ ‘পুরুষই পুরুষের শত্রু’ এমন কথার কিন্তু প্রচলন হয়নি আজও।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে শাশুড়ি সম্পর্কে নারীটির বক্তব্যটি ছিল খুবই দুঃখজনক, অশোভন ও অপ্রত্যাশিত। শাশুড়ি সম্পর্কে নারীটির সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির এই প্রকাশ অনেককেই আহত করেছে সন্দেহ নেই, তবে বক্তব্যটিতে নতুন করে খুব অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল বলে আমার মনে হয় না। নারীটির অনুভূতি কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো অনুভূতি নয়। ব্যতিক্রম একটাই যে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাশুড়ির নেতিবচাক রূপটির সঙ্গেই নারীকে পরিচিত করানো হয়েছে। ইতিবাচক শাশুড়ির প্রতিমূর্তি ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই ওই নারীকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, এই ধরনের চিন্তাভাবনা কিংবা অনুভূতি কীভাবে প্রোথিত হয় নারীর মনে? এর পেছনের রাজনীতিটি কী, যেখানে নারীকেই নারীর শত্রু কিংবা দানব হিসেবে চিত্রিত করা হয়? নারীকে নারীর শত্রু ভাবতে শেখার সুফলটি ভোগ করছে কে বা কারা?

‘নারীই নারীর শত্রু’ কথাটি যেন এক স্বীকৃত সত্য। অথচ পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধের শীর্ষে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষের জয়জয়কার। ঘটে যাওয়া অপরাধের মাত্রায় পুরুষের আশপাশেও নেই নারী। ঘরের মধ্যে কিংবা বাইরে এক পুরুষ অন্য পুরুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে, মারামারি করছে, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করছে প্রতিনিয়ত। অথচ ‘পুরুষই পুরুষের শত্রু’ এমন কথার কিন্তু প্রচলন হয়নি আজও।

পুরুষ সহিংস পুরুষের প্রতি, পুরুষ আরও বেশি সহিংস নারীর প্রতি। ২০১৮ সালে পরিচালিত ‘গ্লোবাল স্টাডি অন হোমিসাইড: জেন্ডার রিলেটেড ক্রাইম অন উইমেন অ্যান্ড গার্লস’ শিরোনামে গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন নারী তাঁদের পুরুষসঙ্গী বা পার্টনারদের হাতে খুন হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের পুরুষেরা বিশ্বে চতুর্থ। প্রতিদিন হাজার হাজার নারী ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হন।

পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে বাংলাদেশে মোট ৪০ হাজার ৮৮২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নারী কিংবা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক অন্তত একবার হলেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পুরুষের সহিংস আচরণের কারণে নিজের ঘর নারীর জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ স্থানে পরিণত হলেও ‘পুরুষ নারীর শত্রু’ বলে আখ্যায়িত হননি কখনো; বরং নারী অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ‘নারীর শত্রু’ হিসেবে সর্বমহলে বিবেচিত হয়েছেন।

যেখানে ঘরের বাইরের পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে পুরুষের হানাহানি-মারামারি নিত্যদিনের ঘটনা, সেখানে শাশুড়ি-বউ-ননদ সম্পর্ক কিংবা মামুলি কিছু সমস্যার জন্য কেন এক নারীকে অন্য নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নারীকেই নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে আর পুরুষের অত্যাচার-নির্যাতনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শেখায়। এই চর্চা নারীকে নারীর চোখে শত্রুর কাঠগড়ায় এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দেয় যেন নারী নারীর প্রতি আস্থা হারিয়ে পুরুষের প্রতিই আত্মবিশ্বাসী হন ও আত্মসমর্পণ করেন।

নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থান তাঁকে শেখায়, সংসারটাই তাঁর একমাত্র অবলম্বন। চারদেয়ালের সংসারটাই অনেক নারীর কাছে তাঁর একমাত্র সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিকর্ত্রী তিনি। পুরুষের মতো নারীর নেই বাইরের কোনো জগৎ, নেই কোনো বিনোদন কিংবা কোথাও অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ। তাই তাঁর একমাত্র সাম্রাজ্যের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে নারীতে নারীতে শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বারবারই নারীকে ‘সংকীর্ণ’ আর পুরুষকে ‘উদার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অথচ নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান যদি বিপরীত হতো, অর্থাৎ পুরুষ যদি ঘরে থাকত, আর নারী বাইরে, তবে এই টানাপোড়েন আলাদা হতো বলে মনে হয় না। পার্থক্য একটাই, সে ক্ষেত্রে শ্বশুর রূপটি হয়তো পুরুষের সামনে দানব হিসেবে আবির্ভূত হতো।

তবে সব পুরুষ যেমন পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা করেন না, ঠিক একইভাবে পুরুষতান্ত্রিক এই মানসিকতা যে শুধু পুরুষই লালন করেন, তা-ও কিন্তু নয়। কখনো কখনো নারীর মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক চর্চা প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। যে মানসিকতা একজন নারীকে অন্য একজন নারীর প্রতি সহিংস কিংবা বিরূপ করে তোলে, তার উৎসমূলে পুরুষতান্ত্রিকতা। যার বীজ রোপণ করা হয় শৈশবেই। শৈশব থেকেই একজন নারী অন্য একজন নারীকে হিংসাপরায়ণ হিসেবে ভাবতে শেখেন। এই শিক্ষা পুরুষতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্তভাবে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

নারীকে যতই ‘নারীর শত্রু’বলা হোক না কেন, সত্য এই যে নারী পুরুষকে যেমন ভালোবেসেছেন, ঠিক তেমনি ভালোবেসেছেন নারীকে। তাঁর এই মহানুভবতাই টিকিয়ে রেখেছে সভ্যতা। নারী কখনোই নারীর শত্রু নন, হতে পারেন না। নারী নারীর শত্রু নন; পুরুষও নারীর শত্রু নন। নারীর শত্রু মূলত ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’। তাই দানব যদি কেউ হয়ে থাকে, সে হলো ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’, যা সহিংসতা আর বৈষম্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। তাই পুরুষতান্ত্রিক এই চর্চাকে রুখে দিতে হবে, যার ক্ষতিকর প্রভাব গ্রাস করছে নারী ও পুরুষের সুন্দর ও স্বাভাবিক সম্পর্ককে।

নিশাত সুলতানা
লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ই ন র র শত র র একম ত র একজন ন র অপর ধ র শত ব দ জন ন র অন ভ ত

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতিতে না জাড়ানোর কারণ জানালেন প্রীতি জিনতা

বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। অভিনয়ে তাকে দেখা না গেলেও নিজের ক্রিকেট দলের হয়ে মাঠে তাকে প্রায়ই দেয়া যায়। মাঝে গুঞ্জন উঠেছিলে রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন তিন। অবশ্য এবিষয়ে টুঁশব্দও করেননি এই অভিনেত্রী।

এদিকে মাস তিনেক আগে কংগ্রেসের পক্ষ অভিযোগ তোলা হয়েছিল, প্রীতি জিনতার ১৮ কোটি টাকার ঋণ নাকি মকুফ করে দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। শুধু তাই নয়, প্রীতি নাকি তার সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বিজেপির হাতে সঁপে দিয়েছেন- এমন অভিযোগও ওঠে। এরপর বলিউড নায়িকার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জল্পনা শুরু হয়।

সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে প্রীতি জিনতাকে একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি ভবিষ্যতে বিজেপিতে যোগ দেবেন? আপনার গত কয়েক মাসের টুইট দেখে তো তেমনটাই মনে হচ্ছে। জবাবে অভিনেত্রী বলেন, ‘সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহারকারীদের এটাই একটা সমস্যা। সবাই এত বিচার করতে বসে যান সবকিছু নিয়ে। আমি যেমনটা আগে বলেছি, মন্দিরে, মহাকুম্ভে যাওয়া কিংবা নিজের পরিচয় নিয়ে আমি গর্বিত। তার মানে এই নয় যে এসমস্ত কারণে আমি বিজেপিতে যোগ দেব।’

প্রীতি বলেন, ‘ভারতের বাইরে থাকার ফলে আমি দেশের প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং আর পাঁচজন ভারতীয়র মতোই গর্ববোধ করি আমার দেশকে নিয়ে।’

রাজনীতিতে না আসার কারণ গত ফেব্রুয়ারি মাসেও জানিয়েছিলেন প্রীতি জিনতা। সেসময় তিনি বলেন, ‘রাজনীতি আমার দ্বারা হবে না। বিগত কয়েক বছরে একাধিক রাজনৈতিক দল আমাকে টিকিট দিতে চেয়েছে। এমনকি রাজ্যসভার আসনের প্রস্তাবও এসেছিল। তবে আমি বিনম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমার ইচ্ছে নেই। আর আমাকে ‘সৈনিক’ বললেও অতিরঞ্জিত হবে না। কারণ, আমি একজন আর্মি পরিবারের সন্তান। আমার বাবা সৈনিক এবং আমার দাদাও। আর্মি পরিবারের সন্তান হওয়ায় আমাদের মানসিকতা খানিক আলাদা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজেদের উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয় কিংবা হিমাচলী বা বাঙালি বলে ভাবি না, আমাদের পরিচয় শুধুমাত্র ভারতীয়। আর হ্যাঁ, দেশভক্তি আমাদের রক্তে।’ সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৫০ পেরোনো নারীর খাদ্যাভ্যাস যেমন হতে হবে
  • যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করছে চীন
  • সেলফি’র ধাক্কায় গণস্বাস্থ্যের কর্মীর মৃত্যু, ৬ বাস আটক
  • পেহেলগামে হামলার পর প্রতিশোধের আশঙ্কায় দিন কাটছে ভারতীয় মুসলিমদের
  • প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
  • গাজীপুরে জমি নিয়ে বিরোধে সংঘর্ষ, হাতুড়িপেটায় একজন নিহত
  • সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি
  • একাধিক সুযোগ পেয়েও কেন রাজনীতিতে জাড়াননি প্রীতি জিনতা
  • সুযোগ পেয়েও কেন রাজনীতিতে জাড়াননি প্রীতি জিনতা
  • রাজনীতিতে না জাড়ানোর কারণ জানালেন প্রীতি জিনতা