বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে অসংখ্য মানুষ মারা যান। বিশেষ করে বর্ষার আগমনী মৌসুমে—বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের তীব্রতা ও বিস্তার বাড়ছে। বজ্রপাতে মারা যাওয়া মানুষের একটি বড় অংশ গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমজীবী, যারা মাঠে কাজ করতে গিয়ে বা খোলা জায়গায় অবস্থান করে প্রাণ হারান। অথচ সামান্য সচেতনতাই পারে এসব প্রাণঘাতী ঘটনা রোধ করতে।
বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, উঁচু গাছের নিচে, ধাতব বস্তু বা বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছে অবস্থান করা ঝুঁকিপূর্ণ। বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখা উচিত। অনেকেই বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, যেটি ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাছাড়া, গবাদিপশু বা জমির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অনেক কৃষক মাঠে অবস্থান করেন, যা তাদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে মাঠপর্যায়ে এখনো পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি হয়নি। গ্রামীণ জনপদে স্কুল-কলেজে বজ্রপাত বিষয়ে সচেতনতা ক্লাস, পোস্টার, মাইকিং ও স্থানীয় ইমাম, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রচারণা জোরদার করা দরকার।
প্রযুক্তিগতভাবেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন, বজ্রপাতের সম্ভাব্য সময় ও এলাকা সম্পর্কে আগাম বার্তা মোবাইল অ্যাপ ও এসএমএসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানানো। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় বজ্রনিরোধক দণ্ড বা ‘লাইটনিং অ্যারেস্টর’ স্থাপন করা যেতে পারে। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোকে ‘বজ্রপাত নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়া, গবাদিপশুর জন্য আলাদা নিরাপদ স্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি, যাতে কৃষকেরা মাঠে না গিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারে। পাশাপাশি কৃষকদের সচেতন করে তুলতে কৃষি অফিসগুলোর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ চালানো দরকার।
বজ্রপাত থেকে মৃত্যু রোধে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে সচেতনতা। শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, পরিবার ও সমাজকেও এ বিষয়ে দায়িত্বশীল হতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধ সম্ভব নয়, কিন্তু সঠিক জ্ঞান ও প্রস্তুতি নিয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
সুতরাং বজ্রপাতকে অবহেলা না করে এটিকে একটি বাস্তব ও প্রাণঘাতী দুর্যোগ হিসেবে মেনে নিতে হবে। প্রশাসন, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগণ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই বজ্রপাতে অকালমৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব। সচেতনতা, সতর্কতা ও সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এই প্রাণঘাতী দুর্যোগের মোকাবিলা করতে।
মো.
আবু হানিফ বিন সাঈদ
শিক্ষার্থী, জনাব আলী সরকারি কলেজ
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ধান চাষে আশা জাগাচ্ছে এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষক কমলেশ শর্মা পাঁচ বছর ধরে তিন একর জমিতে ধান চাষ করছেন। পানিনির্ভর এ ফসলে সেচ দিতে প্রতিবছর তিনি বিদ্যুৎ বিল গুনতেন ১৩ হাজার টাকার মতো। প্রচলিত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ী অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং (এডব্লিউডি) পদ্ধতি ব্যবহারে সেই খরচ এখন নেমেছে ১০ হাজার টাকায়। আগে যেখানে এক মৌসুমে ৭০-৮০ বার সেচ দিতে হতো, এখন দিতে হচ্ছে ৬০ বার। এ ছাড়া প্রতি বিঘায় ধানও মিলছে ৫ থেকে ৭ মণ বেশি। পরিমিত সেচ দেওয়ায় জমিতে হয় না জলাবদ্ধতাও। এতে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ হয়েছে, কমেছে রোগবালাইও।
শুধু কমলেশ শর্মা নন; কালীগঞ্জ উপজেলার ৬০০ কৃষক এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। শেয়ার দ্য প্ল্যানেটের সহযোগিতায় স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কৃষককে এডব্লিউডি কৌশলের আওতায় নিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি কালীগঞ্জের মহাদেবপুর, কুরুলিয়া, সুন্দরপুর, মহেশ্বরচন্দ, ইছাপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। চারদিক পাকা ধানের ঘ্রাণে ম-ম। কৃষক সোনালি ফসল মাড়াই করছেন। নিজের ক্ষেতের পাশে বসে কৃষক আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, এ পদ্ধতিতে ১২ ইঞ্চি একটি প্লাস্টিক পাইপের ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত চারদিকে ছিদ্র করা হয়। এর পর ছিদ্রযুক্ত অংশ ধানের জমির নির্দিষ্ট স্থানে বসানো হয়। ভেতরের মাটি বের করার পর ছিদ্র দিয়ে পানি ঢোকে, যা দেখে জমিতে পানির পরিমাণ বোঝা যায়। ওই পানি দেখে প্রয়োজনমতো জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে জমিতে ধানের চারা বেশি গজাচ্ছে। রোগবালাইয়ের পরিমাণও কম। সেচ মালিকদেরও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ কমে এসেছে।
উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, আগে প্রতিদিন জমিতে সেচ দিতে হতো। এখন তিন-চার দিন অন্তর দিতে হয়। আগে না বুঝে পুরো জমিতে সেচ দেওয়া লাগত। অনেক বেশি বিদ্যুৎ বিল আসত। এখন তা লাগছে না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটারের মতো পানি লাগে, যার বেশির ভাগই পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হয়। এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয় হয় ২০০ লিটারের বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় হয়। এতে উৎপাদন খরচ কমে ২০ শতাংশের মতো। এ ছাড়া ৩-১০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়বে।
ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের কিছু অংশে ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসারে সরকারি বিনিয়োগ দরকার। তিনি আরও বলেন, এডব্লিউডি পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রতিটি পাইপের খরচ ১০০-১৩০ টাকা। এক একর জমিতে তিনটি পাইপ যথেষ্ট।
স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কালীগঞ্জে এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসার ও প্রচারণায় কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবু পদ বিশ্বাস বলেন, আগে কৃষককে বিনামূল্যে পাইপ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন অনেকে নিজেরাই পাইপ কিনে নিচ্ছেন।
ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, দেশে ধানক্ষেত থেকে প্রতিবছর ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস নির্গমন হয় প্রায় ১.৩৯ থেকে ১.৫৬ মিলিয়ন টন। সেচে এডব্লিউডি ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ২৫-৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এ ছাড়া ১০ লাখ হেক্টর জমিকে এডব্লিউডির আওতায় আনা গেলে বেঁচে যাওয়া পানি দিয়ে আরও প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা যাবে।
তবে বৃহত্তর পরিসরে এডব্লিউডি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। ধান বিজ্ঞানী এবং ব্রির সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, সবচেয়ে বড় বাধা, সেচ মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা।
পানি ব্যবহার করলে নলকূপ মালিককে পুরো মৌসুমের অর্থই পরিশোধ করতে হয় কৃষককে। সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে কৃষকরা ব্যবহৃত পানির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে অর্থ দেবেন। এ ছাড়া কৃষকরা প্রায়ই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এই ক্ষেত্রে সরকারি নীতি সংস্কার দরকার।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) রিডুসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রামের অধীনে দেশে এডব্লিউডি কৌশল প্রচারের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশে ইফাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ভ্যালানটাইন আচানচো বলেন, মিথেন গ্যাস নির্গমনের অন্যতম প্রধান উৎস দেশের সেচনির্ভর ধান চাষ। ধানক্ষেতে তৈরি হওয়া অক্সিজেনহীন পরিবেশ মিথেন উৎপাদনকারী অণুজীবের জন্য আদর্শ অবস্থা তৈরি করে। এই অবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করে। তিনি আরও বলেন, রিডিউসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রাম কর্মসূচির মাধ্যমে ইফাদ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে, যাতে সচেতনতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা উন্নয়ন এবং সরকারের ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের তথ্যপ্রমাণভিত্তিক সহায়তা দেয়। এতে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি চর্চার গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করা যায়।