কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা–ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে একতলা ভবনের চারটি কক্ষের আসবাবসহ মালামাল পুড়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার গভীর রাতে উপজেলার গুণবতী ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেনের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।

আলী হোসেন গুণবতী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রী রাশেদা আখতার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। রাশেদার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান মঞ্জু এবি পার্টির চেয়ারম্যান।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলী হোসেন দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে কুমিল্লা শহরে বসবাস করেন। জামশেদ আলম নামের এক ব্যক্তি বাড়িটির দেখভাল করেন। জামশেদ তাঁর তিন শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ওই বাড়িতে থাকেন। মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার পর দুর্বৃত্তরা বাড়িটির দরজা-জানালায় ভাঙচুর চালাতে থাকে। একপর্যায়ে তাঁরা বসতঘরের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। পরে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় জামশেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান এবং আশপাশের বাড়ির মানুষের চিৎকারে গ্রামের লোকজন ছুটে এসে প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভান।

বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জামশেদ আলম বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। কোনো রকমে বাচ্চাগুলোর প্রাণ রক্ষা করেছেন। তাঁদের চিৎকারে আশপাশের মানুষ এসে আগুন নেভান।

বুধবার সন্ধ্যায় রাশেদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তাঁদের বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করে। পরে পেট্রল বা দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ঘরে থাকা সবকিছু পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের হুমকির মুখে আমার স্বামী গ্রামের বাড়িতে যেতেন না। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। আগেও দুষ্কৃতকারীরা একবার বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করেছিল। মঙ্গলবার রাতে আবার হামলা করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কারা হামলা চালিয়েছে, সেটা এখনই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১২ জন। তাঁরা মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেট পরা ছিল।’

রাশেদা আখতারের ভাষ্য, তাঁর স্বামী আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। তিনি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। মুজিবুল হক (চৌদ্দগ্রামের সাবেক সাংসদ) তাঁকে রাজনৈতিকভাবে চৌদ্দগ্রামে দাঁড়াতে দেননি। তাঁর স্বামীর ৫৪ বছরের সংগ্রাম আর সততার ফল এভাবে পাবেন ভাবতেও পারেননি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তিনি এ ঘটনার বিচার চান।

এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হিলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, হামলা ও আগুন দেওয়ার খবর পেয়ে বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। তবে কারা হামলা চালিয়েছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় এখনো কেউ থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। লিখিত অভিযোগ পেলে তাঁরা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ