অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সম্প্রতি হাতে এসেছে। পড়তে গিয়ে মুখ্য সুপারিশমালার ১১ নম্বরে চোখ আটকে যায়। এখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে হাসপাতালের অধীনে নির্দিষ্ট ইউনিটে কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘মেডিকেল পুলিশ’ নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এই ইউনিট জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত; হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা, হুমকি ও সহিংসতা প্রতিরোধ করবে।
গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে মেডিকেল পুলিশের সুপারিশ দুটি বার্তা দেয়। এক.
মেডিকেল পুলিশ ধারণাটি অবশ্য নতুন নয়। উনিশ শতকের শুরুতে জার্মানি ও ফ্রান্সে ‘মেডিকেল পুলিশ’ নামে একটি ইউনিট চালু ছিল। যারা মহামারি নিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন ও টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করত। আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্য পরিদর্শক, কোয়ারেন্টাইন অফিসার বা খাদ্য নিরাপত্তা বাহিনী অনেকটা একই কাজ করে। এমনকি কভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত মাঠে নামে।
স্পষ্টতই মেডিকেল পুলিশের ঐতিহাসিক ধারণা ও কমিশনের প্রস্তাবে ফারাক বিস্তর। যতটুকু বুঝতে পারি, কমিশনের প্রস্তাব হলো, হাইওয়ে পুলিশ, শিল্পাঞ্চল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ কিংবা ট্রাফিক পুলিশের মতো বিশেষায়িত বাহিনী তৈরি করা। অথচ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণাটি হওয়া উচিত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা প্রায়ই জনস্বাস্থ্যকে হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু জনস্বাস্থ্য শুরু হয় তার অনেক আগেই– নিরাপদ খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পরিষ্কার পরিবেশ, ইনজেকশন ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, জীবাণু নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এমনকি ছাদে জমে থাকা পানিতে জন্ম নেওয়া মশার নিয়ন্ত্রণও এর অংশ।
বাংলাদেশের বাস্তবতা দাবি করে এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো যেখানে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক ও আইন প্রয়োগকারী দল হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, খাদ্য প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, ল্যাব ও পরিবেশজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত তদারক ও হস্তক্ষেপ করতে পারে। আজকের দিনে সিঙ্গাপুর, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও পাবলিক হেলথ এনফোর্সমেন্ট ইউনিট এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ইন্সপেকশন টিমের মতো। তবে বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থার কিছু খণ্ডিত অংশ রয়েছে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকারের স্যানিটেশন পরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তর; সবাই কিছু ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তারা সম্পদহীন, সমন্বয়বিহীন এবং সংখ্যায় অপ্রতুল।
এ দেশের পথেঘাটে সিকি-অর্ধশতাব্দী পুরোনো গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় ও বাড়ির পাশে খোলা ড্রেনের আকাশ ভারি করা গন্ধের মতোই মিশে থাকে অসংখ্য অদৃশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি– জলে কলেরা, ফলে-মাছে-খাবারে ফরমালিন, বাতাসে ডেঙ্গু। অন্যদিকে ওষুধের দোকানে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, হাসপাতালের উঠান থেকে বেড পর্যন্ত নানান অমানবিকতা, লোভ ও অনিয়মের আস্ফালন, হোটেল-রেস্টুরেন্টে পচা-দূষিত খাবার, ফসলি মাঠের বুক চিরে জ্বলছে ইটভাটার চিমনি। সব কিছুতেই স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাড়ির বাইরের ঝুঁকি; বাড়ির খাবারের টেবিলে ঝুঁকি, হাসপাতালে ঝুঁকি, ওষুধের দোকানে ঝুঁকি, মাছের বাজার থেকে শুরু করে সবজির বাজারে ঝুঁকি। প্রতিনিয়ত মনে হয়, দেখার কি কেউ নেই? খোঁজ নিয়ে দেখেছি; আইন ও নীতিমালা এবং সরকারি ঘোষণা আছে– তবু কেন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না?
প্রতিটি আধুনিক সমাজের কেন্দ্রে রয়েছে এমন একটি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। একটি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি চিকিৎসা নয়; বরং রোগ প্রতিরোধ, নিয়মনীতি ও তার কঠোর প্রয়োগ। বাংলাদেশে আমরা স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছি। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অগ্রগতিও অনেক– নতুন হাসপাতাল, বেশি সংখ্যক চিকিৎসক, আধুনিক প্রযুক্তি। এমনকি জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক উন্নত আইনও রয়েছে। এমন জনস্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করেছি, যা কাগজ-কলমে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অগ্রগামী। তবুও একটি মূল উপাদান আজও অনুপস্থিত– জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী বাস্তবায়ন কাঠামো ও কার্যকর আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা।
দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত আইন ও সংস্থা। কিন্তু স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বর্তমান বাস্তবতা হলো, নিয়ম লঙ্ঘনের সংস্কৃতি, ওষুধ ও খাদ্যে অনিয়ম, পরিবেশ স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পর্যাপ্ত জনবল ও পরিদর্শকের অভাব। হাসপাতালে ইনফেকশন কন্ট্রোল নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে খুব কমই অনুসরণ করা হয়। ক্লিনারদের গ্লাভস নেই; বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ন্যূনতম সতর্কতা নেই। সারাদেশে এখনও ভুয়া ওষুধ তৈরি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ইনজেকশন বিক্রি হয়। খাদ্যপণ্যে ভেজাল এক অলিখিত নিয়ম। সিটি করপোরেশনগুলো নিয়মিত ফগিং বা মশক নিধন কর্মসূচি চালালেও তা যথাযথ না হওয়ায় ডেঙ্গু প্রতিনিয়ত মহামারির রূপ নেয়। স্বাস্থ্য পরিদর্শক বা পরিবেশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পর্যাপ্ত নেই। যারা আছেন, তাদের ক্ষমতা সীমিত; কাজের পরিধি অস্পষ্ট।
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি মৌলিক অনুপস্থিতি– স্বাস্থ্য আইন প্রয়োগে কার্যকর কাঠামো নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘জনস্বাস্থ্য বাস্তবায়ন সংস্থা’র কাঠামো কেমন হতে পারে? এটি হবে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী। এর কাজের ক্ষেত্রে থাকবে স্বাধীনতা, জবাবদিহি ও জনসম্পৃক্ততা। এ বাহিনী জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য আইন, পরিবেশ বিজ্ঞান ও হেলথ রিস্ক কমিউনিকেশন সম্পর্কে প্রশিক্ষিত। বহুমাত্রিক ক্ষমতার অংশ হিসেবে তারা পরিদর্শন, জরিমানা, বন্ধ করে দেওয়া ও মামলা– এই চারটি কাজ করতে পারবে। এর দায়িত্ব হবে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি ও খাদ্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। তারা সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে, কিন্তু স্থানীয় সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় থাকবে। জনগণের অভিযোগ গ্রহণের জন্য হটলাইন, অ্যাপ বা ওয়েব পোর্টাল থাকবে, যেখানে যে কোনো নাগরিক অভিযোগ জানাতে পারবেন।
এই ব্যবস্থায় ঝুঁকিও রয়েছে। তা হলো, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ সংস্কার প্রয়োজন। যে কোনো বাহিনীর মতোই এটি যদি জবাবদিহির বাইরে চলে যায়, তবে তা হয়রানির কারণ হতে পারে। কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে, তাহলে সেখানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এটি বাস্তবায়নের জন্য আইন সংস্কার, বাজেট বরাদ্দ, জনবল নিয়োগ ও বড় ধরনের প্রশাসনিক প্রস্তুতি দরকার।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে অনেক অর্জন করেছে– টিকাদান, শিশুমৃত্যুহার হ্রাস, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, জনসংখ্যার চাপ, ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণ– সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ।
শুধু চিকিৎসাসেবা দিয়ে এসব রোধ করা সম্ভব নয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগের সমন্বয়ই এখন জরুরি। কিন্তু প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি বড় শূন্যতা রয়ে গেছে– কার্যকর, দায়িত্বশীল ও দৃশ্যমান আইন প্রয়োগ কাঠামো। স্বাস্থ্য বাস্তবায়ন সংস্থা হতে পারে এই শূন্যতা পূরণের এক সম্ভাব্য পথ; যদি তা হয় সুশৃঙ্খল, মানবিক ও নাগরিক অধিকারবান্ধব। ‘জনস্বাস্থ্য বাস্তবায়ন সংস্থা’ সেই বৃহৎ কাঠামোর এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হতে পারে। যতদিন আইন প্রয়োগকারী একটি নিবেদিত ও জবাবদিহিমূলক বাহিনী না থাকবে, ততদিন জনস্বাস্থ্য রক্ষা হবে না।
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ; শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনস ব স থ য স ব স থ য স রক ষ জনস ব স থ য র জনস ব স থ য ব য ব যবস থ ক র যকর পর ব শ র জন য য আইন সরক র ইউন ট
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী
গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।
২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।
মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।
উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।
আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।
প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।
জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”
এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।
জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।
ঢাকা/মেহেদী