বেসরকারি ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নিতে বরাদ্দ থাকছে
Published: 1st, June 2025 GMT
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ব্যাংক খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হতো। তবে এবারে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ জন্য গত ৯ মে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর প্রথম বাজেটে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রাখছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে বাজেটের মাধ্যমে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তারা শেষ দিকে অবশ্য এভাবে বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি আবার ফিরিয়ে আনছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর যেসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, সেগুলোকেই মূলধন সরবরাহের নামে জনগণের করের টাকা দেয়। দেশের ব্যাংক খাতে বড় কেলেঙ্কারিগুলো শুরু হয় মূলত ২০১০-১১ অর্থবছরে।
নতুন ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারাসহ যেকোনো তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেখে যে কোনো ব্যাংক আর কার্যকর নয় বা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই, দেউলিয়া হয়ে গেছে বা দেউলিয়া হওয়ার পথে, আমানতকারীদের পাওনা দিতে পারছে না বা না দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে—তখন এ ধরনের ব্যাংকের কার্যক্রম ভালো করার স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অধ্যাদেশেই বাংলাদেশ ব্যাংককে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছর থেকেই সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিজেই আভাস দিয়েছেন। কাজগুলো করার জন্য যে খরচ হবে, সে জন্যই বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বলে সূত্রগুলো জানায়।
অর্থ বিভাগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ব্যাংক খাতের জন্য বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে? জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, আপাতত রাখা হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে টাকা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে টাকা আরও বাড়বে।
যোগাযোগ করলে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক ব্যাংকের যে পরিস্থিতি হয়েছে, আস্থা ফিরিয়ে আনতে সেগুলোকে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য। কাজটি করতে বাজেটে বরাদ্দ থাকাটাই সংগত। শুনেছি যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে সহায়তা নেওয়া হবে।
ব্যাংক খাতে আগে কেন এত টাকা বরাদ্দ রাখা হতো—এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আহমেদ বলেন, বরাদ্দ রাখা হতো। তবে যত বেশি রাখা হতো, তত ছাড় করা হতো না।
আওয়ামী লীগ সরকার কত দিয়েছিল
২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।
এরপর ২০১২-১৩ থেকে ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়। এসব টাকা দেওয়া হয় কখনো মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ, কখনো মূলধন ঘাটতি বা প্রভিশন ঘাটতি পূরণ, কখনোবা মূলধন পুনর্ভরণের জন্য। এ রকম টাকা পেয়েছে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক। এমনকি বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংককে (বর্তমান নাম পদ্মা ব্যাংক) বাঁচাতেও সরকারি উদ্যোগে দেওয়া হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়ার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রেখে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটির নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘সমমূলধন বিনিয়োগ’।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথমে সোনালী ব্যাংককে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে ১২৫ কোটি টাকা দেয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়নি। তবে ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে দিতে ৩৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যদিও কোনো অর্থ ছাড় করা হয়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ছাড় করা হয় ৫৪১ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ছাড় করা হয় ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সরকারি সিদ্ধান্তে পরে আরও বাড়াতে হয়। সেবার ব্যাংকগুলোকে শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে পুরোটা দেওয়া হয়। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।
বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক আমলেও বরাদ্দ ছিল
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এ রকম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ১৭২ কোটি ৭৮ লাখ, কৃষি ব্যাংককে ৬০ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) ৩০ কোটি টাকা দেয় বিএনপি সরকার। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কাউকে কোনো অর্থ দেয়নি। তবে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ৪০০ কোটি, কৃষি ব্যাংককে ৫০ কোটি এবং রাকাবকে ৪০ কোটি টাকা দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৮-০৯ অর্থবছরের অর্ধেক সময় তত্ত্বাবধায়ক ও বাকি অর্ধেক সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বাস্তবায়ন করে। ওই অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে কৃষি ব্যাংক ৫৫০ কোটি ও রাকাব ৩৫০ কোটি টাকা পায়। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে মহাজোট সরকার শুধু সোনালী ব্যাংককে ১২৫ কোটি টাকা দেয়।
সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জানতে চাইলে ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে আগে বরাদ্দ দেওয়া হতো মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য। আর সরকারের এবারের উদ্যোগ হচ্ছে ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে আনিস এ খান বলেন, আমানতকারীদের অধিকার যেন খর্ব না হয় এবং তাঁরা যেন নিজেদের টাকা ফেরত পান—এটাই উদ্দেশ্য। তবে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানির অবস্থাও ভালো নয়। এ ব্যাপারেও সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য ব জ ট অর থ ব ভ গ বর দ দ র খ বর দ দ র ব ল গ সরক র র ব পর ত সরক র র ছ ড় কর আওয় ম প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা নিয়ে নির্দেশনা মাউশির, কে কত টাকা পাবেন
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে কোন গ্রেডের শিক্ষকেরা বিশেষ সুবিধা পাবেন বা বিশেষ সুবিধা বাবদ কত শতাংশ হারে টাকা পাবেন, তা জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫গতকাল বুধবার মাউশির অফিস আদেশে বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মাদ্রাসা ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাতীয় বেতন স্কেলের তুলনীয় গ্রেড-৯ থেকে তদূর্ধ্ব (ওপরের) গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই প্রাপ্য মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন। এ ছাড়া গ্রেড-১০ থেকে তদনিম্ন (নিচের) গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই প্রাপ্য মূল বেতনের ১৫ শতাংশ হারে, তবে ১ হাজার ৫০০ টাকার কম নয়, ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন। এই গ্রেডের শিক্ষকেরা ‘বিশেষ সুবিধা’র ক্ষেত্রে কেউই ১ হাজার ৫০০ টাকার কম পাবেন না।
আরও পড়ুনআমেরিকার ফুলব্রাইট বৃত্তি: আবেদনের সময় বৃদ্ধি, প্রয়োজন টোয়েফলে ৮০ কিংবা আইইএলটিএসে ৭৫ ঘণ্টা আগেদেশে এখন ২২ হাজার ১৭৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৮ জনের মতো।