এভারেস্টে আরোহণ: শেরপাদের জীবনের ঝুঁকি যেখানে প্রতি পদক্ষেপে
Published: 7th, June 2025 GMT
বহুদিন ধরেই ‘অতিমানবীয়’ গাইড (পথপ্রদর্শক) ও পোর্টার (বাহক) হিসেবে চিত্রিত হলেও, শেরপারা পর্বতে অনেক ঝুঁকি ও বিপদের মুখোমুখি হন। তাঁরা ধীরে ধীরে এখন নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলছেন—তাঁদের কাজটা কি আরও নিরাপদ করা সম্ভব?
‘এভারেস্ট বেস ক্যাম্প’–এ রেডিও একবার আওয়াজ করে থেমে গেল। দায়িত্বপ্রাপ্ত বেস ক্যাম্প নেতা দোর্চি শেরপা সেটি কানে চেপে ধরলেন। আরও কোনো বার্তা শোনার চেষ্টা করছেন। তাঁবুর বাইরে বিশাল হিমালয়ের অবয়ব ভোরের আকাশ ছুঁয়ে আছে। পাথুরে ভূমিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অভিযাত্রীদের তাঁবুগুলো ২২ মে সকালের ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। ২০২৪ সালের বসন্তের পর্বতারোহণ মৌসুমের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল দিন এটি।
‘শেষ বার্তাটা যখন শুনি, আমার বুক কেঁপে ওঠে’, বলেন দোর্চি। স্মৃতিচারণকালে তাঁর মুখ হয়ে পড়ে গম্ভীর। বলেন, ‘আবহাওয়া ছিল একেবারে পরিষ্কার, কিন্তু সেখানে কিছু একটা নিশ্চিতভাবে গড়বড় হয়েছিল।’
চিরুয়িওট কিরুই নামের একজন কেনীয় পর্বতারোহীকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ৪৪ বছর বয়সী গাইড নাওয়াং শেরপা। তাঁরই পাঠানো একাধিক বিপদের বার্তার মধ্যে এটি ছিল সর্বশেষটি।
সেদিনের এ করুণ ঘটনার মধ্য দিয়ে এক দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত বাস্তবতা সামনে আসে। এভারেস্টে কাজ করা লোকজনের মতে, শেরপারা প্রতিনিয়ত মারাত্মক ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন। হিমালয়ের এই গাইড ও বাহকদের অনেকেই ‘অতিমানব’ বলে ভুলভাবে বর্ণনা করেন; যেন উচ্চতা, পরিশ্রম বা অক্সিজেনের ঘাটতি কিছুই তাঁদের ছুঁতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা এবং অভিযাত্রী, চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার জানাচ্ছে, তাঁদের কিংবদন্তিতুল্য সাফল্য আসে বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে।
তাহলে ২২ মে ২০২৪ তারিখ ঠিক কী ঘটেছিল? আর এ ঘটনাই–বা শেরপাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিয়ে বড় বড় সংকটের ব্যাপারে কীসের ইঙ্গিত দেয়?
‘ক্লায়েন্টের শরীর ভালো নেই’
এভারেস্টে ঘটে যাওয়া বেশির ভাগ মর্মান্তিক ঘটনার মতোই এটিরও সূচনা হয়েছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে এবং গাইডের দিক থেকে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে।
নেপালের একটি ট্রেকিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন নাওয়াং শেরপা। তিনি ও কিরুই একসঙ্গে এভারেস্টের চূড়ার দিকে আরোহণ শুরু করেন। ‘শেরপা’ শব্দটি এখন হিমালয়ের যেকোনো উচ্চতায় আরোহণের গাইড বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও, এটি মূলত নেপালের পার্বত্য পূর্বাঞ্চলের একটি জাতিগোষ্ঠীকে বোঝায়। এ প্রতিবেদনে যাঁদের নামের সঙ্গে ‘শেরপা’ যুক্ত আছে, তাঁরা সবাই সেই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য এবং পাশাপাশি পেশাগতভাবে গাইডও। পর্বতারোহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই শেরপারা এভারেস্টে সবচেয়ে ভারী বোঝা বহন করে আসছেন—প্রথমে ঔপনিবেশিক শাসনামলের অভিযাত্রী ও পরে পর্যটকদের জন্য।
দোর্চি শেরপার ভাষ্যমতে, পরের দুই ঘণ্টা নাওয়াংয়ের অনুরোধ সত্ত্বেও কিরুই অক্সিজেন নিতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। উচ্চতাজনিত অসুস্থতার লক্ষণ, যেমন বিভ্রান্তি ও অস্পষ্ট বাক্যালাপ সত্ত্বেও এই পর্বতারোহী কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আরোহণ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এ অচলাবস্থা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। দুজনই এভারেস্টে মারা যান। তাঁদের দেহ এখনো সেখানেই রয়েছে।কিরুই একটি বিরল অভিযাত্রীদের দলে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। এই দলের সদস্যরা বাড়তি অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান। ‘হিমালয়ান ডেটাবেস’ অনুযায়ী, ১৯৫৩ সালে প্রথমবার এভারেস্ট জয় করার পর থেকে মাত্র প্রায় ২ শতাংশ সফল অভিযাত্রা এভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
অভিযানের আগে কিরুই তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে এ ‘নিখাঁদ’ আরোহণ প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, অতীতে অন্যান্য পর্বতেও অক্সিজেন ছাড়াই আরোহণ করেছিলেন তিনি। কৃত্রিম সহায়তা ছাড়াই এবার এভারেস্ট জয় করাটা তাঁর মতো অভিজ্ঞ অভিযাত্রীর জন্য ছিল এক নতুন রোমাঞ্চকর বিষয়।
এভারেস্টে আরোহণ শুরু করার পর সংকটময় মুহূর্তে কিরুইকে অক্সিজেন নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এটি কিরুইয়ের ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত ছিল কি না, যেমনটা তাঁর ঘোষিত লক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল; নাকি উচ্চতার প্রভাবে তাঁর বিবেচনাশক্তি তখন ভেঙে পড়েছিল—স্পষ্ট নয়।
বেস ক্যাম্পের ব্যবস্থাপক দোর্চি শেরপা যখন নাওয়াংয়ের কাছ থেকে রেডিও বার্তা পান, তখন তাঁরা ৮ হাজার ৮০০ মিটার (২৮ হাজার ৮৭১ ফুট) উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। এ উচ্চতাকে পর্বতারোহীরা ‘ডেথ জোন’ বা মৃত্যু এলাকা বলেন। এখানে মানুষের শরীর ধীরে ধীরে বিকল হতে শুরু করে। এই উচ্চতায় বায়ুচাপ সমুদ্রপৃষ্ঠের এক-তৃতীয়াংশ এবং প্রতিটি ক্লান্তিকর শ্বাসে শরীরের প্রাথমিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখার মতো অক্সিজেন পাওয়া যায় না।
‘ক্লায়েন্টের শরীর ভালো নেই’, সকাল ৮টা ৭ মিনিটে ভেসে এল নাওয়াং শেরপার কণ্ঠস্বর। বাতাসের ঝাপটায় কথাগুলো ভেঙে ভেঙে আসছিল দোর্চির কাছে, বেস ক্যাম্পে।
‘অক্সিজেন’—সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন দোর্চি শেরপা। ‘তাঁকে অক্সিজেনে রাখো এবং নিচে নামতে শুরু করো।’
দোর্চির মতে, নাওয়াং কয়েক মিনিট ধরে কিরুইকে অনুরোধ করেছিলেন, যেন তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে বাড়তি অক্সিজেন গ্রহণ করেন। কিন্তু কিরুই প্রত্যাখ্যান করেন। দোর্চি বলেন, কিরুই উত্তেজিত হয়ে বারবার বলেন, ‘না, অক্সিজেন নয়, অক্সিজেন নয়। নিখাঁদ চূড়া জয়ই আমার লক্ষ্য।’
সকাল ৯টা ২৩ মিনিটে আবারও রেডিওতে নাওয়াং শেরপার কণ্ঠ ভেসে ওঠে। এবার তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগের জায়গায় ভয়, ‘আমি তাঁকে সরাতে পারছি না’। তিনি (কিরুই) রেগে যাচ্ছেন। আমি একা তাঁকে নিচে নামাতে পারছি না।’
দোর্চি শেরপার ভাষ্যমতে, পরের দুই ঘণ্টা নাওয়াংয়ের অনুরোধ সত্ত্বেও কিরুই অক্সিজেন নিতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। উচ্চতাজনিত অসুস্থতার লক্ষণ, যেমন বিভ্রান্তি ও অস্পষ্ট বাক্যালাপ সত্ত্বেও এই পর্বতারোহী কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আরোহণ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
এ অচলাবস্থা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। দুজনই এভারেস্টে মারা যান। তাঁদের দেহ এখনো সেখানেই রয়েছে। কেনীয় পর্বতারোহীর দেহ তাঁকে সর্বশেষ যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই রয়েছে আর নাওয়াংয়ের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শেষ মুহূর্তগুলোতে ঠিক কী ঘটেছিল, তা পরিষ্কার নয়। সম্ভাবত, আমরা তা কোনোদিনই জানতে পারব না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ যাত্রা সবাই সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করেছিলেন। কিরুইয়ের প্রেমিকা নাখুলো খাইমিয়া এ ভ্রমণকে তাঁর (কিরুই) বহুদিনের লালিত স্বপ্ন হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যার জন্য তিনি যত্নের সঙ্গে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
‘এ যাত্রার জন্য সে (কিরুই) তার সময়, শক্তি ও পুরো জীবনযাপন পদ্ধতি উৎসর্গ করেছিল’, বলেন নাখুলো। বলেন, ‘তার জীবনযাপন এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতিকে ঘিরে আবর্তিত হতো। তার যাত্রা ছিল উদ্দেশ্যমূলক, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও একান্তই ব্যক্তিগত।’
আমি মনে করি না, নাওয়াং শেরপা বেপরোয়া বা বোকামির কিছু করেছিলেন। তিনি ঠিক তা-ই করেছেন, যা আমাদের সবাইকে শেখানো হয়েছে—তা হলো, শেষ পর্যন্ত দায়িত্ববান থাকা। ট্র্যাজেডি শুধু এই নয় যে তিনি মারা গেছেন; বরং এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পেশাগত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।সানু শেরপা, নেপালি গাইডজেমস মুহিয়া এভারেস্ট অভিযানে না থাকলেও কিরুইয়ের সঙ্গে অক্সিজেন ছাড়া অন্য একটি পর্বত আরোহণ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর বিশ্বাস, কিরুই জরুরি অবস্থার জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে রেখেছিলেন। কিরুই সেটি ব্যবহার করেছিলেন কি না, তাঁরা নিশ্চিত নন।
অন্যদিকে, নাওয়াং ছিলেন একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী গাইড। তিনি আগে কখনো এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেননি। তবে হিমালয়ের অন্যান্য উঁচু শৃঙ্গ তিনি জয় করেছিলেন বলে জানায় তাঁর পরিবার। যাঁরা পর্বতে কাজ করেন, তাঁরা সতর্ক করে বলেন, শেরপারা নানা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করেন। এসব পরিবেশসহ একাধিক কারণ এমন মরণসংকুল পরিস্থিতিগুলো বিশেষভাবে জটিল এবং সেসবের সমাধান করা কঠিন করে তোলে।
‘নাওয়াংয়ের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’
সানু শেরপা একজন অভিজ্ঞ গাইড। ৮ হাজার মিটার (২৬ হাজার ২৪৭ ফুট) উচ্চতার ১৪টি শৃঙ্গের সব দুবার আরোহণকারী একমাত্র ব্যক্তি তিনি। তাঁর মতে, নাওয়াং শেরপার মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি উঁচু পর্বত আরোহণের পূর্বানুমেয় ধারা।
সানুর কাঠমান্ডুর ফ্ল্যাটে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তখন একটি আট হাজার মিটার উঁচু শৃঙ্গে তাঁর ৪৫তম আরোহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বলেন, ‘আমি মনে করি না, নাওয়াং বেপরোয়া বা বোকামির কিছু করেছিলেন। তিনি ঠিক তা–ই করেছেন, যা আমাদের সবাইকে শেখানো হয়েছে—তা হলো, শেষ পর্যন্ত দায়িত্ববান থাকা। ট্র্যাজেডি শুধু এই নয় যে তিনি মারা গেছেন; বরং এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পেশাগত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।’
‘এভারেস্ট ও হিমালয়ের অন্যান্য উঁচু শৃঙ্গগুলোতে প্রতিবছর শেরপাদের ঘিরে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেগুলো সাধারণত লোকজনের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়’, বলেন সানু শেরপা। বিদেশি পর্বতারোহীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে শেরপাদের এমন ত্যাগের তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে বলে জানান তিনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, শেরপা গাইডদের কাজের ক্ষেত্রে অনেক রকম প্রত্যাশা থাকে, যা একসঙ্গে মিলে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় কঠোর পরিশ্রম করতে গিয়ে তাঁরা বড় বিপদের মধ্যে পড়েন। তাঁরা অনেক সময় এমন পরিস্থিতিতে থাকেন, যেখানে একদিকে থাকে অভিযাত্রীকে সাহায্য করার দায়িত্ববোধ, অন্যদিকে ভালো চাকরি পেতে খ্যাতি অর্জনের চাপ। সঙ্গে থাকে পাহাড়ে কাজ করার জীবন–মরণ ঝুঁকি। এ অবস্থায় তাঁরা অনেক সময় নিজেদের নিরাপত্তার চেয়ে ক্লায়েন্টদের (অভিযাত্রী) খুশি করাকেই বেশি গুরুত্ব দেন।
আরও পড়ুনএভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া ৯ বিখ্যাত অভিযাত্রীর গল্প ২৭ মে ২০২৪ওই দুর্ঘটনা দেখিয়ে দেয়, ক্লায়েন্টের সঙ্গে যেতে রাজি হলে শেরপারা, যেমন নাওয়াং, কত বড় ঝুঁকি নেন।
এভারেস্টে গাইড বা পোর্টার হিসেবে কাজ করা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি থেকে আসা মানুষের জন্য বিরল অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু এ পেশায় এমন ধরনের ত্যাগ চাওয়া হয়, যা অন্য কোনো সেবামূলক পেশায় দেখা যায় না—এখানে কর্মীরা প্রায়শ ক্লায়েন্টদের জন্য নিজেদের ভালোমন্দ ত্যাগ করেন। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন শেরপারাই গল্প থেকে হারিয়ে যান।
‘হিমালয়ান ডেটাবেস’ অনুসারে, এভারেস্টে এখন পর্যন্ত ১৩২ জন শেরপা মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে গত ১০ বছরে মারা গেছেন ২৮ জন। কেউ বরফের গভীর ফাটলে পড়ে গেছেন, কেউ বিশাল বরফস্তম্ভের নিচে চাপা পড়েছেন, আবার কেউ কেউ ক্লায়েন্টের খেয়াল রাখতে গিয়ে পর্বতের অজানা স্থানে হারিয়ে গেছেন।‘হিমালয়ান ডেটাবেস’ অনুসারে, এভারেস্টে এখন পর্যন্ত ১৩২ জন শেরপা মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে গত ১০ বছরে মারা গেছেন ২৮ জন। কেউ বরফের গভীর ফাটলে পড়ে গেছেন, কেউ বিশাল বরফস্তম্ভের নিচে চাপা পড়েছেন, আবার কেউ কেউ ক্লায়েন্টের খেয়াল রাখতে গিয়ে পর্বতের অজানা স্থানে হারিয়ে গেছেন।
বিদেশি পর্বতারোহীরা এমন বিপদগুলো হয়তো নিজেদের ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঝুঁকি বলে মনে করেন। কিন্তু এভারেস্টে কাজ করা গাইড ও পোর্টারদের জন্য ঝুঁকির পরিসংখ্যান ভয়ানক সব বাস্তবতাই তুলে ধরে। অঙ্কের হিসেবে প্রতি ১০০ জনে ১ দশমিক ২ জন শেরপা মারা যান তাঁদের কাজ করতে গিয়ে। পেশাগত মানদণ্ডে এ এক চরম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা।
আরও পড়ুন৩১ বার এভারেস্ট জয় করে রেকর্ড গড়লেন পঞ্চাশোর্ধ্ব কামি রিতা২৭ মে ২০২৫আগে শেরপাদের জীবনের ঝুঁকিকে ছোট করে দেখানো হতো। বিদেশিরা শেরপাদের শক্তি ও সহনশীলতাকেই তুলে ধরতেন। কিন্তু এখন শেরপারা নিজেরাই এমন চিত্রায়নকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছেন।
প্রথম নেপালি নারী হিসেবে ৮ হাজার মিটার উঁচু ১৪টি পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন দাওয়া শেরপা। তিনি বলেছেন, শেরপাদের অতিমানবীয় ক্ষমতা আছে, এমন ধারণা খুব বিপজ্জনক। তিনি দেখেছেন কীভাবে শারীরিকভাবে ক্লান্ত শেরপা গাইডরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লায়েন্টদের সহায়তা করেন, অনেক উঁচুতে খাবার তৈরি করেন, এমনকি ক্লায়েন্ট যেন আরও ওপরে উঠতে পারেন, সেজন্য নিজেদের অক্সিজেনও ভাগ করেন।
‘তাঁরা কোনো অতিমানব নন,’ বলেন দাওয়া শেরপা। ‘শেরপারা অনেক সময় নিজেদের সুরক্ষার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে অন্যের চূড়ায় ওঠার লক্ষ্যকে প্রাধান্য দেন। আমি দেখেছি, তাঁরা অনেক সময় আঙুল খুইয়ে বা অক্সিজেনের ঘাটতি নিয়ে ফিরে আসেন। আর তা শুধুই অন্যের জন্য নিজের নিরাপত্তা ত্যাগ করে।’
দাওয়া শেরপা উল্লেখ করেন, ধনাঢ্য পর্বতারোহীরা কখনো কখনো একটি অভিযানের জন্য একাধিক শেরপা ভাড়া করেন এবং নামার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে শারীরিকভাবে সহায়তা প্রত্যাশা করেন। এ রকম পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক করে তোলে তাঁদের (শেরপা) জন্য। কেননা, তাঁরা আগে থেকেই ভারী বোঝা বহন করেন।
আরও পড়ুনএভারেস্টে পাওয়া শত বছর আগের পায়ের খণ্ডাংশটি কার ১৩ অক্টোবর ২০২৪অসম ক্ষমতায়ন
বিবিসির সঙ্গে কথা বলা শেরপারা বারবার ফিরে যান একটি মূল সমস্যার দিকে। তা হলো, ক্ষমতার ব্যাপক অসম ভারসাম্য, যেমন গাইডরা প্রায়ই ক্লায়েন্টদের বিপজ্জনক অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না, এমনকি সেটা তাঁদের নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করলেও। কারণ এতে কাজ হারানোর এবং উপার্জন না হওয়ার ভয় থাকে।
‘শেরপারা খ্যাতি বা গৌরবের জন্য পর্বতারোহণ করেন না। না করেন, কোনো কৃতিত্বের জন্য। তাঁরা পর্বতে ওঠেন, কারণ এটা অনেক সময় তাঁদের জীবিকার একমাত্র উপায়’, বলেন নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের (এনএমএ) সভাপতি নিমা নুরু শেরপা।
‘তাঁরা কোনো অতিমানব নন। শেরপারা অনেক সময় নিজেদের সুরক্ষার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে অন্যের চূড়ায় ওঠার লক্ষ্যকে প্রাধান্য দেন। আমি দেখেছি, তাঁরা অনেক সময় আঙুল খুইয়ে বা অক্সিজেনের ঘাটতি নিয়ে ফিরে আসেন। আর তা শুধুই অন্যের জন্য নিজের নিরাপত্তা ত্যাগ করে।দাওয়া শেরপা, নেপালি গাইডএদিকে শেরপাদের নিজের অসাধারণ অর্জনগুলো খুব কমই মনোযোগ পায়। গত মে মাসে নেপালি শেরপা কামি রিতা এভারেস্টে সর্বাধিকবার ওঠার নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙেন। ওই সময় ৩১তম বার বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেন তিনি।
সানু শেরপা বলেন, তাঁর নিজের অর্জনগুলোও নেপালের ভেতর খুব একটা স্বীকৃতি পায় না। অথচ বিদেশি পর্বতারোহীদের তুলনামূলক ছোট ছোট সাফল্যও অনেক বেশি প্রশংসা কুড়ায় ও আর্থিক পুরস্কার পায়।
নিচু উচ্চতায়ও লুকিয়ে আছে বিপদ
নেপালের পর্বতকর্মীদের স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ শুধু বেস ক্যাম্পের ওপরে সংকটময় মুহূর্তেই দেখা দেয় না; বরং দৈনন্দিন শারীরিক ধকলটা শুরু হয় অনেক নিচ থেকেই এবং তা বছরের পর বছর জমতে থাকে।
‘৪ হাজার মিটারের (১৩ হাজার ১২৩ ফুট) ওপরে লম্বা সময় থাকলে দীর্ঘমেয়াদি মাউন্টেন সিকনেস হতে পারে’, বলেন চিকিৎসক ঘিমির। ‘এটি মারাত্মক তিনটি উপসর্গ রূপে দেখা দেয়—পলিসাইথিমিয়া, যেখানে রক্ত অস্বাভাবিকভাবে ঘন হয়ে যায়; পালমোনারি হাইপারটেনশন, যেখানে ফুসফুসের মধ্যে চাপ বেড়ে যায় এবং ক্রনিক হাইপোক্সিয়া, অর্থাৎ রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে কম থাকে।’
আরও পড়ুনএক সপ্তাহে এভারেস্ট জয় কি সত্যিই সম্ভব৩০ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ক সময় কর ছ ল ন জন য ন জ র পর ব র লক ষ কর ছ ন প শ গত লক ষ য অন য র ক জ কর প রস ত অন র ধ র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে চামড়ার দাম পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরা
২ / ৭বিক্রি জন্য চামড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।