বিএনপির ‘না’ও ইশরাকের ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’
Published: 7th, June 2025 GMT
দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক বাহাস হয়েছে। কেউ বলেছেন, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। কেউ বলেছেন, সবার আগে বিচার।
গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ দেবে বলেও জানান তিনি।
এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের একটা সময়সীমা পাওয়া গেল বটে। কিন্তু রাজনৈতিক যে বিতর্কের অবসান হলো বলে মনে হয় না। যেদিন প্রধান উপদেষ্টা এই ঘোষণা দিলেন, সেদিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটি বৈঠক করে জানিয়ে দিল, জনগণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের জন্য এপ্রিল উপযুক্ত সময় নয়। নির্বাচন ডিসেম্বরে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ “জুলাই সনদ” তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারব। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটাকে বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ দিতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সব রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’
নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়তে হলে তো অংশীজনদের আস্থায় আনতে হবে। তাদের কাছে জাতীয় ঐকমত্য ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশমান সংস্কৃতির চেয়ে নির্বাচনী হিসাবনিকাশই বড়। ঈদের সময় বিভিন্ন দলের নেতারা সম্ভাব্য নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের খুব কমই ঢাকায় আছেন। তাঁরা ঈদ ও ভোটের মৌসুমেই এলাকাবাসীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন। এদের বেশির ভাগই ‘অনাবাসিক’ জনপ্রতিনিধি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.
খেলাফত মজলিস প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এবি পার্টি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রতি আস্থা রাখার কথা বলেছে। গণসংহতি আন্দোলনও বলেছে, তাঁর ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, তারিখ ঘোষনায় একটা উদ্বেগ কেটেছে। কিন্তু ডিসেম্বরে নির্বাচন হলো সমস্যা কী ছিল?
এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারেনি বিএনপি। তাদের মতে, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে একদিকে আবহাওয়ার সংকট এবং অন্যদিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বিএনপির অভিযোগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা বললেও একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত অগ্রাহ্য করে নিজেদের নিরপেক্ষতাকেই যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে দেশের জনগণ সঙ্গতভাবেই শঙ্কিত হতে পারে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। জামায়াত এপ্রিলের কথা বলেছিল। শেষ পর্যন্ত জামায়াতের কথাই সরকার মেনে নিল। এটাও বিএনপির ক্ষোভের কারণ।
চট্টগ্রামে বন্দর ও রাখাইনে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর মানিবক চ্যানেল স্থাপনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, এই দীর্ঘ ভাষণে তিনি বন্দর, করিডর ইত্যাদি এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা তাঁরই ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের ৩টি ‘ম্যান্ডেটের’ মধ্যে পড়ে না। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে শব্দচয়ন রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।
এখানে স্পষ্ট যে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে যুদ্ধাবস্থা কাটিয়ে ওঠার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। আর বিএনপির মতে, যত দিন যাবে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। তখন সরকারের পক্ষে নির্বাচন করাই সম্ভব হবে না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য বাংলাদেশ করিডর দিয়ে দিয়েছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাকে ‘সর্বৈব মিথ্যা’ বলে ভাষণে উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসভ্য কল্পকাহিনি বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।
রাখাইনে মানিক চ্যানেল প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রস্তাব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। কিন্তু বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।
সরকার অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর ও রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের মতো বিষয়ে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি।
এখন রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য যারা সমালোচনা করছেন, তাদের যদি সরকার বিভ্রান্তিসৃষ্টিকারী হিসেবে গালমন্দ করে, সেটা নির্বাচনাকূল পরিবেশ তৈরি করবে না। রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের বিষয়ে মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ব্যাংকক বৈঠকে মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রী ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফেরত নেওয়া দূরের কথা, আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে উল্লেখ করে বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নানামুখী অপপ্রচারে লিপ্ত।
এই সংকট মোকাবিলায় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু, বাস্তবে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে চায়, এ রকম কোনো উদ্যোগ নেই। কেবল নির্বাচনের তারিখ নয়, আরও অনেক বিষয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
যেদিন তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, সেদিনই ঈদগাহ মাঠ পরিদর্শন করে বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেন ঘোষণা দিলেন, ‘নগর ভবনে কোনো প্রশাসক বা উপদেষ্টা বসতে পারবেন না। সেখানে যদি কোনো ধরনের প্রশাসনিক সমস্যা হয়, তাহলে ৭৫ ওয়ার্ড থেকে যাঁরা সাবেক কমিশনার ও কাউন্সিলর ছিলেন, ভোটার, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালদের নিয়ে আমরা প্রয়োজনে বিপ্লবী ঢাকা কাউন্সিল গঠন করে সাময়িকভাবে নিয়োগ দিয়ে নগর ভবন চালাব। কিন্তু এখান থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।’
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান সিটি করপোরেশন ভবন তিন সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ। রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনের সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও যুক্ত হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় ঢাকার লাখ লাখ বাসিন্দা দৈনন্দিন সেবা থেকেও বঞ্চিত। অথচ সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের পক্ষ থেকে।
তাহলে কি আমরা দেশে দুটি ‘সরকার’ পেতে যাচ্ছি? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য ইশরাক ঘোষিত ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাইরে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকার যদি একটি সিটি করপোরেশের অচলাবস্থা দূর না করতে পারে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জট খুলবে কীভাবে?
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র জন ত ক ক উন স ল প রস ত ব সরক র র ব এনপ র করপ র শ ঐকমত য বল ছ ন র খ ইন র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে। এটা করতে না পারলে সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সম্ভব নয়। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির’ আয়োজনে ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, সব সংস্কারের উদ্দেশ্য একটাই, দেশে যেন আরেকটা ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে পুলিশ ছিল একটা দানবীয় বাহিনী। পুলিশের এই ভাবমূর্তির জন্য বিদ্যমান ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থা দায়ী উল্লেখ করে আলোচকেরা বলেন, পুলিশ সদস্যদের একটা বড় অংশ সংস্কার চায়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাধার কারণে পুলিশ সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও কিছু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন।
আলোচকেরা বলেন, শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়েছিলেন। গুম-খুন ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। এসব অপরাধে জড়িয়ে পুলিশ আজ আস্থার সংকটে পড়েছে। নৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে। গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র পথ ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ নির্বাচন। বর্তমান পুলিশ দিয়ে সেটি সম্ভব কি না, সেই শঙ্কা প্রকাশে কথা বলেন তাঁরা।
অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক ছিলেন দৈনিক আমার দেশ–এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ যেন ফিরে না আসে, সে জন্য গণতন্ত্রের উত্তরণ করতে হবে। উত্তরণের রাস্তাটা কী? একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন যদি করতে হয়, আমি কি পুলিশ ছাড়া করতে পারব? দ্যাটস আ বিগ চ্যালেঞ্জ।’
সস্প্রতি পটিয়া থানা ঘেরাও করে ওসিকে সরাতে বাধ্য করা এবং পাটগ্রাম থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম যদি ঘটতে থাকে, আমি এই ডিমোরালাইজ পুলিশ দিয়ে কীভাবে একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করব?’
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ও এর ফলাফল নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন প্রতিদিন মিটিং করছে, আসলে জানি না এটার রেজাল্ট কী হবে। অন্তত একটা তো চাই, আমরা আপনারা একটা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন। আর সেটা তৈরি করতে হলে পুলিশের মনোবল অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।’
র্যাবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের সমালোচনা করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘র্যাবে একটা ফান্ডামেন্টাল উইকনেস আছে। র্যাবে সামরিক কর্মকর্তা ঢোকানো একটা মিসটেক। এর ফলে দুটি বাহিনীর সর্বনাশ করেছেন আপনারা। আপনারা পুলিশেরও সর্বনাশ করেছেন, সামরিক বাহিনীরও সর্বনাশ করেছেন। সামরিক বাহিনী র্যাবে ঢুকে করাপটেড হয়েছে, ক্রিমিনাল হয়েছে। এর ফলে সামরিক বাহিনীতেও রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। পুলিশের মধ্যে সামরিক বাহিনী নিয়ে আসা ওয়াজ আ রং কনসেপ্ট।’
অনুষ্ঠানে বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এ দেশে পুলিশের ও আমলার সফলতার কোনো শেষ নাই। কিন্তু তাদের বিফলতা অনেক। তারা বছরের পর বছর সফলতা দেখাচ্ছে, কিন্তু গত ১৭ বছর তাদের ভূমিকা ছিল একদলীয়।’
বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি মো. আব্দুর রহমান খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা। তিনি বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে মানুষের যে আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল, তার বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের কথা। সেখানে কী হচ্ছে এটাই আমরা জানতে পারছি না।’
মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, সেনাবাহিনী ক্ষণিকের জন্য পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু কোনোমতেই আর্মি সেটা রিপ্লেস করতে পারে না। পুলিশের কাজটা পুলিশকেই করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সেনাবহিনী সিভিলিয়ান পাওয়ারে রিপ্লেস হচ্ছে মানে এটা পুলিশের ব্যর্থতা। এটা কখনোই কোনো দেশের জন্য, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুসংবাদ নয়। এভরি টাইম মিলিটারি ডিপ্লয়েড ইন দ্য ফেলিওর অব পুলিশ।’
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাজের ধরন আলাদা মন্তব্য করে ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমাদের ট্রেনিংয়ের মোটো ওয়ান বুলেট ওয়ান ম্যান। পুলিশের তো বুলেটই ইউজ করা উচিত না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, পুলিশ সংস্কারের আলোচনা খুব বিলম্বিত। পুলিশ বিভাগ স্বয়ং সংস্কারটি চায়, সেখানে ঐকমত্যে কমিশনের সুপারিশে বিষটি যায়নি। যত দূর জানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে বাধাটা। তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে প্রস্তাবগুলো পাঠিয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কী অ্যাড্রেস করা হয়েছে। যেখানে পুলিশ বাদ যাচ্ছে, তাহলে এ আলোচনার মানে কী। অল আর অ্যারেঞ্জ শো।’ তাঁর ভাষ্য, ‘সারাক্ষণ গল্প আর গোলটেবিল বৈঠক দিয়ে কিছু হবে না। এ জাতি ধ্বংস হয়েছে বৈঠকের কারণে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করি না। বিদ্যমান যে আইনগুলো আছে সেসবের সঠিক প্রয়োগ করে ইমপ্রুভমেন্টের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে আবার আমি আইন পরিবর্তনের কথা বলি।’ তিনি বলেন, একটা অদ্ভুত কারণে পুলিশ আইনে পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) রয়ে গেছে। দেশের কোনো আইনের সঙ্গে বেঙ্গল শব্দটি নাই। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে বেঙ্গলটা রাখা হয়েছে গর্বভরে। সেখানে অনেক সংশোধন এসেছে, কিন্তু বেঙ্গল শব্দটি রেখে দিয়েছে, কারণ সাকসেস সরকার ঔপনিবেশিক মনোভাবটা রাখতে চান।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য জারিফ রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে পুলিশ সংস্কারকে বাদ দেওয়া জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে এক ধরনের বেইমানি। খেলাফতে মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, পুলিশকে কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য পুলিশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি এম আকবর আলী সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ হলো, ঔপনিবেশিক আইন ও কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এস এম জহিরুল ইসলাম।