দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক বাহাস হয়েছে। কেউ বলেছেন, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। কেউ বলেছেন, সবার আগে বিচার।

গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ দেবে বলেও জানান তিনি।

এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের একটা সময়সীমা পাওয়া গেল বটে। কিন্তু রাজনৈতিক যে বিতর্কের অবসান হলো বলে মনে হয় না। যেদিন প্রধান উপদেষ্টা এই ঘোষণা দিলেন, সেদিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটি বৈঠক করে জানিয়ে দিল, জনগণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের জন্য এপ্রিল উপযুক্ত সময় নয়। নির্বাচন ডিসেম্বরে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ “জুলাই সনদ” তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারব। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটাকে বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ দিতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সব রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’

নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়তে হলে তো অংশীজনদের আস্থায় আনতে হবে। তাদের কাছে জাতীয় ঐকমত্য ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশমান সংস্কৃতির চেয়ে নির্বাচনী হিসাবনিকাশই বড়। ঈদের সময় বিভিন্ন দলের নেতারা সম্ভাব্য নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের খুব কমই ঢাকায় আছেন। তাঁরা ঈদ ও ভোটের মৌসুমেই এলাকাবাসীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন। এদের বেশির ভাগই ‘অনাবাসিক’ জনপ্রতিনিধি।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.

শফিকুর রহমান বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, যদি জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ঘোষিত এই সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

খেলাফত মজলিস প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এবি পার্টি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রতি আস্থা রাখার কথা বলেছে। গণসংহতি আন্দোলনও বলেছে, তাঁর ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, তারিখ ঘোষনায় একটা উদ্বেগ কেটেছে। কিন্তু ডিসেম্বরে নির্বাচন হলো সমস্যা কী ছিল?

এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারেনি বিএনপি। তাদের মতে, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে একদিকে আবহাওয়ার সংকট এবং অন্যদিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বিএনপির অভিযোগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা বললেও একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত অগ্রাহ্য করে নিজেদের নিরপেক্ষতাকেই যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে দেশের জনগণ সঙ্গতভাবেই শঙ্কিত হতে পারে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। জামায়াত এপ্রিলের কথা বলেছিল। শেষ পর্যন্ত জামায়াতের কথাই সরকার মেনে নিল। এটাও বিএনপির ক্ষোভের কারণ।

চট্টগ্রামে বন্দর ও রাখাইনে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর মানিবক চ্যানেল স্থাপনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, এই দীর্ঘ ভাষণে তিনি বন্দর, করিডর ইত্যাদি এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা তাঁরই ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের ৩টি ‘ম্যান্ডেটের’ মধ্যে পড়ে না। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে শব্দচয়ন রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।

এখানে স্পষ্ট যে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে যুদ্ধাবস্থা কাটিয়ে ওঠার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। আর বিএনপির মতে, যত দিন যাবে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। তখন সরকারের পক্ষে নির্বাচন করাই সম্ভব হবে না।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য বাংলাদেশ করিডর দিয়ে দিয়েছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাকে ‘সর্বৈব মিথ্যা’ বলে ভাষণে উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসভ্য কল্পকাহিনি বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।

রাখাইনে মানিক চ্যানেল প্রসঙ্গে  প্রধান উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রস্তাব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। কিন্তু বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।

সরকার অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর ও রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের মতো বিষয়ে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি।

এখন রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য যারা সমালোচনা করছেন, তাদের যদি সরকার বিভ্রান্তিসৃষ্টিকারী হিসেবে গালমন্দ করে, সেটা নির্বাচনাকূল পরিবেশ তৈরি করবে না।  রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের বিষয়ে মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ব্যাংকক বৈঠকে মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রী ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফেরত নেওয়া দূরের কথা, আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে উল্লেখ করে বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নানামুখী অপপ্রচারে লিপ্ত।

এই সংকট মোকাবিলায় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু, বাস্তবে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে চায়, এ রকম কোনো উদ্যোগ নেই। কেবল নির্বাচনের তারিখ নয়, আরও অনেক বিষয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

যেদিন তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, সেদিনই ঈদগাহ মাঠ পরিদর্শন করে বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেন ঘোষণা দিলেন,  ‘নগর ভবনে কোনো প্রশাসক বা উপদেষ্টা বসতে পারবেন না। সেখানে যদি কোনো ধরনের প্রশাসনিক সমস্যা হয়, তাহলে ৭৫ ওয়ার্ড থেকে যাঁরা সাবেক কমিশনার ও কাউন্সিলর ছিলেন, ভোটার, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালদের নিয়ে আমরা প্রয়োজনে বিপ্লবী ঢাকা কাউন্সিল গঠন করে সাময়িকভাবে নিয়োগ দিয়ে নগর ভবন চালাব। কিন্তু এখান থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।’

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান সিটি করপোরেশন ভবন তিন সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ। রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনের সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও যুক্ত হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় ঢাকার লাখ লাখ বাসিন্দা দৈনন্দিন সেবা থেকেও বঞ্চিত। অথচ সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের পক্ষ থেকে।

তাহলে কি আমরা দেশে দুটি ‘সরকার’ পেতে যাচ্ছি? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য ইশরাক ঘোষিত ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাইরে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার।

সরকার যদি একটি সিটি করপোরেশের অচলাবস্থা দূর না করতে পারে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জট খুলবে কীভাবে?

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র জন ত ক ক উন স ল প রস ত ব সরক র র ব এনপ র করপ র শ ঐকমত য বল ছ ন র খ ইন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

৯০ শতাংশ দলের দাবি পাশ কাটিয়ে এ সিদ্ধান্ত কি না, প্রশ্ন জাগে: খসরু

আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যেখানে ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, সেখানে ৯০ শতাংশের দাবিকে বাইপাস করে (পাশ কাটিয়ে) কীভাবে এ সিদ্ধান্ত হয়, সেটি নিয়ে প্রশ্ন জাগে।’

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আজ শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা (অন্তর্বর্তী সরকার) সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি বলে বলা হচ্ছে। সেখানে ৯০ শতাংশকে এড়িয়ে এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ঐকমত্য থাকল কোথায়?’

নির্বাচন বিষয়ে এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোনো গোষ্ঠীর প্রভাব সরকারকে প্রভাবিত করেছে কি না, মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে বলে উল্লেখ করেন আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো গোষ্ঠীর প্রভাব থাকে, তাহলে তো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে বিষয়টা সামনে আসবে, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।’

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণার পরে এ বিষয়ে দলীয় অবস্থান কী হবে, সেটা ঠিক করতে আজ রাত নয়টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সভা ডাকা হয়েছে। সভা শেষে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় আস্থা রাখতে চায় এবি পার্টি
  • নির্বাচনের সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ এবি পার্টির
  • ৯০ শতাংশ দলের দাবি পাশ কাটিয়ে এ সিদ্ধান্ত কি না, প্রশ্ন জাগে: খসরু