বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম টাকা ছাপানো হয় ভারতে। কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসার আগে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরে অবস্থিত নাসিক সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ৮০ কোটি এক টাকার নোট ছাপানোর উদ্যোগ নেন। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে প্রচলিত সব পাকিস্তানি নোট ধাপে ধাপে সরিয়ে নিজস্ব মুদ্রা চালু করা। কারণ, পাকিস্তান সরকার তখন এক টাকা ও উচ্চ মূল্যমানের নোট বাতিলের পরিকল্পনা করছিল। তাই সময়ক্ষেপণ করলে দেশের অর্থনীতিতে হঠাৎ ধস নামার আশঙ্কাও ছিল।

তবে ভারতে নোট ছাপানোর উদ্যোগ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার মুখে পড়েন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর বিরুদ্ধে সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ তোলে তাঁর নিজ দল আওয়ামী লীগেরই একটি গোষ্ঠী। তারা গুজব ছড়িয়ে দেয়, ভারতের প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার মুদ্রা ছাপানোর যে সিদ্ধান্ত তাজউদ্দীন নিয়েছেন, তাতে ভারতের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার দরজা খুলে গেছে।

এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রল ডট ইন গত শুক্রবার ‘স্বাধীন বাংলাদেশ যেভাবে প্রথম পাকিস্তানি মুদ্রার অবসানে ভারতে তৈরি টাকার প্রচলন করেছিল’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সে দেশেরই স্টেটসমেন পত্রিকার সংবাদদাতা মানস ঘোষের লেখা ‘মুজিব’স ব্লান্ডার্স: দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য প্লট বিহাইন্ড হিজ কিলিং’ শিরোনামের বই অবলম্বনে এ প্রতিবেদন করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানি মুদ্রা পরিবর্তনে তাড়াহুড়ার একটি বিষয় ছিল। কারণ, তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক টাকার নোটসহ উচ্চ মূল্যমানের অন্যান্য নোট বাতিলের চিন্তা করছিল। তাই তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তানের মুদ্রা বাতিলের পরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই তাঁর সরকার ধাপে ধাপে নিজেদের মুদ্রা বাজারে ছাড়বে; যাতে সদ্য স্বাধীন দেশের ওপর হঠাৎ কোনো অর্থনৈতিক সংকট এসে না পড়ে। এই পরিকল্পনার শুরুটা তিনি করতে চেয়েছিলেন বাজারে এক টাকার নোট ছাড়ার মাধ্যমে।

তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর সরকার পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে বাজার থেকে পাকিস্তানের সর্বনিম্ন মূল্যমানের নোট তুলে নেবে। এর পরিবর্তে নতুন এক টাকার নোট চালু করবে। এই এক টাকার নোট যে ভারতে ছাপা হয়েছিল, তা প্রবাসী সরকারের অনেকেই জানতেন না।

১৯৭২ সালের মার্চে নতুন এক টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়। এ নোটগুলোতে পাকিস্তানের উর্দু হরফের পরিবর্তে সুন্দর বাংলা ফন্ট স্থান পায়। তখন ব্যবসায়ী মহল ও সাধারণ মানুষ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। ঢাকার কিছু দৈনিক পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে সরকারের প্রশাসনিক সক্ষমতা ও দূরদর্শিতার প্রশংসা করে।

কিন্তু হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত কিছু দৈনিকে খবর ছাপা হয়, দেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে নকল এক টাকার নোটের বস্তা ঢুকছে। যদিও ‘গুজব’ আকারে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনে তাজউদ্দীনের নাম সরাসরি বলা হয়নি। তবে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, নোট ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের হাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার সুযোগ তুলে দিয়েছেন, ভারত যাতে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাজউদ্দীন স্বেচ্ছায় সেই সুযোগ করে দিয়েছেন এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন। সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পত্রিকায় একই নম্বরের দুটি ভিন্ন নোটের (জাল নোট হিসেবে) ছবিও ছাপানো হয়।

মূলত তৎকালীন কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ টাকার বিষয়টি নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন সংবাদ ফাঁস করতেন। যেমন তাঁরা একবার সংবাদকর্মীদের জানান যে ভারত থেকে টাকা ছাপানো নিয়ে যে প্রচারণা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও উদ্বিগ্ন। সেই সূত্র ধরে কিছু সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এভাবে, প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশে কোটি কোটি এক টাকার নকল নোট পাচার হচ্ছে। এই খবর শুনে বঙ্গবন্ধু সত্যতা যাচাই করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিজ দপ্তরে তলব করেন। এ ঘটনায় তাজউদ্দীন আহমদ মর্মাহত হন। কারণ, বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডাকার পরিবর্তে তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়েছিলেন। অথচ তাঁকে (তাজউদ্দীন) কিছুই জানানো হয়নি।

ওই সময় সাংবাদিক বজলুর রহমান (প্রয়াত) পূর্বদেশের তৎকালীন সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরীকে (তিনি জাল ভারতীয় মুদ্রার ছবি ছাপিয়েছিলেন) জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কাছে যাঁরা ছবিগুলো দিয়েছেন তাঁরা কি নকল নোট বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছেন? পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন?’ এহতেশাম হায়দার এ বিষয়ে জানাতে কোনো আগ্রহ দেখাননি।

দৈনিক সংবাদে কর্মরত বজলুর রহমান তখন এহতেশাম হায়দার চৌধুরীকে বলেন, ‘আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে যাঁরা আপনাকে এসব ছবি ও খবর দিয়েছেন তাঁরা অসৎ উদ্দেশ্যে আপনার পত্রিকাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন? আমরা এটি খুব ভালোভাবেই জানতাম যে আওয়ামী লীগের কারা এই নোংরা চক্রান্তে লিপ্ত; তাঁরা কার বিরুদ্ধে এবং কী উদ্দেশ্যে এই কাজ করছেন। তাই আমরা এ খবরটিকে গুরুত্ব দিইনি। সীমান্তবর্তী কোনো জেলা থেকে আমাদের কোনো সংবাদদাতা ভারত থেকে জাল বাংলাদেশি নোটের ব্যাপক চোরাচালানের খবর দেয়নি। ওই সব জেলার পুলিশ কিংবা সীমান্তে নিয়োজিত বাংলাদেশ রাইফেলসও (বর্তমান বিজিবি) জাল নোট জব্দের কোনো তথ্য দেয়নি। পুরো প্রচারণাটিই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—তাজউদ্দীনকে ফাঁসানোর জন্য।’

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সেসব প্রতিবেদন দেশে একধরনের ভীতিকর ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। গুজব এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে ঢাকার রিকশাওয়ালারা ভারতে ছাপানো এক টাকার নোট নিতে অস্বীকৃতি জানান। বরং তাঁরা পাকিস্তানি নোট ও কয়েনে (ধাতব মুদ্রা) ভাড়া নিতে চাইতেন। আর দোকানিরা বলতেন, এই নোট বৈধ নয়। যদিও কেউ কেউ নতুন নোটের পক্ষে যুক্তি দিতেন। তাঁরা বলতেন, সরকার এখনো এসব নোটকে অবৈধ ঘোষণা করেনি। তবে ব্যবসায়ীরা পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলতেন, দেশের জনগণ এই নোটে আস্থা রাখেন না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত জউদ দ ন আহমদ এক ট ক র ন ট মন ত র প রক শ সরক র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদের দিনে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ৩৮

মুসলিমদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে শুক্রবার ঈদ উদ্‌যাপিত হয়। এই ধর্মীয় উৎসবের দিনেও ফিলিস্তিনের গাজায় দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে নিহত হয়েছেন ৩৮ জন।

গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ ‘সিভিল ডিফেন্সের’ কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, সকাল থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর অনেকগুলো হামলায় ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় এক হামলায় নিহত হয়েছেন ১১ জন।

অবশ্য হাসপাতালগুলোর সূত্রের বরাত দিয়ে সকাল থেকে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪২ বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা।

খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহর পশ্চিম ও উত্তরে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর গোলাবর্ষণে সাত ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ খবরের মধ্যেই শুক্রবার গাজায় সব ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ)’।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত এই ফাউন্ডেশনের দেওয়া ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত ১১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর এ কথা জানিয়েছে।

এদিকে এ নিয়ে টানা দ্বিতীয় কোরবানির ঈদ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মধ্যে কেটেছে গাজার বাসিন্দাদের। ঈদের দিন যুদ্ধে নিহত শিশুদের কবরে গিয়ে মায়েদের আহাজারি করতে দেখা যায়।

আরও পড়ুনগাজায় ঈদ কেবলই স্মৃতি১১ ঘণ্টা আগে

শিশুকন্যার কবরের পাশে বসে কাঁদছিলেন উম্মে আহমদ আউয়িদা। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা টানা দ্বিতীয় ঈদুল আজহা উদ্‌যাপন করছি বোমা, বিমান হামলা, মৃত্যু, অবরোধ ও ক্ষুধার মধ্য দিয়ে তথা মানুষের ওপর চালানো সব ধরনের নির্যাতনের মধ্যে।’

উম্মে আহমদ আউয়িদা বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে অনেক কিছু ত্যাগ করেছি, আমরা আমাদের ঘরবাড়ি ও নিজেদের হারিয়েছি, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবিতে সিলেটে বাসদের সমাবেশ 
  • ‌সিলেটে কোরবা‌নি দিতে গিয়ে আহত ৭৬, হাসপাতালে ভর্তি ২৬ জন
  • ঈদের দিনে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ৩৮
  • প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন
  • প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • ৬৬ বছর আগে প্রয়াত আব্বার জন্য ফেরদৌসী রহমান কেন চোখ মোছেন