সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রে নানাভাবে পর্যটকদের হয়রানি, হেনস্তা ও মারধরের ঘটনা নতুন নয়। জাফলংয়ে আগেও পর্যটকদের লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছিল। কয়েক বছর আগে পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সে ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল। এবারও সেখানে পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের হাতাহাতি হয়েছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জেও একটি পর্যটন এলাকায় যেতে পর্যটকদের বাধা দিয়েছে স্থানীয় ধর্মীয় গোষ্ঠী। এসব ঘটনা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সুখ্যাত সিলেটের জন্য নেতিবাচক তো অবশ্যই, উদ্বেগজনকও বটে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গত সোমবার বিকেলে জাফলং বিজিবি ক্যাম্প–সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে পর্যটকদের হাতাহাতি হয়। তবে ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এ সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছিল। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান হয়ে গেছে। পর্যটকদের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো পক্ষই অভিযোগ করেনি। তবে এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকের ভুল ধারণা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে প্রশাসন তৎপর।
আগের দিন রোববার কোম্পানীগঞ্জের উত্তর রনিখাই ইউনিয়নে উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে যেতে পর্যটকদের বাধা দেওয়ার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও বিষয়টি প্রকাশ পায়। ভিডিওতে দেখা যায়, উৎমাছড়ায় বেড়াতে আসা কিছু মানুষ সেখানে সময় কাটাচ্ছিলেন। বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের সেখানে দেখা যায়। এলাকাবাসী পরিচয় দিয়ে কিছু মানুষ সেখানে হাজির হয়ে পর্যটকদের উৎমাছড়া থেকে চলে যেতে বলেন। এটি কোনো পর্যটনকেন্দ্র নয় বলেও ঘোষণা দেন তাঁরা এবং এখানে যাতে কেউ না আসেন, সেটি প্রচার করতেও বলেন তাঁরা।
এলাকাবাসী বলে পরিচয় দেওয়া আগত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুব জমিয়তের সহসভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটনের কথা বলে কিছু মানুষ ওই এলাকায় গিয়ে মদ্যপান ও অশ্লীল কার্যক্রম করছেন। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয়ে স্থানীয় আলেম-ওলামা ও মুরব্বি–যুবকদের নিয়ে ঈদের আগে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পর্যটনকেন্দ্রটি নিয়ে যাতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এর অংশ হিসেবে গত রোববার বিকেলে বেড়াতে আসা লোকজনকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।’
পর্যটনকেন্দ্রের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ রক্ষা করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকেই ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো এলাকা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে কি হবে না, তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার নামে কোনো পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের কেউ মারধর, হেনস্তা বা বাধা দেবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। এলাকাবাসীর নামে কোনো পক্ষ এখানে আইন অমান্য করবে, ক্ষমতাচর্চা করবে বা মব ভায়োলেন্স তৈরি করবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ভিড়ে ‘বিঘ্নিত’ বন্য প্রাণীর জীবন
ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার জনপ্রিয় গন্তব্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিরল প্রজাতির নানা জাতের গাছ ও প্রাণীতে ভরা সংরক্ষিত বন এটি। তবে পর্যটকের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় ও হইহুল্লোড় ‘উৎপাত’ হিসেবে দেখা দেয়।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটি, ট্যুর গাইড ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, চা-বাগান, পাহাড়-প্রকৃতি, হাওর-বাঁওড়ের কারণে মৌলভীবাজার একটি পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত। তবে কিছু এলাকা আছে বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য স্পর্শকাতর। এর মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি। এবারের দীর্ঘ ছুটিতে ৭ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সাত দিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৭ হাজার ৫৮১ জন দর্শনার্থী ঘুরতে গেছেন। এতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ১৩৫ টাকা।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। সরকার ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচরসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র।
লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটির মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, পর্যটনের ক্ষেত্রে লাউয়াছড়ার বন্য প্রাণী, পরিবেশ-প্রকৃতির এই বাস্তবতাকে অনেকটাই বিবেচনায় রাখা হয় না। পর্যটকেরা অন্য স্থানের মতো এখানেও ঘোরার আনন্দতে হইহুল্লোড় করেন। বেশির ভাগ পর্যটকদের মধ্যে গাইড সঙ্গে নিতে অনীহা আছে। বনের ভেতর করণীয় আচরণ অনুসরণ করেন না অনেকে। অনেক পর্যটক ব্লুটুথ স্পিকারে গান বাজিয়ে বনে ঘুরেন। বন্য প্রাণী বিশেষ করে বানরকে উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। প্লাস্টিক প্যাকেট নির্ধারিত স্থানে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কে গাড়িগুলো উচ্চ গতিতে হর্ন বাজিয়ে চলাচল করে। সব মিলিয়ে বনের নির্জনতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
পর্যটকের ভিড়, হইহল্লোড়ের কারণে যে প্রাণীদের অসুবিধা হয়, সেটা স্বীকার করে নিলেন পর্যটক সুভাষ বড়ুয়া।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, মানুষের উপস্থিতি, শব্দ—এসবে আতঙ্কিত বন্য প্রাণী অনেকটাই দিশাহারা হয়ে পড়ে। গভীর বনের মধ্যে আত্মগোপনে চলে যায়। কিছু বানর ছাড়া আর তেমন কোনো প্রাণীর দেখা মিলে না। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হয়।
প্রাণপ্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরবর্তী সময়ের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর লাউয়াছড়ার আরেক সর্বনাশ করেছে অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক পর্যটন। এই বনের পর্যটক ধারণক্ষমতাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে বিপুল পরিমাণে মানুষ ঢুকেন এখানে। এটি এখানকার বন্য প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস, চলাচল ও প্রজননে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একই সঙ্গে বনের ভেতর রেলপথ, ব্যস্ত সড়কপথ প্রতিদিন বন্য প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাউয়াছড়া কোনো একক বিচ্ছিন্ন বাস্তুতন্ত্র নয়। এর আশপাশের চা-বাগান, জলাভূমি, গ্রাম, বন—সবকিছু মিলিয়েই এর সীমানা নির্ধারণ এবং স্থানীয় বননির্ভর জনগণকে সমন্বয় করে বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক বনব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার।
লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও মনিটরিং দলের সদস্য জনক দেববর্মা মনে করেন, বনে গণপর্যটন বন্ধ করলে বনের উপকার হবে। আর পর্যটকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ শ্রীমঙ্গলের রেঞ্জার কাজী নাজমুল হক বলেন, লাউয়াছড়ায় পর্যটক সীমিত করতে টিকিটের ফি বাড়ানো হয়েছে। কীভাবে পর্যটক সীমিত করা যায়, বিকল্প কী তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে চিন্তাভাবনা আছে। সড়কে ২০ কিলোমিটার গতি নির্ধারণ করা, কিন্তু তা কেউ মানতে চান না। এখানে হাইওয়ে পুলিশ নিয়োগ দরকার। বন্য প্রাণী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষের বিচরণে বন্য প্রাণীরা একটু আড়ালে থাকে।