গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে উপসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা অনেক আগেই টালমাটাল হয়ে পড়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পরমাণু আলোচনা শুরুর পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ইরানে গতকাল শুক্রবার ভোরে ইসরায়েলের বড় ধরনের বিমান হামলার পর অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতায় নতুন উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

গতকাল ভোররাতে ইরানের পরমাণু স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ২০০ যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানের বিভিন্ন শহরের ১০০-এর বেশি নিশানায় হামলা চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের এই অভিযানে ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, আইআরজিসির বিমানবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহসহ অন্তত ২০ জন কমান্ডার নিহত হয়েছেন।

হামলার জবাবে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান প্রায় ১০০টির মতো ড্রোন পাঠিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় সব ড্রোনই ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে ধ্বংস করা হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শক্ত জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিহত প্রত্যেক নাগরিকের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন।

হামলার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে একাধিক পোস্ট করেছেন। এক পোস্টে তিনি ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে সম্মত হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘এরই মধ্যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং বহু মানুষ মারা গেছেন। তবে এই হত্যা এবং আরও নৃশংস হামলার পরিকল্পনা থামাতে এখনো সময় আছে। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে এবং একসময় পরিচিত ইরান সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে ইরানকে অবশ্যই একটি চুক্তি করতে হবে।’

রয়টার্সের এক মন্তব্যধর্মীয় বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই অবস্থায় পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তার অনেক কিছু ইরান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেটার ওপর নির্ভর করছে। একটি সম্ভাবনা হলো, তেহরান পাল্টা আঘাত কেবল ইসরায়েলের ওপর সীমিত রাখবে। ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার পর গত বছরের এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে তেহরান এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।

ওই বছরের এপ্রিলে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান ১৭০টি ড্রোন, ১২০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। অক্টোবর ছুড়েছিল প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রায় সবগুলো নিশানায় আঘাত হানার আগেই মাঝ আকাশে ধ্বংস করেছিল বা ভূপাতিত করেছিল ইসরায়েল।

আরেকটি সম্ভাবনা হলো, ইসরায়েলের এই হামলাকে ইরান ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের পরমাণু আলোচনার একটি কৌশলগত অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি তা–ই হয়, তাহলে কাতার ও বাহরাইনে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে ইরান। এতে করে পুরো অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেবে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের দৈনিক এক-পঞ্চমাংশ তেল পরিবহন হুমকির মুখে পড়তে পারে। এর ফলে ইরানের দৈনিক ১৫ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগও কমে যেতে পেতে পারে।

সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন, ইসরায়েল যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায়, তেহরান কঠোর জবাব দেবে। এতে করে ওই অঞ্চলে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হতে পারে।

ইসরায়েল ও ইরান পুরোদমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। এসব সেনার মধ্যে প্রায় ৪ হাজার মোতায়েন রয়েছে ইরাক ও সিরিয়ায়।

রয়টার্সের আরেক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ হামলা থেকে বড় ধরনের কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে কি না, তা এখনো কেউ নিশ্চিত নন। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, তেহরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে হামলার ‘ন্যায়সংগত লক্ষ্যবস্তু’ হিসেবে দেখতে পারে। যেমন ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা আবার লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করতে পারে।

ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারবে কি না, সেটাও স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে ইরানের ফোর্ডো সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা মাটির গভীরে অবস্থিত। ফলে সেটি ধ্বংস করা কঠিন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব স্থাপনায় আঘাত করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দরকার, যা এ হামলায় ছিল না।

তেহরান কতটা জোরালোভাবে ইসরায়েলি হামলার পাল্টা জবাব দিতে পারবে, তা অনিশ্চিত। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ইরানের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে লক্ষ্য করেছে এবং এ অভিযান কয়েক দিন চলতে পারে।

সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি ট্রাম্পের ‘বিশ্বশান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হয়ে ওঠার আশা পুরোপুরি শেষ করে দেবে, নাকি শুধু সাময়িক ধাক্কা, তা সময়ই বলে দেবে।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিরিয়া ইনিশিয়েটিভের প্রধান চার্লস লিস্টার বলেন, ইসরায়েলের বক্তব্য যদি সত্যি হয় যে আজকের হামলা ছিল ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরুর প্রথম ধাপ, তাহলে ইরানের শাসনব্যবস্থা এখন একেবারে অস্তিত্বসংকট এবং জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে।

চার্লস লিস্টার বলেন, ‘এ হামলা এখন একেবারে ভিন্ন মাত্রা পেল। এ রকম উত্তেজনা আগে কখনো দেখা যায়নি। নতুন এক বড় যুদ্ধের আশঙ্কা এখন অনেক বেশি বাস্তব।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র পর স থ ত পরম ণ

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান নিহত: রাষ্ট্রীয় টিভির খবর

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলি হামলায় ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিসহ আরও বেশ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েলি হামলায় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি নিহত হয়েছেন। পৃথক হামলায় আইআরজিসির প্রধান মেজর জেনারেল সালামিও নিহত হন।

বাঘেরি ইরানের সর্বোচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলায় নিহত দ্বিতীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তিনি।

এর আগে শুক্রবার সকালে ইরানের একাধিক রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামিও ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন।

ইরানি বার্তা সংস্থার খবরে জানানো হয়, ‘খাতাম আল-আনবিয়া’ সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদও একই হামলায় নিহত হয়েছেন।

পরমাণুবিজ্ঞানী ও ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-মেহদি তাহরাঞ্চি এবং পরমাণুবিজ্ঞানী ও ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফেরাইদুন আব্বাসিও পৃথক হামলায় নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি বাহিনী আজ শুক্রবার ভোররাতের দিকে ইরানের রাজধানী তেহরানসহ অন্যান্য শহরে সামরিক হামলা শুরু করে।

ইসরায়েল তেহরানে আবাসিক ভবনেও হামলা চালিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা জানান, তাঁরা নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ও শিশুর মরদেহ দেখতে পেয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিহত সেনাপ্রধান কে এই বাঘেরি
  • তেল আবিবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশে আগুন
  • ইরানে নতুন করে ইসরায়েলের হামলা, তেহরানে বিস্ফোরণ
  • তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্বকারী দূতকে তলব করেছে ইরান
  • ইসরায়েলি হামলায় ইরানের আইআরজিসির বিমানবাহিনীর প্রধান নিহত
  • ইরান ও ইসরায়েল: আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় কে এগিয়ে
  • ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ২০ সিনিয়র কমান্ডার নিহত
  • আইআরজিসির নতুন প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ পাকপুর
  • ইসরায়েলি হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান নিহত: রাষ্ট্রীয় টিভির খবর