জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে নির্মাণ হবে গণমিনার
Published: 19th, June 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণপ্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের স্মরণে সর্বস্তরের নাগরিক উদ্যোগে রাজধানীতে নির্মাণ করা হবে ‘গণমিনার’। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে ‘গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠিত হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে কমিটি এসব তথ্য জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও স্থপতি কামার আহমাদ সাইমনসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা।
সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা জানান, গণমিনারের স্থান হিসেবে বীর উত্তম মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান রোড ও বিজয় সরণির মধ্যবর্তী সবুজ চত্বরকে নির্বাচন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এরই মধ্যে গণমিনার নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ, অর্থ ও প্রকৌশল সহযোগিতার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে জাতিসংঘ স্বীকৃত (গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে) ১ হাজার ৪০০ শহীদের নাম ও পরিচিতি গণমিনারে খোদাই করে সংরক্ষণ করা হবে।
গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, কমিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হচ্ছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক এ নাগরিক উদ্যোগটির লক্ষ্য, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং শহীদদের স্মৃতিকে স্মারকরূপে সংরক্ষণ করা; যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের চেতনা সঞ্চারিত হয়।
বক্তারা বলেন, জুলাই ২০২৪ ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে আপামর জনগণ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন। জুলাই গণপ্রতিরোধে জাতির প্রতিবাদী সত্তার স্ফুরণ ঘটে। সেই সত্যকে স্মরণে রাখতে গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটি একটি স্থায়ী স্মারক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে আরও জানানো হয়, এই ভূখণ্ডে গত ২৫০ বছরের প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের ইতিহাসের চিত্রও গণমিনারে তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। এই গণমিনার হবে এমন এক স্মরণস্থল, যা রাজনৈতিক বিভাজন অতিক্রম করে সব মত ও পথের মানুষের সম্মিলিত গণ–উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হবে। গণমিনার বাস্তবায়নে গণমানুষের সম্পৃক্ততার লক্ষ্যে গণচাঁদা সংগ্রহেরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের প্রভাষক অলিউর সান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংগঠক অলিক মৃ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন, কবি ও লেখক আলতাফ শাহনেওয়াজ, লেখক ও গবেষক ইলিরা দেওয়ানসহ আরও অনেকে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত হয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
লিপস্টিক ইফেক্ট: মন্দায় প্রসাধনীর চাহিদা কেন বাড়ে?
চলতি অর্থবছরে আমদানি করা প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজের ওপর কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে এবং তা কার্যকরের পথে। সরকারি নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ভাবছেন এতে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বাজারপ্রবণতা বলছে, বাস্তবতা ভিন্ন। অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও প্রসাধনসামগ্রীর চাহিদা কমে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে বাড়ে। এ ঘটনাকে অর্থনীতিবিদেরা ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’ নামে অভিহিত করেছেন।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ কেন কম দামি বিলাসবহুল পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
২০০১ সালে এস্তে লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্ড লডার ধারণাটি প্রথম সামনে আনেন। তিনি লক্ষ করেন, মন্দার সময়েও লিপস্টিকের বিক্রি বেড়েছে। জেপি মরগান প্রাইভেট ব্যাংকের আচরণগত বিজ্ঞানের প্রধান জেফ ক্রিসলার বলেন, ‘মানুষ ১০ ডলারের ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করতে পারে, কিন্তু বাড়ির ক্ষেত্রে তা অসম্ভব।’
২০০৮-১০ সালের বিশ্বমন্দার সময় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা যায়, ১৮-৪০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রসাধনীর ব্যয় গড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রবণতা বিবাহিত ও অবিবাহিত—সব নারীর মধ্যেই দেখা গেছে।
বাংলাদেশের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা বাজার দ্রুত বাড়ছে।
২০২৩ সালে এর বাজার ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৭ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। আধুনিক যুগে বিউটি ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। ২০২৪ সালে ওরভেওন ব্র্যান্ডগুলোর ডিজিটাল বিক্রি ২০২২ সালের ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
ইউটিউব ও টিকটকের নতুন ইনফ্লুয়েন্সাররা কোম্পানিগুলোর ২০ শতাংশ অনলাইনে বিক্রয় চালাচ্ছেন।
গবেষণায় লিপস্টিক ইফেক্টের তিনটি প্রধান তত্ত্ব পাওয়া গেছে। সবচেয়ে শক্তিশালী হলো মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিস্থাপন তত্ত্ব, যেখানে মানুষ ব্যয় সংকোচন করে দামি পোশাক বা অলংকার না কিনে কম খরচে ‘নিজেকে ভালো রাখার’ উপায় খোঁজে।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারে উৎসবে নতুন পোশাকের পরিবর্তে প্রসাধনী কেনার প্রবণতা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, আর্থিক অনিশ্চয়তায় নারীরা নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনসঙ্গী খোঁজার সম্ভাবনা বাড়াতে চান। বাংলাদেশের সমাজেও এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে গবেষণা বলছে, বিবাহিত নারীরাও একই কারণে প্রসাধনী কেনেন।
আরও পড়ুনপ্রসাধনীতে উচ্চ ভ্যাট বসালে আসলেই কি রাজস্ব বাড়বে০৩ জুন ২০২৫তৃতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, চাকরি পাওয়ার জন্য বা রক্ষার লক্ষ্যে প্রসাধনীর ব্যবহার বাড়ে। তবে এ বিষয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী ও বেকার উভয় নারীর প্রসাধনী ব্যয়ে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি।
সরকার যদি প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করে, তাহলে কয়েকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, অবৈধ আমদানি বাড়বে, সরকার রাজস্ব হারাবে এবং সাধারণ ভোক্তা নিম্নমানের পণ্যের ঝুঁকিতে পড়বে। অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা আমদানি করা প্রসাধনী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই শুল্কবৃদ্ধি তাঁদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
উচ্চ শুল্ক দেশীয় উৎপাদকদের প্রতিযোগিতাহীন একটি স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ তৈরি করবে, যা মানোন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই পটভূমিতে কিছু বাস্তবসম্মত বিকল্প ভাবা জরুরি। যেমন দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি এবং কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস। পাশাপাশি হালাল সার্টিফিকেশন অর্জনের মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোয় রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে।
আরও পড়ুনকর ফাঁকি না ধরে ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা কেন? ০৫ জানুয়ারি ২০২৫প্রসাধনীকে সাধারণভাবে একটি ‘নরমাল গুড’ ধরা হয়। আয় বাড়লে এর চাহিদা বাড়ে। কিন্তু মন্দার সময়ও এর চাহিদা কমে না। জেপি মরগানের দীপ্তি নাগুলাপল্লি বলেন, ‘যখন বড় কিছু আপনার নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন আপনি ছোট কিছুতে সান্ত্বনা খুঁজে নেন।’
আন্তর্জাতিক বাজারে এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিলাসবহুল ব্র্যান্ড এলভিএমএইচের পারফিউম ও প্রসাধনী বিভাগের মুনাফা ৩ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে চার মাসেই বিউটি স্টোরে গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজারেও প্রসাধনী খাতে ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ দেশীয় কোম্পানির হাতে। তাদের বার্ষিক কারবার প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টাকা এবং এতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। তবে এই খাতে কাঁচামালের ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর, প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম এবং ব্র্যান্ডিং দুর্বল।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। মন্দার সময় মানুষ প্রসাধনী কেনার মাধ্যমে আত্মপ্রত্যয়ের একধরনের প্রতীক খোঁজে। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—তিন পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্য প্রসাধনী ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভার্চ্যুয়াল মেকআপ ট্রাই-অন অ্যাপ, ইউটিউব-ইনস্টাগ্রাম রিভিউ, রেটিং ও ‘সোশ্যাল শপিং’ এখন ক্রয়ের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখছে।
অর্থনৈতিক চাপে থাকা মার্কিনরা ৩০ ডলারের ডিওর লিপ প্লাম্পার কিনলেও বাড়ি বা গাড়ি কেনার কথা ভাবেন না। এই ক্ষুদ্র বিলাসিতা মানসিক চাপ প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এবারের বাজেটে প্রসাধনী আমদানিকারকেরা এক গুরুতর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এনবিআর আমদানি করা কসমেটিকসে নতুন মিনিমাম ভ্যালু নির্ধারণের মাধ্যমে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বাড়িয়েছে, যেখানে আগেই এই পণ্যে মোট করভার (টিটিআই) ছিল ১৫৮ থেকে ১৮৩ শতাংশ। অথচ রোলস-রয়েসের (ইলেকট্রিক) ওপর টিটিআই মাত্র ৮৯ শতাংশ।
এমনকি স্যামন, টুনা মাছ, কাপড় ও জুতার ওপর কর হ্রাস করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, আমদানি করা কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা জাতীয় বাজেটে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। মন্দার সময় মানুষ প্রসাধনী কেনার মাধ্যমে আত্মপ্রত্যয়ের একধরনের প্রতীক খোঁজে। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—তিন পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
প্রতিযোগিতা উৎকর্ষের জন্ম দেয়। প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি মানে গুণগত উন্নয়নের অনুপস্থিতি। তাই সরকারের উচিত সুরক্ষাবাদী নীতির পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক ও উদ্ভাবনী পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা সত্যিকার অর্থেই দেশীয় শিল্পের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।
নির্মল রায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ