তিরিশ বছরের ইরানি শ্রমিক আন্দোলনকর্মী সেপিদে কোলিয়ান তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে দুই বছর কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি দুটি বই লিখেছেন। তার একটি রান্নার বইয়ের আদলে লেখা চমৎকার কারাস্মৃতি। মাত্র গত সপ্তাহে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। আর এর তিন দিনের মাথায় ইসরায়েলি মিসাইল আর ড্রোন ইরানে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে শুরু করে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর এই যুদ্ধ তাঁদের নিপীড়ক সরকার থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে। তিনি বলেছেন, ‘এখনই তোমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।’ এই বার্তার প্রতি ইরানের সরকারবিরোধী আন্দোলনকর্মীরা কী ভাবছেন, জানতে আমি ফোন করলাম সেপিদেকে। তিনি আমাকে বললেন, ‘যুদ্ধ কখনো গণতন্ত্র আনতে পারবে না।’ ২০২২-২৩ সালে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ শিরোনামের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর মতে, নেতানিয়াহু এ আন্দোলনের মূল্যবোধের কোনো চ্যাম্পিয়ন নন। তিনি জানালেন, ‘আমরা যে জীবন চেয়েছিলাম, এখনকার ভয়াবহ ঘটনাগুলো তার ঠিক উল্টো।’ এই যুদ্ধ ইরানের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর মনোভাব বদলায়নি।
ইরানে যে সরকারবিরোধী এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে, তা সবারই জানা। বারবার প্রতিবাদ আর দমনের চক্রে এটা প্রমাণিত। ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলন ছিল তার একটি নাটকীয় প্রকাশ। এর আগেও ছিল ২০১৭-১৯ সালের অর্থনীতির প্রতিবাদ, ২০০৯-১০ সালের ব্যাপক গণতান্ত্রিক সবুজ আন্দোলন, এসবের আগে আছে ১৯৯৯ সালের ছাত্রবিদ্রোহ। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর চলেছে সংস্কারের জন্য নির্বাচনভিত্তিক আন্দোলন। ইরানের মানুষ এবং দেশের ভেতরে ও বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান প্রবাসী সম্প্রদায় ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংকোচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা আর আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার।
দীর্ঘদিন ধরে বাইরে একটা তাত্ত্বিক বিতর্ক চলছিল: ইরানে সামরিক হামলা কি এই ঘৃণিত শাসনব্যবস্থা উৎখাতে জনগণকে সাহায্য করবে, নাকি বিরোধীদেরও দেশের পতাকার নিচে সমবেত হতে বাধ্য করবে। এ প্রশ্নের উত্তর এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্ধারিত হচ্ছে। কট্টর সরকারবিরোধী কর্মীও ইসরায়েলি হামলার সমর্থন করার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ, যে হামলায় ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে এরই মধ্যে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হামলার শুরুতে কিছু সামরিক ব্যক্তির মৃত্যুতে কেউ কেউ উল্লাস করেছিলেন, কিন্তু এখন মর্জি পাল্টে গেছে।
তেহরান ৯৮ লাখ মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ শহর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েল যে হামলা চালাচ্ছে, বিক্ষোভ আন্দোলনে যুক্ত নাগরিক সমাজের সদস্যরাও তার শিকার হচ্ছেন। ২৩ বছর বয়সী কবি ও ইংরেজি শিক্ষক পার্নিয়া আব্বাসি প্রথম দিনের হামলায় মা–বাবা, ভাইসহ প্রাণ হারান, যদিও হামলাটি হয়েছিল কাছাকাছি এক ভবনের সরকারি কর্মকর্তাকে লক্ষ্য করে। ৩৫ বছর বয়সী জাহরা শামস ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম, নিজের পছন্দে হিজাব পরতেন। তবে কাউকে বাধ্য করা হোক, সেটা চাইতেন না। ইসরায়েলি হামলায় তিনিও প্রাণ হারান।
আমি যে প্রায় ১০ আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অধিকাংশই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির রাজনীতিকে সমর্থন করেন না। তাঁরা ইসরায়েলে ইরানের হামলাকেও সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁরা ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন; অবকাঠামো ধ্বংসের আশঙ্কায় ভীত।
তেহরানের ২৪ বছর বয়সী এক আন্দোলনকর্মী বলেছেন, ‘আমি ইসলামিক রিপাবলিক সরকার আর খামেনির বিরুদ্ধে আমার সব অস্তিত্ব দিয়ে লড়াই করি, কিন্তু এ মুহূর্তে শাসনব্যবস্থা উৎখাতের কথা ভাবতেও পারছি না। চারপাশের সবার জীবন নিয়েই আমি উদ্বিগ্ন।’
২০২২-২৩ সালের বিক্ষোভের সময় গ্রেপ্তার হওয়া ২৬ বছর বয়সী আন্দোলনকর্মী আমাকে বললেন, তিনি ইসরায়েলি হামলার তীব্র বিরোধিতা করছেন। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমাদের দেশের জন্য বিশাল নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনছে। এটা এক পুরোদস্তুর বিপর্যয়। ইরান-ইসরায়েল দুই দেশেই নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন।’
এক তরুণী আন্দোলনকর্মী তাঁর বয়স্ক ও অসুস্থ মাকে নিয়ে রাজধানী থেকে কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলের দিকে পালানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ড্রোন আর মিসাইলের হুংকারের মধ্যে কি আমার পক্ষে আন্দোলন নিয়ে ভাবা সম্ভব? ইরানে বা ইসরায়েলে, কোথাও বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোকে আমি সমর্থন করি না।’
আলিরেজা গাদিমি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁর ক্যাম্পাসের ইতিহাস দীর্ঘ। বিপ্লবের সময় শাহের বিরুদ্ধে আর ১৯৯৯ সালে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল এটি। বিস্ফোরণের শব্দ, দেয়ালের কাঁপুনি আর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক তরুণ ইরানির মতো পরিবর্তন চাই। কিন্তু এ যুদ্ধ আমাদের সাহায্য করছে না, বরং ধ্বংস করছে। যাদের বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে, তাদেরই কণ্ঠ রোধ করছে।’
ইরানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুদ্ধ আর শাসনব্যবস্থা—দুয়েরই বিরোধিতা করেছেন। এভিন কারাগার থেকে সাবেক উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তফা তাজজাদেহ ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি ইরানে ‘শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ও চেয়েছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি ও নার্গেস মোহাম্মাদি পাঁচজন আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে (যাঁর মধ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পালমে দর বিজয়ী চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহিও আছেন) যুদ্ধের তাৎক্ষণিক অবসান, ইরান ও ইসরায়েলের বেসামরিক হামলার নিন্দা, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন।
‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর পেছনে কয়েক দশকের দমন আর প্রতিবাদের ইতিহাস রয়েছে। অথচ আমার কথা বলা অধিকাংশ প্রবাসী আন্দোলনকর্মী দেশের ভেতরের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে একই মত পোষণ করেন। ইউরোপে বসবাসকারী এক তরুণী বললেন, ‘গাজা, লেবানন এমনকি সিরিয়ায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, নেতানিয়াহু এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চান না। তিনি ইরানের তেল শোধনাগার আর বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা করছেন। স্পষ্টতই তিনি আমাদের জনগণের কথা ভাবছেন না।’
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মেহরাঙ্গিজ কারের সঙ্গে কথা বললাম। ৮০ বছর বয়সী এই মানবাধিকার আইনজীবী ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রিপাবলিকের শুরুতেই বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। প্রায় ২০ বছর আগে তাঁকে ইরান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, নেতানিয়াহু ইরানের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের বন্ধু নন। তিনি আরও বললেন, ‘ইরানে ইসরায়েলি হামলা দেখে মনে হচ্ছে আমার নিজের বাড়ি জ্বলছে। ইরানে কেউই এ হামলার সমর্থন করে না। মানুষ ইসলামিক রিপাবলিক সরকারকে ঘৃণা করে। কিন্তু নেতানিয়াহু আর তাঁর সামরিক নীতিকে আরও বেশি ঘৃণা করে।’
ইসরায়েলের প্রচারণা হয়তো ইরানের শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও কাঁপিয়ে দিতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ইরানের আন্দোলনকর্মীরা মাতৃভূমিতে বিধ্বংসী যুদ্ধকে সমর্থন করবে, এটা কেবল কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
অনুবাদ: মোর্শেদ আলম
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ সনব যবস থ গণত ন ত র ক স ব ধ নত আম দ র বলল ন সরক র ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
এ যুদ্ধ আমাদের সাহায্য করছে না
তিরিশ বছরের ইরানি শ্রমিক আন্দোলনকর্মী সেপিদে কোলিয়ান তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে দুই বছর কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি দুটি বই লিখেছেন। তার একটি রান্নার বইয়ের আদলে লেখা চমৎকার কারাস্মৃতি। মাত্র গত সপ্তাহে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। আর এর তিন দিনের মাথায় ইসরায়েলি মিসাইল আর ড্রোন ইরানে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে শুরু করে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর এই যুদ্ধ তাঁদের নিপীড়ক সরকার থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে। তিনি বলেছেন, ‘এখনই তোমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।’ এই বার্তার প্রতি ইরানের সরকারবিরোধী আন্দোলনকর্মীরা কী ভাবছেন, জানতে আমি ফোন করলাম সেপিদেকে। তিনি আমাকে বললেন, ‘যুদ্ধ কখনো গণতন্ত্র আনতে পারবে না।’ ২০২২-২৩ সালে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ শিরোনামের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর মতে, নেতানিয়াহু এ আন্দোলনের মূল্যবোধের কোনো চ্যাম্পিয়ন নন। তিনি জানালেন, ‘আমরা যে জীবন চেয়েছিলাম, এখনকার ভয়াবহ ঘটনাগুলো তার ঠিক উল্টো।’ এই যুদ্ধ ইরানের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর মনোভাব বদলায়নি।
ইরানে যে সরকারবিরোধী এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে, তা সবারই জানা। বারবার প্রতিবাদ আর দমনের চক্রে এটা প্রমাণিত। ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলন ছিল তার একটি নাটকীয় প্রকাশ। এর আগেও ছিল ২০১৭-১৯ সালের অর্থনীতির প্রতিবাদ, ২০০৯-১০ সালের ব্যাপক গণতান্ত্রিক সবুজ আন্দোলন, এসবের আগে আছে ১৯৯৯ সালের ছাত্রবিদ্রোহ। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর চলেছে সংস্কারের জন্য নির্বাচনভিত্তিক আন্দোলন। ইরানের মানুষ এবং দেশের ভেতরে ও বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান প্রবাসী সম্প্রদায় ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংকোচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা আর আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার।
দীর্ঘদিন ধরে বাইরে একটা তাত্ত্বিক বিতর্ক চলছিল: ইরানে সামরিক হামলা কি এই ঘৃণিত শাসনব্যবস্থা উৎখাতে জনগণকে সাহায্য করবে, নাকি বিরোধীদেরও দেশের পতাকার নিচে সমবেত হতে বাধ্য করবে। এ প্রশ্নের উত্তর এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্ধারিত হচ্ছে। কট্টর সরকারবিরোধী কর্মীও ইসরায়েলি হামলার সমর্থন করার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ, যে হামলায় ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে এরই মধ্যে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হামলার শুরুতে কিছু সামরিক ব্যক্তির মৃত্যুতে কেউ কেউ উল্লাস করেছিলেন, কিন্তু এখন মর্জি পাল্টে গেছে।
তেহরান ৯৮ লাখ মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ শহর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েল যে হামলা চালাচ্ছে, বিক্ষোভ আন্দোলনে যুক্ত নাগরিক সমাজের সদস্যরাও তার শিকার হচ্ছেন। ২৩ বছর বয়সী কবি ও ইংরেজি শিক্ষক পার্নিয়া আব্বাসি প্রথম দিনের হামলায় মা–বাবা, ভাইসহ প্রাণ হারান, যদিও হামলাটি হয়েছিল কাছাকাছি এক ভবনের সরকারি কর্মকর্তাকে লক্ষ্য করে। ৩৫ বছর বয়সী জাহরা শামস ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম, নিজের পছন্দে হিজাব পরতেন। তবে কাউকে বাধ্য করা হোক, সেটা চাইতেন না। ইসরায়েলি হামলায় তিনিও প্রাণ হারান।
আমি যে প্রায় ১০ আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অধিকাংশই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির রাজনীতিকে সমর্থন করেন না। তাঁরা ইসরায়েলে ইরানের হামলাকেও সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁরা ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন; অবকাঠামো ধ্বংসের আশঙ্কায় ভীত।
তেহরানের ২৪ বছর বয়সী এক আন্দোলনকর্মী বলেছেন, ‘আমি ইসলামিক রিপাবলিক সরকার আর খামেনির বিরুদ্ধে আমার সব অস্তিত্ব দিয়ে লড়াই করি, কিন্তু এ মুহূর্তে শাসনব্যবস্থা উৎখাতের কথা ভাবতেও পারছি না। চারপাশের সবার জীবন নিয়েই আমি উদ্বিগ্ন।’
২০২২-২৩ সালের বিক্ষোভের সময় গ্রেপ্তার হওয়া ২৬ বছর বয়সী আন্দোলনকর্মী আমাকে বললেন, তিনি ইসরায়েলি হামলার তীব্র বিরোধিতা করছেন। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমাদের দেশের জন্য বিশাল নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনছে। এটা এক পুরোদস্তুর বিপর্যয়। ইরান-ইসরায়েল দুই দেশেই নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন।’
এক তরুণী আন্দোলনকর্মী তাঁর বয়স্ক ও অসুস্থ মাকে নিয়ে রাজধানী থেকে কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলের দিকে পালানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ড্রোন আর মিসাইলের হুংকারের মধ্যে কি আমার পক্ষে আন্দোলন নিয়ে ভাবা সম্ভব? ইরানে বা ইসরায়েলে, কোথাও বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোকে আমি সমর্থন করি না।’
আলিরেজা গাদিমি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁর ক্যাম্পাসের ইতিহাস দীর্ঘ। বিপ্লবের সময় শাহের বিরুদ্ধে আর ১৯৯৯ সালে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল এটি। বিস্ফোরণের শব্দ, দেয়ালের কাঁপুনি আর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক তরুণ ইরানির মতো পরিবর্তন চাই। কিন্তু এ যুদ্ধ আমাদের সাহায্য করছে না, বরং ধ্বংস করছে। যাদের বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে, তাদেরই কণ্ঠ রোধ করছে।’
ইরানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুদ্ধ আর শাসনব্যবস্থা—দুয়েরই বিরোধিতা করেছেন। এভিন কারাগার থেকে সাবেক উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তফা তাজজাদেহ ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি ইরানে ‘শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ও চেয়েছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি ও নার্গেস মোহাম্মাদি পাঁচজন আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে (যাঁর মধ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পালমে দর বিজয়ী চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহিও আছেন) যুদ্ধের তাৎক্ষণিক অবসান, ইরান ও ইসরায়েলের বেসামরিক হামলার নিন্দা, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন।
‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর পেছনে কয়েক দশকের দমন আর প্রতিবাদের ইতিহাস রয়েছে। অথচ আমার কথা বলা অধিকাংশ প্রবাসী আন্দোলনকর্মী দেশের ভেতরের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে একই মত পোষণ করেন। ইউরোপে বসবাসকারী এক তরুণী বললেন, ‘গাজা, লেবানন এমনকি সিরিয়ায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, নেতানিয়াহু এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চান না। তিনি ইরানের তেল শোধনাগার আর বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা করছেন। স্পষ্টতই তিনি আমাদের জনগণের কথা ভাবছেন না।’
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মেহরাঙ্গিজ কারের সঙ্গে কথা বললাম। ৮০ বছর বয়সী এই মানবাধিকার আইনজীবী ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রিপাবলিকের শুরুতেই বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। প্রায় ২০ বছর আগে তাঁকে ইরান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, নেতানিয়াহু ইরানের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের বন্ধু নন। তিনি আরও বললেন, ‘ইরানে ইসরায়েলি হামলা দেখে মনে হচ্ছে আমার নিজের বাড়ি জ্বলছে। ইরানে কেউই এ হামলার সমর্থন করে না। মানুষ ইসলামিক রিপাবলিক সরকারকে ঘৃণা করে। কিন্তু নেতানিয়াহু আর তাঁর সামরিক নীতিকে আরও বেশি ঘৃণা করে।’
ইসরায়েলের প্রচারণা হয়তো ইরানের শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও কাঁপিয়ে দিতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ইরানের আন্দোলনকর্মীরা মাতৃভূমিতে বিধ্বংসী যুদ্ধকে সমর্থন করবে, এটা কেবল কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
অনুবাদ: মোর্শেদ আলম