ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়া যেন বারবার ফিরে আসা এক দুঃস্বপ্ন! বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর শুধু মৌসুমি অসুখ নয়—এটি প্রায় সারা বছর চলমান এক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সংকট যতটা দীর্ঘমেয়াদি, সরকারের প্রস্তুতি ততটাই অস্থায়ী ও খণ্ডিত। তার ওপর বাড়ছে চিকিৎসার খরচ, ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি।

বছর দেড়েক আগে এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রত্যেক রোগীর গড় খরচ প্রায় ১৯ হাজার টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মুগদা হাসপাতালের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে গড় ব্যয় যেখানে ২৪ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে তা আরও অনেক বেশি। এই ব্যয় সামলানো একজন শ্রমজীবী, নিম্নমধ্যবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কঠিন। এ রকম পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গু এখন নাগরিক জীবনের জন্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং এক বিশাল অর্থনৈতিক বোঝাও হয়ে উঠেছে।

সরকার দাবি করছে, তাদের পক্ষ থেকে ওষুধ সরবরাহ, বিনা মূল্যে পরীক্ষা এবং ডেঙ্গু ইউনিট খোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সমন্বয়হীনতা রোগীদের বাধ্য করছে ব্যক্তিগত ব্যয়ে চিকিৎসা নিতে। কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালেও রক্তের সংকট, প্লাটিলেটের ঘাটতি কিংবা আইসিইউ না পাওয়ার অভিযোগ আসছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এসব সীমাবদ্ধতা বা অব্যবস্থাপনার দায় কেউ নিচ্ছে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে মশকনিধনে অভিযান চলছে ঠিকই, কিন্তু তা কতটা নিয়মিত, সমন্বিত ও টেকসই—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। লার্ভা ধ্বংসে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, যে ওয়ার্ডে বা এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সেখানেই সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম কম।

এমন বাস্তবতায় সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে; আর স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, তারা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা থাকলেও জনগণের দুর্ভোগে তার কোনো ছাড় নেই। ডেঙ্গু এখন কেবল একটি স্বাস্থ্যসংকট নয়, এটি আর্থসামাজিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে। যে রোগে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, রক্ত দিতে হচ্ছে, আইসিইউ লাগে—তা আর সামান্য রোগ নয়।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, ডেঙ্গু দমন করতে হলে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দরকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো সেই মৌসুমি মশকনিধনের প্রচারণাতেই আটকে আছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি কার্যকর, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতিকে বিবেচনায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সরকারের উচিত দেশের হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, প্লাটিলেট ও রক্ত সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ জোরদার করা এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা ফান্ড চালু করা। একই সঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করতে নিয়মিত প্রচার অভিযান চালানোও গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগে কেন বারবার জনজীবন বিপর্যস্ত হবে? নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এমন অবহেলা চলতে পারে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর আস্থা হারালে যে সংকট তৈরি হয়, তা আর শুধু ডেঙ্গুতে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি হয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেবল মৌসুমি অভিযানের বদলে চাই বছরব্যাপী সুপরিকল্পিত কর্মসূচি। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারকে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে

ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়া যেন বারবার ফিরে আসা এক দুঃস্বপ্ন! বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর শুধু মৌসুমি অসুখ নয়—এটি প্রায় সারা বছর চলমান এক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সংকট যতটা দীর্ঘমেয়াদি, সরকারের প্রস্তুতি ততটাই অস্থায়ী ও খণ্ডিত। তার ওপর বাড়ছে চিকিৎসার খরচ, ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি।

বছর দেড়েক আগে এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রত্যেক রোগীর গড় খরচ প্রায় ১৯ হাজার টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মুগদা হাসপাতালের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে গড় ব্যয় যেখানে ২৪ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে তা আরও অনেক বেশি। এই ব্যয় সামলানো একজন শ্রমজীবী, নিম্নমধ্যবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কঠিন। এ রকম পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গু এখন নাগরিক জীবনের জন্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং এক বিশাল অর্থনৈতিক বোঝাও হয়ে উঠেছে।

সরকার দাবি করছে, তাদের পক্ষ থেকে ওষুধ সরবরাহ, বিনা মূল্যে পরীক্ষা এবং ডেঙ্গু ইউনিট খোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সমন্বয়হীনতা রোগীদের বাধ্য করছে ব্যক্তিগত ব্যয়ে চিকিৎসা নিতে। কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালেও রক্তের সংকট, প্লাটিলেটের ঘাটতি কিংবা আইসিইউ না পাওয়ার অভিযোগ আসছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এসব সীমাবদ্ধতা বা অব্যবস্থাপনার দায় কেউ নিচ্ছে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে মশকনিধনে অভিযান চলছে ঠিকই, কিন্তু তা কতটা নিয়মিত, সমন্বিত ও টেকসই—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। লার্ভা ধ্বংসে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, যে ওয়ার্ডে বা এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সেখানেই সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম কম।

এমন বাস্তবতায় সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে; আর স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, তারা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা থাকলেও জনগণের দুর্ভোগে তার কোনো ছাড় নেই। ডেঙ্গু এখন কেবল একটি স্বাস্থ্যসংকট নয়, এটি আর্থসামাজিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে। যে রোগে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, রক্ত দিতে হচ্ছে, আইসিইউ লাগে—তা আর সামান্য রোগ নয়।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, ডেঙ্গু দমন করতে হলে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দরকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো সেই মৌসুমি মশকনিধনের প্রচারণাতেই আটকে আছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি কার্যকর, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতিকে বিবেচনায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সরকারের উচিত দেশের হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, প্লাটিলেট ও রক্ত সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ জোরদার করা এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা ফান্ড চালু করা। একই সঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করতে নিয়মিত প্রচার অভিযান চালানোও গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগে কেন বারবার জনজীবন বিপর্যস্ত হবে? নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এমন অবহেলা চলতে পারে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর আস্থা হারালে যে সংকট তৈরি হয়, তা আর শুধু ডেঙ্গুতে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি হয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেবল মৌসুমি অভিযানের বদলে চাই বছরব্যাপী সুপরিকল্পিত কর্মসূচি। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ