গত বছর ধর্ষণের ঘটনা ৫১৬টি, এ বছর ছয় মাসেই ৪৮১টি
Published: 8th, July 2025 GMT
গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। এর মধ্যে ৫১৬টি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬৭টি। তবে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৮১ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৩৪৫টি।
আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৫টি পত্রিকার খবর সংকলন করে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের এসব তথ্য প্রকাশ করেছে। এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের খবর মাত্র ৩৫টি কম। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নিজ কার্যালয়ে আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র: নারী সাংবাদিকদের ভাবনা’ শিরোনামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সভায় নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে তুলে ধরা তথ্য–উপাত্ত থেকে আরও জানা যায়, গত ছয় মাসে ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে ১৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের পর সবচেয়ে বেশি খবর প্রকাশিত হয়েছে হত্যার। প্রকাশিত খবর অনুসারে, ৩২০ জন নারী ও কন্যা হত্যার শিকার হয়েছেন। ৫১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৩৪ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন।
গত বছর ৫২৮ নারী ও কন্যাকে হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৮১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৪৩ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছিলেন। রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা, শারীরিক নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম, যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যার খবর প্রকাশের আধিক্যও ছিল।
সভায় দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গণমাধ্যম উপপরিষদের সদস্য মুনিমা সুলতানা ও সংগঠনের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান।
প্রতিবেদন দুটিতে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র ও সাংবাদিকদের জন্য করণীয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সমাজের অভ্যন্তরে থাকা নারীর প্রতি বৈষম্যকে দৃশ্যমান করা, নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ তৈরি, প্রকাশিত সংবাদের মধ্য দিয়ে সবাইকে সচেতন করে তোলা, আইনি সহায়তা পেতে সহায়তা করা এবং সহিংসতার বিপরীতে নারীর জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার গল্প তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকেরা সহিংসতার বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। এ ভূমিকা আরও জোরেশোরে পালন করতে হবে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, এখন ‘মব ভায়োলেন্স (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ সহিংসতা)’ দিয়ে আইন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমাজকে নারীবিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমাজে আগেও নারীবিদ্বেষ ছিল। তবে সেটিকে আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে।
বিচার চাওয়ার জায়গায়ও বাধা তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ করে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই আইন সংশোধনের ফলে যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে মামলাপূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতায় যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, যার যার জায়গা থেকে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই মিলে সোচ্চার হলে পরিবর্তন আসবেই।
সভায় সূচনা বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সংবাদমাধ্যমে সহিংসতার অনেক খবর স্থান পায় না। প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। এখন আরও নতুন নতুন ধরন ও মাত্রা নিয়ে নারী নির্যাতন হচ্ছে।
সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সহিংসতার ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা হচ্ছে। নির্যাতনের আসল ঘটনা ছাপিয়ে রাজনীতিই সেখানে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বার্তা সম্পাদক এবং সংগঠনের প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক মাহফুজা জেসমিনের সঞ্চালনায় সভায় সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য দেন শাহনাজ মুন্নী, নাদিরা কিরণ, রীতা ভৌমিক, উম্মুল ওয়ারা সুইটি, জাহিদা পারভেজ, শাহনাজ পারভীন, সেবিকা দেবনাথ, দ্রোহী তারা, রাফিয়া খানম চৌধুরী, জান্নাতুল রুহি, নাসরিন গীতি, সেলিনা আক্তার।
সাংবাদিকদের বক্তব্যে বাসে, পথে চলাচলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের হয়রানির শিকার হওয়া, নারী সাংবাদিকদের চাকরির জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়া, সংবাদমাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের না থাকা, নারীদের প্রতি সহিংসতার খবর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করার প্রবণতা ইত্যাদি উঠে আসে।
এ ছাড়া সভায় নারী নির্যাতনের অবনতিশীল পরিস্থিতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, সবার সম্মিলিত আওয়াজ তোলা এবং গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র শ ক র হয় ছ স গঠন র হত য র জন ন র
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল