বাজার
ঢোলগ্রামের ঘরে ঘরে একটা করে ছোট্ট বাজার আছে। সেই বাজারে সবাই দাসত্ব বিক্রি করে, বাজারের দোকানে তুলে রাখে। মা রাখেন নিঃশব্দতা, বাবা তোলেন স্বপ্নহীনতা, সন্তান বিক্রি করে শৈশব। প্রতিদিন মানুষেরা নিজের আত্মার এক টুকরো তুলে রাখে বাজারে। বিনিময়ে পায় আরাম, নিশ্চিন্ততা, সামাজিক সম্মান। একদিন এক ঘরে এক শিশু বলে ওঠে, ‘এখানে রাখার মতো আমার কিছু নেই। ‘খবর পেয়ে লোকেরা এসে তাকে তিরস্কার করে; বলে, ‘তোমাকে কিছু না কিছু রাখতেই হবে, নাহলে সমাজ চলবে না।’ শিশু বলে, ‘তাহলে, এই সমাজ আমি চাই না।’ লোকেরা শিশুর দেহটাই বাজারে তুলে রাখে।
স্বপ্ন কেন্দ্রঢোলগ্রামে স্বপ্ন কেন্দ্র চালু করার পর কর্তৃপক্ষ বেকায়দায় পড়ে যায়। স্বপ্নগুলো তাদের সহ্য হয় না। তাই তারা স্বপ্ন কেন্দ্রের পাশাপাশি একটা স্বপ্ন সংশোধন কেন্দ্র খুলে বসে। মানুষেরা স্বপ্ন দেখলে কর্মকর্তাদের কাছে নিয়ে আসবে; নিয়ে আসতেই হবে। কর্তারা তা ঠিকঠাক করে মানুষদের কাছে ফেরত দেবেন। দুঃস্বপ্ন নিয়ে আসা নিষিদ্ধ, বিপ্লবী স্বপ্ন নিয়ে এলে জেলে পাঠানো হবে, ভাতের স্বপ্ন দেখলে দেশান্তরিত হতে হবে। একদিন এক বুড়ি তার স্বপ্ন নিয়ে এসে বলেন তার ছেলে গুম হয়েছে। কর্মকর্তা তার এই স্বপ্নকে অবৈধ বলে তাকে জেলে পাঠানোর প্রস্তুতি নিলে, বুড়ি বলেন, ‘আমি জেলে যাওয়ার জন্যেই স্বপ্নটা দেখেছি, হয়তো সেখানে আমার ছেলেকে খুঁজে পেলেও পেতে পারি।’
খাঁচার বাইরেঢোলগ্রামের মানুষেরা একটা প্রকাণ্ড খাঁচার ভেতর বসবাস করে। তারা বোঝে যে খাঁচার বাইরে গেলেই মুক্তি আসবে, কিন্তু চাবি কার কাছে আছে কেউ জানে না। কেউ কখনো তাদের বন্দী করতে আসেনি। তাই বাইরে যাওয়ার চিন্তা কেউ করে না। একদিন একটা পাখি এসে খাঁচায় ঢোকে; তার ঠোঁটে ঝুলে আছে একটা চাবি। সবাই ধরতে চায় পাখিটাকে। কিন্তু পাখিটা এদিক-ওদিক উড়ে এমন এক স্থানে গিয়ে বসে যেদিকে কেউ তাকায় না, খেয়ালও করে না। ছোট্ট একটা মেয়ে সেখানে যায়; পাখিটা তার কাঁধে এসে বসে। সে চাবিটা নিয়ে, দরজা খুলে, বাইরে বেরিয়ে দেখে খাঁচার বাইরে কিছুই নেই।
গ্যাসএকদিন গভীর রাতে ঢোলগ্রামের সব বস্তিতে গ্যাস সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা সকালে নাস্তা বানাতে গিয়ে দেখে গ্যাস নেই। মাঝে মাঝেই এমন হয়, তাই প্রথমে সবার কিছু মনে হয়নি। সবাই যখন নিশ্চিত হলো যে তাদের পাড়ায় গ্যাস আর আসবে না, তখন সামান্য সঞ্চয়টুকু ভেঙে এলপিজির দোকানে সিলিন্ডার কিনতে গেল। তাদেরকে গ্যাস দেবে না বলে, সব দোকানী সিলিন্ডারগুলো খুলে দিয়ে গ্যাস আকাশে উড়িয়ে দিল। তখন মানুষেরা যারা গৃহস্থদের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কাজ করে, তাদের কাছে গেল। বলল, আমাদের রান্না করতে দিন। গৃহস্থরা জানাল, ‘তোমাদের তো মাইনে দেওয়া হয়; তোমরা অর্ডার করে খাও।’
রেইটিংঢোলগ্রামের সব টেলিভিশনে শুধু যুদ্ধ দেখানো হয়। সবাই দেখে, হাসে, কাঁদে, যুদ্ধ নিয়ে কথা বলে। গান নেই, নেই, সিনেমা নেই, কবিতা নেই—শুধু বোমারু বিমান, বোমা, আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আর কান্না। মাঝে মাঝে কিছু পতাকা দেখা যায়, তখন মানুষেরা হাততালি দেয়। ঢোলগ্রামের মানুষদের জন্যে এটাই জীবন। কারা যেন একদিন ঢোলগ্রামের টেলিভিশনের সুইচ বন্ধ করে দেয়। বিচিত্র এক থমথমে নীরবতা ঝাঁপিয়ে পড়ে চারপাশে। উপায় না দেখে সবাই বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে সবুজ ধানক্ষেত, গাছেরা, ঘাসেরা বাতাসে দুলছে। শিশুরা ঘাসের ওপর খেলা শুরু করে। মানুষেরা ভাবে এ এক চক্রান্ত। এক বৃদ্ধ বলেন, ‘আরে না, এটাই আসল।’ বাকি সবাই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যায়। রাতে কেউ ঘুমাতে পারে না। পরদিন টেলিভিশন আবার চলতে শুরু করে, এবার আরও বড় যুদ্ধের ছবি নিয়ে। ঠিক সেই সময়, আকাশ থেকে ঢোলগ্রামের ওপর এক বোমা পড়ে। মানুষেরা সেই লাইভও দেখে। টেলিভিশন আপিসে নির্বাহী উল্লাস করে বলেন, ‘আজকে সেইরম রেইটিং হবে।’
আকাশ বাতাসঢোলগ্রামের আকাশটা দুই দাগে কাটা। দাগটা দেখা যায়। কে যে ভাগ করে দিয়েছে কেউ জানে না। একপাশের মানুষেরা বলে, ‘এই আকাশ শুধু আমাদের; তোরা ভুলেও এদিকে আসবি না।’ দাগের ওপারের লোকেরা বলে, ‘বয়েই গেছে আমাদের ওদিকে যেতে; তোরাও এপারে আসিসনে কিন্তু; খুনোখুনি হয়ে যাবে।’ কিছু মানুষ বাস করে ঠিক মাঝখানে। তারা আকাশের দাগটার দিকে প্রথম প্রথম চেয়ে থাকত; দেখত আকাশের দাগ থেকে রক্ত ঝরছে। তাই তারা আকাশ দেখা বাদ দিয়ে বাতাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাতাস দাগ মানে না।
প্রতিশোধের গন্ধঢোলগ্রামের বাতাসে প্রতিশোধের গন্ধ সারাক্ষণ ভেসে বেড়ায়। মানুষেরা সবাই সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে পথে পথে শত্রুকে খুঁজে ফেরে। ঢোলগ্রামের মানুষদের আর কোনো ধর্ম-কর্ম নেই—প্রতিশোধের গন্ধ শোঁকাই ধর্ম ও কর্ম। এক প্রতিশোধ শেষ হলে আরেক প্রতিশোধ। একদিন এক প্রতিশোধ শেষে আরেক আরেক প্রতিশোধের গন্ধের পথ ধরে এগুতে এগুতে, এক যুবক মাঝপথে গন্ধ ভুলে যায়—সে পথ হারিয়ে ফেলে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে আর গন্ধ পায় না। সে হেসে ফেলে। নিজের হাসিটা, নিজের কাছেই ভালো লাগে। এরপর থেকে ঢোলগ্রামের বাতাসে প্রতিশোধের গন্ধ থাকলেও তাকে আর কেউ খোঁজে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একদ ন এক
এছাড়াও পড়ুন:
বগুড়ায় বাড়িতে হাতবোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ, আহত একজন গ্রেপ্তার
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার একটি বাড়িতে হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার দুপুরে উপজেলার মশিপুর ইউনিয়নের ছোট ইতালি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
বিস্ফোরণে আতাউর রহমান (৩৫) নামের একজন গুরুতর আহত হন। তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আতাউর কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার রামপ্রসাদের চর গ্রামের বাসিন্দা। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।।
গতকালের ওই ঘটনার পরপরই ছোট ইতালি গ্রামের বিস্ফোরণস্থল ঘিরে ফেলেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ডিবি সদস্যরা। উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি তাজা হাতবোমা। বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা এসে উদ্ধার হওয়া হাতবোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করেন। পরে বাড়িটি সিলগালা করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগে আতাউর রহমানসহ কুমিল্লা থেকে আসা চার ব্যক্তি ছোট ইতালি গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী মুক্তার হোসেনের বাড়িতে ওঠেন। মুক্তারের স্ত্রী নাছিমা আক্তার (৪৫) মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মুক্তারের বাড়ির ভেতরে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আশপাশের লোকজন আতঙ্কিত হন। পরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে রক্তাক্ত অবস্থায় আতাউর রহমানকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশকে খবর দেওয়ার পর মুক্তার হোসেনের তিন সহযোগী দ্রুত পালিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন আহত আতাউরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেরাজুল হক বলেন, ঘটনাস্থল থেকে অবিস্ফোরিত হাতবোমা ও কিছু বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। বাগবাড়ি তদন্তকেন্দ্রের উপপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাদিক বাদী হয়ে বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছেন। মামলায় একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ঘটনার সঙ্গে আগামী নির্বাচনে নাশকতার পরিকল্পনার যোগসূত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।