রাজধানীর উত্তরায় প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের চিকিৎসাসেবা চলছে সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক সার্জনদের মেডিকেল বোর্ডের যৌথ মতামতের ভিত্তিতে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ ৪৪ জন এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের আটজনের অবস্থা সংকটাপন্ন।

আজ বুধবার বিকেলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন।

বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে যিনি এসেছেন, প্রত্যেক রোগীর তথ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড ও সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞের যৌথ মতামতের ভিত্তিতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে।

গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ দুপুর ১২টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে প্লাস্টিক সার্জনদের নিয়ে করা মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চং সি জ্যাকের বৈঠক হয়। সেখানে দগ্ধদের চিকিৎসা নিয়ে বিশদ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। চং সি জ্যাক সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট। বুধবার রাতে তিনি ঢাকায় পৌঁছান।

ওই বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, ‘সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিশেষজ্ঞ সার্জন চং সি জ্যাকের সঙ্গে আগেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। তাঁর সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার করেছি। প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে একমত পোষণ করেছেন তিনি। তাইওয়ানে শিশু ম্যাস ক্যাজুয়ালটি (ব্যাপক হতাহতের) নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা আছে। তিনি কিছু কিছু জায়গায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সেইগুলো আরেকটু ভালো করে ফলো (অনুসরণ) করছি। চিকিৎসাপদ্ধতির কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে কোনো রোগীকে বাইরে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো পরামর্শ দেননি।’

অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, ‘ম্যাস ক্যাজুয়ালটি নিয়ে কাজ করা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন। চিকিৎসাসংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত আমরা ভালো সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরে নিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমরা যে প্রটোকল (পদ্ধতি) নিয়ে এগোচ্ছি, আমরা সেই প্রটোকল নিয়েই এগোব। এ বিষয়ে যদি কেউ সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং রোগীদের জন্য যা ভালো হবে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে তা করব। বার্ন ইনস্টিটিউটে এই মুহূর্তে রক্তের কোনো দরকার নেই। দগ্ধদের চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করবে।’

অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, চং সি জ্যাক আলোচনায় কিছু মতামত দিয়েছেন। তার ভিত্তিতে দগ্ধদের তিন ক্যাটাগরি করে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধ মোট ৪৪ জন চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে ‘ক্রিটিক্যাল’ ক্যাটাগরিতে আছে আটজন, ‘সিভিয়ার’ ক্যাটাগরিতে আছেন ১৩ জন আর ২৩ জন আছেন ‘ইন্টারমিডিয়েট’ ক্যাটাগরিতে।

বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, ‘ক্রিটিক্যাল’ হলো, যাঁরা সবচেয়ে বেশি দগ্ধ ও ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে বা একটু উন্নতির দিকে যেতে পারে। ৪০ শতাংশ দগ্ধ রোগীকে ভেন্টিলেটরে (কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস) দিতে হয়েছে; কারণ, তাঁর ইনজুরি অনেক বেশি। ‘সিভিয়ার’ রোগী ভালোর দিকে যেতে পারে বা একটু খারাপের দিকে যেতে পারে। আর ‘ইন্টারমিডিয়েট’ ক্যাটাগরির রোগীরা দ্রুত ভালোর দিকে যায়। তবে সংক্রমণ হলে তাঁদের অবস্থা খারাপ হতে পারে।

অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, ‘ক্রিটিক্যাল’ ক্যাটাগরিতে থাকা আটজনের মধ্যে শিশু বেশি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) মানেই ভেন্টিলেশন ও লাইফ সাপোর্ট নয়। এখানে দগ্ধ রোগীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ মত মত

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ