আবুল হাসানকে নিয়ে নতুন গল্পগাছা ও পূর্বাপর
Published: 4th, August 2025 GMT
মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও নানা পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখাজোখা যেমন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে; তেমনিভাবে বন্ধু, ভক্ত, কবি-সাহিত্যিকদের মুখে মুখে আবুল হাসানের উন্মূল উদ্বাস্তু জীবনের নতুন নতুন গল্পগাছাও শুনতে পাই। এ ধরনের চরিত্রদেরই হয়তো ‘কিংবদন্তি’ বলে। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ যখন ছাপাখানায় চলে গেল, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই কবির জীবনের নিত্যনতুন গল্প শুনতে পাচ্ছি। জীবন ও লেখালেখির অন্যান্য অগ্রাধিকার না থাকলে নিজে উদ্যোগী হয়ে হিরে–মানিকের খনি থেকে আরও কিছু লাবণ্যময় পাথর সংগ্রহ করা যেত। কেননা হাসানের বন্ধুভাগ্য ছিল ঈর্ষণীয়, অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এবং সবার আপন হয়ে ছিলেন। বড় বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি, যাঁরা আমাকে হাসানের গল্প বলেছিলেন, তাঁরা অনেকেই একে একে চলে গেছেন; যেমন জাহিদুল হক, বুলবুল চৌধুরী, ইকবাল হাসান, ভুঁইয়া ইকবাল। আবুল হাসানের জার্মান শিল্পী বন্ধু রাইনহার্ট হেভিকে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। তাঁর গল্পগুলো পেয়েছিলাম কবি স্টিফেন মার্সিনিয়াক ও ওয়াকিল আহমদের কাছ থেকে। বন্ধুর গল্প বলতে বলতে বই লেখা শেষ হওয়ার আগেই রাইনহার্ট চলে যান। বই প্রকাশের পর আবুল হাসানকে নিয়ে নতুন গল্প পেয়েছিলাম সুব্রত বড়ুয়া, ফারুক মঈনউদ্দীন, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, নীরা কাদরী, জাহিদ হায়দার ও আলম খোরশেদের কাছ থেকেও।
একদিন কনকর্ড আর্কেডিয়ায় বই সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি, বর্ষীয়ান লেখক ও সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া বই কিনতে এসেছেন। সৈকত হাবীব তাঁকে অনুরোধ করলেন, আবুল হাসানকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিগুলো আমাকে বলতে। সুব্রতদা ধীরে ধীরে অনেক কথাই বললেন—নিজের বিষয়ে, আবুল হাসান বিষয়ে। সেসব গল্প থেকেই ‘বিদ্যাসাগর’ লেখা। এই গল্পে আমি কল্পনার আশ্রয় নিয়েই লিখেছি যে আহসান হাবীব একদিন বিপ্রদাস বড়ুয়াকে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লিখতে বলেছিলেন। পরে আমি আবিষ্কার করি, বিপ্রদাস বড়ুয়া বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সত্যি সত্যি একটি বই লিখেছিলেন। আরেক দিন সেই ‘প্রকৃতি’তেই কবি জাহিদ হায়দার আবুল হাসানকে নিয়ে দুকথা বললেন। কবির মৃত্যুর পর বিপ্রদাস বড়ুয়া তাঁর কবিতা নিয়ে বিচিত্রায় আলোচনাও করেছিলেন।
ফারুক মঈনউদ্দীনের একটি লেখায় পেয়েছিলাম, তিনি দশম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতা লিখে পুরস্কার পান, এমনকি আল মাহমুদের বদৌলতে বিজয়ী হিসেবে পত্রিকায় তাঁর ছবিও ছাপা হয়। কলেজের ছেলে সেজে কলেজের ছেলেদের রেডিওর সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান করেন। সে সময় তিনি ‘গণবাংলা’ পত্রিকা অফিসে গিয়ে সাবদার সিদ্দিকী, আবুল হাসানদের সাক্ষাৎ পান। তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে, সাবদার সিদ্দিকীর প্রতিই তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। ফারুক মঈনউদ্দীনের স্মৃতিকথার সূত্র ধরে ‘আতর আলী’ লেখাটি।
বিদ্যাসাগরপদার্থবিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয় নিয়ে মাথা গুঁজে নিভৃত হোস্টেল জীবন কাটালেও, কবিতার মতো অপদার্থ বিদ্যাচর্চার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুণ কবি সুব্রতর খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলেন।
জগন্নাথ হলের একটি এক কামরার অধিকারী সুব্রত পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু ঢাকা শহরে সে এখনো নিজেকে খুঁজে পান না। রুমের জানালা পথে ফিরে যান কৈশোরের শহরে। কবিতা আসে, কবিতার ভূত সহজে তাঁকে ছাড়ে না, দীর্ঘ কবিতা লিখিয়ে নেয়। আজ লিখেছেন—
‘আমি আবার ফিরব, ফিরে আসব
আমার এই পুরোনো শহরে,
আমার আবাল্য স্মৃতির পাহাড়,
নদী আর সমুদ্রের মিথুনলগ্নতায়
—খুচরো খেলাধুলোর রঙিন মার্বেলের
মসৃণ শরীরে লেগে থাকে
অবুঝ স্বপ্নের মতো কাদাবালি—’
নিজের লেখা প্রথম কবিতাটি সে চট্টগ্রাম থেকে ডাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন সমকালের ঠিকানায়। এত বড় কবিতার জায়গা সমকালে হবে কি না, সেটা ভাবেননি। সিকান্দার আবু জাফর ছাপলে ছাপুন, না ছাপলে না ছাপুন, এমন একটা ভাবনা থেকে কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর ইত্তেফাকে সমকাল কবিতা সংখ্যার একটা আলোচনা ছাপা হলো। সেখানে কার কার কবিতা ছাপা হয়েছে, কৌতূহলবশে দেখতে গিয়ে সুব্রত নিজের নাম আবিষ্কার করে ফেললেন। গায়ে কাঁপুনি নিয়ে নিউমার্কেটের নিচতলায় সিগনেটের বইয়ের দোকানে গিয়ে হাজির হলেন। মাত্র চার কপি পত্রিকা এসেছিল। শেষ হয়ে গেছে। সুব্রতকে সমকালে চিঠি লিখে পত্রিকার কপি আনাতে হলো।
ঢাকায় এসে সুব্রত কবিতা লেখার পাশাপাশি ইউসিসের কিছু অনুবাদ কাজ করতে শুরু করেছিলেন। এতে কলমটা গতিশীল থাকে, পকেটও ইউসিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরগুলোর মতো ঠান্ডা থাকে, মতান্তরে পকেট গরম হয়।
সুব্রত সেদিন রাতে মেকানিকসের একটা জটিল তত্ত্ব নিয়ে মগ্ন ছিলেন। পুকুর থেকে আনমনে ব্যাঙ ডাকার শব্দ আসছে। এমন সময় দরজায় টোকা। দরজা খুলতেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন এক তরুণ—
‘আমার নাম হাসান। তুমি তো সুব্রত, তা–ই না?’
সুব্রত থতমত খেয়ে ভাবছেন, যাঁকে চেনেন না, তাঁকে ‘তুমি’ বলবে কীভাবে? ‘আপনি’ই বা বলেন কী করে, যেহেতু আগন্তুকের মুখে বন্ধুসুলভ হাসি আর ‘তুমি’ সম্বোধন তাকে খুব কাছে নিয়ে এসেছেন। সুব্রত আপনি বা তুমি কিছুই না বলে ভাববাচ্যের ধূসর সম্বোধনে দাঁড়িয়ে রইলেন। আগন্তুক বললেন, ‘তোমার একটা কবিতা পূর্বমেঘে পড়লাম। তুমি তো মিয়া এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড থিকা মাইরা দিছ!’
সুব্রত আকাশ থেকে পড়লেন। এলিয়টের নামও তিনি শোনেননি, ওয়েস্টল্যান্ড তো পরের কথা। পূর্বমেঘে প্রকাশিত ‘হলুদ বিকেলের গান’ কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের ভিক্টোরীয় যুগের স্থাপত্যের পাশের এক মাদ্রাজি রেস্তোরাঁয় বসে বসে। কখনো চা খেতে খেতে, কখনো আড্ডা দিতে দিতে, কয়েক দিনের অভিন্ন মনোযোগে গোটা কবিতাটি লেখা হয়ে যায়। প্রাচীন এক শহরের বিষণ্ন বিকেলে ক্ষয়ের পাণ্ডুলিপি যেন বা কবিতাটি। হাসান প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইলেন না যে কবিতাটি সুব্রতর মৌলিক সৃষ্টি। তারপর সবকিছু শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি তো মিয়া বিরাট কবি!’ সুব্রতর বুকশেলফে চকিত দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘কী কী পড়তেছ দেখি—মহাভারতের কথা, ডেকামেরন, দস্যু বাহরাম, অবাঞ্ছিত, সঞ্চয়িতা, নাহ বিলাতি কবিতার নামগন্ধ নাই! আচ্ছা, আরেক দিন এসে আড্ডা দিব।’
হাসান চলে গেলেন। সুব্রত ভাবলেন, টি এস এলিয়টের কবিতা তাকে পড়তেই হবে। কী আছে সেখানে, জানা দরকার।
কয়েক দিন পরে রাতে ত্রিমূর্তির আগমন। হাসান, নির্মল আর মামুন। হাসান এসেই বললেন, ‘টাকা দাও তো দেখি!’
‘কিসের টাকা?’ সুব্রত বলল।
‘আমরা ক্ষুধার্ত হে, ভাত খাব! এ জন্যে টাকা চাইছি। দয়া হইলে দাও! নাহলে না খেয়ে থাকি। এই আমি শুইলাম,’ বলেই সুব্রতর ঘরের কোনায় লম্বা করে গুটিয়ে রাখা পাটিটা মেঝেতে বিছিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন হাসান।
‘করো কী, করো কী! এই যে নাও টাকা। ভাত খেয়ে আসো গে।’ সুব্রত রাশভারী কিন্তু গোবেচারা ধরনের মানুষ। হাসানের কার্যকলাপে রীতিমতো বিব্রত।
‘বাহ। তুমি তো দেখছি আমাদের বিদ্যাসাগর!’ মামুন বললেন।
‘কেন, বিদ্যাসাগর হতে যাব কেন আবার?’ সুব্রত বিস্মিত।
‘বিদ্যাসাগর মাইকেলকে টাকা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে রক্ষা করেছিলেন। তুমিও ঠিক তেমনই। মাইকেলের নামে অনেক কুৎসা আছে, অপপ্রচার আছে। আমাদের নামেও শুনতে পার হয়তো। কিন্তু এসব কথায় বিশ্বাস যেয়ো না, বন্ধু। তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে।’ হাসান বললেন।
‘আমি হলের ক্যানটিনে খেয়েছি। এত রাতে আবার ভাত খাব কী?’ সুব্রত বলল।
‘তুমি চা খাবা, চলো। তারপর এসে আবার পড়তে বসবা!’
তাঁরা সুব্রতকে জোর করেই নিয়ে গেলেন চানখাঁর পুলের পপুলার হোটেলে। খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মাইকেলের চিঠি থেকে মামুন অভিনয় করে শোনাতে লাগলেন, ‘আমি যে লোকের কাছে আমার প্রার্থনা জানিয়ে চিঠি লিখেছি, প্রাচীন ভারতীয় ঋষির প্রজ্ঞা ও মনীষা তাঁর, কর্মোদ্যমে তিনি একজন ইংরেজের মতো প্রবল, তাঁর হৃদয় বাঙালি মায়ের মতো কোমল। আমি ঠিকই বলেছিলাম।’
হাসান আর নির্মল হাসতে লাগলেন।
নির্মল আবৃত্তি করলেন,
‘বিদ্যার সাগর, তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!’
সুব্রত কুণ্ঠিত হয়ে একপাশে বসে চা খেতে খেতে ওদের উপহাস আর হইহল্লাময় অভিনয় দেখতে লাগলেন। এই আলটপকা বিদ্যাসাগর উপাধি তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটেও।
হোটেল থেকে ফিরে এসে হাসান আর নির্মল সেই পাটিতেই শুয়ে পড়লেন। সুব্রত বুঝতে পারলেন, তাঁরা আসলেই উদ্বাস্তু ও ভবঘুরে ধরনের কবি। এই দুই কবির যে ছাত্রত্ব নেই, এ কথাও ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে তাঁর। সেদিন তাঁরা তাঁকে আর বেশি বিরক্ত করলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই আকস্মিক অত্যাচারের ঘটনা বাড়তেই লাগল।
একদিন সুব্রত বড়ুয়া আর বিপ্রদাস বড়ুয়া দৈনিক পাকিস্তান থেকে লেখক সম্মানী আনতে গেছেন। সেখানে হাসানের সঙ্গে দেখা। হাসানও সম্মানীর টাকা তুলতে এসেছেন। প্রত্যেকেই সঙ্গে নতুন লেখা নিয়ে এসেছেন। আহসান হাবীবের টেবিলে গিয়ে জমা দিতে হবে। আহসান হাবীব সেগুলো দেখে বিভিন্ন ফাইলে রেখে দেবেন। আজ তাঁর রুমে ঢুকতেই আহসান হাবীব সুব্রতকে বললেন, ‘সুব্রত, তোমার গল্পের হাত ভালো। আমাকে গল্পই দিয়ো। কবিতার জন্য তো হাসানরাই আছে।’ বিপ্রদাসকে বললেন, ‘বিদ্যাসাগরের জীবন নিয়ে তুমি একটা লেখা দাও। বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে একটা বিশেষ সংখ্যা করা হবে।’
হাসান আর সুব্রতর মধ্যে চোরা দৃষ্টিবিনিময় হয়ে গেল। হাসান দুষ্টুমির হাসি হাসছেন।
আহসান হাবীবের রুমে আলাপ–আলোচনা শেষে সবাই নিচে নামলেন। সবার পকেটেই সম্মানীর দশটা করে টাকা। হাসান বললেন, ‘সুব্রত, সব সময় তোমাদের কাছ থেকেই খাই। আজ আমি তোমাদের চা খাওয়াব।’
সুব্রত বললেন, ‘ঠিক আছে, চলো চা খাওয়া যাক।’
হাসান সবাইকে চমকে দিয়ে সাকুরায় নিয়ে এলেন। সুব্রত আর বিপ্রদাস তো বিব্রত। সাকুরায় কেন? এখানে বিদেশি মদ পাওয়া যায় বলে তাঁরা জানেন। সুব্রত বললেন, ‘আমরা তো এসব খাই না, হাসান। চায়ের দোকানে চলো।’ হাসান মৃদু হেসে বললেন, ‘অপেক্ষা করো।’ তারপর কাউন্টারে অর্ডার দিতে গেলেন।
সুব্রত ভাবলেন, হাসান চা-টা কিছু খাওয়াবেন না। তাঁদের টাকা দিয়ে বিলেতি মদ খাবেন বলে এখানে নিয়ে এসেছেন। সুব্রতর মনে পড়ল, একদিন হাসান আর নির্মল ইংলিশ রোডে যাওয়ার সময় সুব্রতকে দেখে দুজন মিলে দুই হাত ধরে সে কী টানাটানি করেছিলেন। হাসান বলছিলেন, ‘তুমি বিদ্যাসাগরের মতো টুলো পণ্ডিতের বেশেই থাকবে? আধুনিক হতে হবে না?’ তাঁদের হাত ছাড়িয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে শেষে রক্ষা পেয়েছিল ছোটখাটো গড়নের সুব্রত।
আজ অগত্যা নাছোড়বান্দা হাসানের অত্যাচার মেনে নিতেই হলো। হাসান যে অপ্রতিরোধ্য, তা তাঁরা ভালোই জানেন। হাসান খেতে চাইলে তাঁরা তাঁদের সাধ্যমতো খরচ দেবেন। সুব্রত আর বিপ্রদাস দুজনই পকেটে হাত দিয়ে ভাবলেন, কিন্তু ত্রিশ টাকায় কি আর একজনের জন্যে বিদেশি মদ হবে? শেষে একটা বেইজ্জতি না হয়ে যায়!
হাসান টেবিলে ফিরে এসে বললেন, ‘বিপদে ফেলে দিলেনাম তোমাদের, তা–ই না? হা হা হা!’ তারপর মজা করে বললেন, ‘মাইকেল বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “আমি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিতেছি যে এ হতভাগার বিষয়ে হস্তনিক্ষেপ করিয়া, আপনি এক বিষম বিপদজালে পড়িয়াছেন! কিন্তু কী করি! আমার আর একটা বন্ধু নাই যে তাহার শরণ লইয়া আপনাকে মুক্ত করি।”’
কিছুক্ষণ পর সবার উৎকণ্ঠা দূর করে টেবিলে এসে পৌঁছল তিন পিস কেক আর তিন পেয়ালা চা। চা খেতে খেতে সুব্রত দেখলেন, পকেটে টাকা থাকলে হাসান কত উদারহাতে খরচ করতে পারেন। আজ হাসান তাঁদের একটা আভিজাত্যময় অভিজ্ঞতার অংশীদার করলেন। আজকের জন্য হাসানই যেন তাঁদের ‘বিদ্যাসাগর’!
.
গল্পটা এখানেই শেষ। কিন্তু গল্পের ‘বিদ্যাসাগর’ নামকরণ আমাকে পূর্ব বার্লিন থেকে লেখা হাসানের জীবনের বিধুরতম একটা চিঠির কথা মনে করিয়ে দিল। কয়েক বছর পরের কথা। পূর্ব বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা যখন হাসানকে জবাব দিয়ে দিলেন, তখন অনেক আশাভঙ্গের বেদনা বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আসার আগে হাসান তাঁর আকৈশোর বন্ধু মাহফুজকে তাঁর আশ্রয় হওয়ার জন্য অনুনয় করে লিখেছিলেন, যাতে তিনি কবিতা লিখে যেতে পারেন আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। দীর্ঘ সেই চিঠিতে অনেক কথার ভেতর হাসান লিখেছিলেন, ‘দেশে ফেরার আগে আমি একজন মসিহ চাইছি। পারফেক্ট একজন মমতা। সেই মমতার দিকে তাকাতে তাকাতে আমি শুধু তোমাকেই দেখলুম, তাই তোমার কাছে এই সমর্পণের চিঠি, আমার কলঙ্ক আর লজ্জার কাব্য।
‘আমি ভিক্ষা চাইছি তোমার কাছে। তুমি আমার জীবনের বাকি অংশগুলো তোমার হাতে তুলে নাও। আমার নিরাপত্তা আমার বসবাস। তুমি কি তোমার করতলের সামান্য জায়গাও আমার জন্য ছেড়ে দিতে পারো না?
‘তুমি আমার একালের বিদ্যাসাগর, মাহফুজ। আমি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নই অবশ্য। কিন্তু তাঁর মতো দুর্ভাগা।’
আতর আলীআজ সন্ধ্যাবেলার দৃশ্যটুকু আবুল হাসান কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। একটা বাক্য লিখছেন, কেটে ফেলছেন; আবারও লিখছেন, অসন্তুষ্টির সঙ্গে দামি রেডিওবন্ড কাগজসুদ্ধই ছিঁড়ে ফেলছেন।
ছবিটা এখনো স্পষ্ট তাঁর চোখে ভাসছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের বাইরে ফুটপাতের চায়ের দোকানে একটা বগলা সিগারেট ধরিয়ে শহীদ কাদরীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। গ্রাম থেকে খাবারের সন্ধানে রাজধানীতে আসা হাজারো মানুষের একজন—একটি মা তাঁর হাড়–জিরজিরে দুধের শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন উল্টো দিকের ফুটপাতে। হয়তো ময়মনসিংহের কাশিগঞ্জ কিংবা দাপুনিয়া থেকে এসেছেন। মায়ের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। আশপাশে জঙ্গল থাকলে তাঁকে মৃত ভেবে সন্ধ্যার অন্ধকারে শেয়াল এসে হয়তো বা টেনে নিয়ে যেত। এখানে জঙ্গল নেই, কিন্তু শেয়াল আছে, দু–পেয়ে। চকরাবকরা মাফলার পরা, তীব্র আতরের ঘ্রাণমাখা এক শেয়াল এসে মেয়েটির হাত ধরে টানছে। বলছে, ‘ভাত খাবি? আয় আমার সঙ্গে।’
উত্তেজনায় বা অল্প পরিশ্রমে হাসান ইদানীং হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আজকাল সহজেই উত্তেজিত হয়ে যান। হলি ফ্যামিলির চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য শওকত ওসমান ভাই ফাঁদ পেতে থাকেন। কিন্তু হাসানের ডেরা খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ! আজ রাতে ঘুমাবেন ফুলবাড়িয়ায় বুলবুলের বাসায় তো কাল ঘুমাবেন নারিন্দার মশাহীন সেই মসজিদে! কিন্তু আজ ঘুমানোর আগে একটা সওয়াবের কাজ করা বাকি আছে। হাসান চকিতে হাতের সিগারেট ফেলে রাস্তা পার হয়ে আতরগন্ধি কুতকুতে চোখের লোকটার মাফলার ধরে এমনভাবে হ্যাঁচকা টান দিলেন যে সেটা চকরাবকরা একটা ফাঁসে রূপ নিল। আশপাশের জনতা ছুটে এলে হাসান তাঁদের ঘটনাটা খুলে বলেন এবং তাঁদের হাতেই বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে সরে এলেন। হাসানের বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে।
রাতে হাসান যখন একটার পর একটা কাগজ ধ্বংস করছিলেন, নির্মল ততক্ষণে বুলবুলের হাতের লাল চায়ে চুমুক দিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলেছেন। হাসান হয়তো সারা রাত জেগে দুটো বা চারটা বাক্য লিখবেন; আর নির্মল হয়তো লিখে ফেলবেন একাধিক কবিতা। নির্মল লিখেছেন—
‘আমি চালের আড়তকে নারীর নগ্নতা বলে ভ্রম করি।
...
তখন রমণী মানে আমুণ্ডু মন্থনযোগ্য সর্বগ্রাসী নাগিনী ছিল না,
তখন রমণী মানে রক্তকাঁপানো সুখে বুকে-মুখে চুমু খাওয়া
অফুরন্ত বাসনা ছিল না, তখন রমণী মানে অন্য কিছু ছিল।’
নির্মল লেখার টেবিল থেকে উঠে ধ্যানস্থ হাসানকে ডেকে বললেন, ‘হাসান, আমার কবিতাটা পড়ছি, শোনো।’
শব্দের গহিন অরণ্যে ডুবে থাকা হাসান চমকে উঠলেন। আরাধ্য শব্দটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় নির্মলের ওপর খুব বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘পড়ে শোনাতে হবে না। ভারি তো আমার শম্ভু মিত্র হইছো! দাও, আমি পড়ি।’ কবিতাটি হাতে নিয়ে ওপর থেকে নিচে দ্রুত চোখ বুলিয়ে হাসান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘বোগাস! সব শালা আতর আলী!’
নির্মল লক্ষ করেছেন, হাসানের শরীর খারাপ। তাই আজ রাতে আর ঝগড়া করলেন না।
পরদিন সকালে পত্রিকা অফিসে যাওয়ার জন্য জামাকাপড় পরছেন, এমন সময় সাবদার সিদ্দিকী এসে হাজির। হাসানের সঙ্গে তাঁর অম্লমধুর সম্পর্ক। খুব একটা পাত্তা দেন না তাঁকে। পাত্তা দিলেই অবান্তর কথার ঝাঁপি খুলে বসবেন, আজেবাজে সব কথা বলবেন। কোথায় যে পান দুনিয়ার সব ফালতু কথা—হাসান ভাবেন। পৃথিবীতে কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকীর একটাই পিস; আর মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে যখন নির্মলেন্দু গুণ ফিরে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে এই কবিকে মুক্ত ঢাকা নগরীতে ঢুকতে দেখা যায়। তাঁর পরনের কুঁচকানো গোলাপি রঙের বেলবটম প্যান্ট আর বেগুনি-হলুদ চেক শার্ট দেখে হাসান বললেন, ‘তোমার সঙ্গে এক রিকশায় যাব কী করে হে?’ এ কথা কানে যেতে নির্মলেন্দু কাঁথার নিচ থেকে মাথা বের করে মূর্তিমানকে দেখে নয়ন সার্থক করে নিলেন। নির্মলকে জেগে উঠতে দেখে সাবদার উল্লসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘ওই ব্যাটা কাপালিক! আমি আমার কবিতার বইয়ের নাম পাল্টেছি! “হে নারী হে ব্রহ্মচারী”নয়, এখন আমার বইয়ের নাম হবে “আমি সেই যীশু পশু শিশু!” সুন্দর হইছে না?’
‘আপদ!’ বলে নির্মলেন্দু পাশ ফিরে শুলেন।
হাসান এখন গণবাংলা পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন। অফিসটা সাকুরা হোটেলের পেছনে। শেষ পর্যন্ত সাবদারের সঙ্গে এক রিকশাতেই অফিসে এসেছেন। রিকশা থেকে নামতেই এক কবি যশোপ্রার্থী কিশোর সাবদারের সঙ্গে নানা কথা বলতে বলতে গণবাংলাতেই ঢুকল। হাসান চেয়ারে বসতে না বসতেই ছেলেটা হাসানের মুখোমুখি। তার হাতে কিছু খাতাপত্র, তবে সবার ওপরে দর্শনীয়ভাবে ধরা আছে হাসানেরই নতুন কবিতার বই ‘যে তুমি হরণ করো’। হাসান নিরাসক্তভাবে দেখলেন। ছেলেটা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ‘আমার নাম ফারুক মঈনউদ্দিন। একটা কবিতা এনেছি!’
হাসান কবিতাটা হাতে নিয়ে পড়লেন, ছেলেটা যা লিখেছে, তা গত রাতে নির্মলেন্দুর লেখা কবিতারই যেনবা প্রতিধ্বনি! লিখেছে—
‘সুস্বাদু খাবারের মোড়ককে আমি রমণীর ছলনা বলে ভুল করি!’
হাসান সত্যি সত্যি খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে সাবদারকে বললেন, ‘পাগলা কবি, টের পাচ্ছ, দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসছে? আর তোমরা শিশু কবি, কিশোর কবি, তরুণ কবি, বুইড়া কবি—সবাই মেতে আছ রমণী নিয়ে! চাউলের আড়তে রমণী, খাবারের প্যাকেটে রমণী, ব্রহ্মচারীর সঙ্গেও রমণীকে মিলাও! আমি তো পাগল হয়ে যাব! এ দেশের সবাই কি আতর আলী হয়ে যাচ্ছে? নারী শব্দটা কি তোমাদের অভিধানে নাই!’
ফারুক নীরবে সরে গেল। আল মাহমুদ তাকে কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দিলেও, আবুল হাসানের স্বীকৃতি পাওয়া যে বেশ কঠিন ব্যাপার, সেটুকু সে বুঝে নিয়েছে।
শহীদ কাদরী আজ সময়ের আগেই একটা সাপ্তাহিক বিচিত্রা বগলদাবা করে চলে এসেছেন। বর্ষা নিয়ে তাঁর একটা মেদুর গদ্য ছাপা হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ র ক মঈনউদ দ ন আহস ন হ ব ব ত ন গল প কর ছ ল ন হ স ন আর ন বলল ন স ব রতর স ব রতক র গল প বল ছ ল জ বন র এস ছ ন র জন য র জ বন পড়ল ন সমক ল ত রপর করল ন একদ ন র একট
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমি যৌবনের পিছনে ছুটছি না, সত্যকে আলিঙ্গন করছি’
বাথটাবে হেলান দিয়ে বসে আছেন অভিনেত্রী কনীনিকা। তার পরনে ঘিয়ে রঙের বাথরোব। হাতে ওয়াইনের গ্লাস। কখনো কাঁধ থেকে খসে পড়ছে তার বাথরোব। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ফটোশুটের একটি ভিডিওতে এমন আবেদনময়ী লুকে দেখা যায় ভারতীয় বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী কনীনিকাকে।
একই ফটোশুটের অন্য একটি ভিডিওর ক্যাপশনে কনীনিকা লেখেন, “চল্লিশের দশক উদযাপন। আমি যৌবনের পিছনে ছুটছি না। আমি আমার সত্যকে আলিঙ্গন করছি। এটা হলো নারীত্বের ‘ভালোবাসা’, যা আমার চল্লিশের দশকে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও শেয়ার করার পর থেকে চর্চায় পরিণত হয়েছেন কনীনিকা ব্যানার্জি। নেটিজেনরা তার প্রশংসা করছেন। একজন লেখেন, “চমৎকার। আমি আপনার চিন্তাকে ভালোবাসি।” কনীনিকার ভাবনাকে সমর্থন জানিয়ে একজন লেখেন, “বয়স কেবলই একটি সংখ্যা দিদি, এটা তুমি প্রমাণ করেছো।” অহনা লেখেন, “তুমি আগুন জ্বালিয়েছো দিদি।” তবে সবাই কনীনিকার সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। কেউ কেউ তাকে আক্রমণ করেও মন্তব্য করেছেন।
আরো পড়ুন:
দায়িত্ব নিয়েই বলছি—সাফা, তুই বিয়ে কর: তৌসিফ
বাবা হলেন শ্যামল মাওলা
কনীনিকার বয়স এখন ৪৫ বছর। এ বয়সে এমন ফটোশুটের বিষয়ে কনীনিকা ব্যানার্জি বলেন, “৪০ বললেই লোকে ধরে নেয় গেল রে বুড়ো হয়ে গেল। এটা একটা ধারণা। কিন্তু বিশেষ করে এখন, আমাদের চল্লিশের সঙ্গে মায়েদের চল্লিশের অনেক তফাৎ।”
কনীনিকার মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও বোটক্স করাননি। কারণ নিজের বয়সকে আরো সুন্দরভাবে তুলে ধরতে চান। কনীনিকা বলেন, “বয়স লোকানোর জন্য বোটক্স ও ফিলার্স কখনো করাব না। বলিরেখার মধ্যেও অন্য সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। এমনকি ওজন কমানোতেও বিশ্বাসী নই। এইভাবে নিজের ৪০ পেরোনো বয়সকে উদযাপন করতে চাই।”
ভারতীয় বাংলা টিভি সিরিয়ালের খুবই চেনা মুখ কনীনিকা ব্যানার্জি। খুব ছোট বয়স থেকে অভিনয় করছেন তিনি। রবি ওঝার ‘এক আকাশের নীচে’ সিরিয়াল দিয়ে অভিনয়ে পা রাখেন। এরপর সিরিয়ালের পাশাপাশি সিনেমা, ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেও নজর কাড়েন এই অভিনেত্রী।
২০১৭ সালে সাতপাকে বাঁধা পড়েন কনীনিকা। প্রযোজক সুরজিৎ হরির দ্বিতীয় স্ত্রী তিনি। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান অন্তঃকরণা। তার ডাকনাম কিয়া। সুরজিতের প্রথম পক্ষের সন্তানের সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক কনীনিকার।
ঢাকা/শান্ত