প্রকাশ্যে মাদকের হাট, অন্তরালে কে?
Published: 27th, August 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকা। একপাশে জেলা প্রশাসক কার্যালয়, অন্যপাশে জেলা রেজিস্ট্রি অফিস। এমন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরের মাঝেই গড়ে উঠেছে ভয়াবহ মাদক স্পট। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলে মাদকের প্রকাশ্য বেচাকেনা। মাদক যেন এখন আর গোপনে নয়, বরং বাজারে সবজির মতো বিক্রি হচ্ছে। এ যেন মাদকের প্রকাশ্যে মাদকের হাট!
এই স্পটের বিষয়ে পূর্বেও একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত অভিযান হয়নি। বরং কিছুটা চাপ এলে মাদক কারবারিরা স্থান পরিবর্তন করে। সম্প্রতি আয়কর অফিসের সামনে জিএনজি স্ট্যান্ড এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠেছে আরেকটি স্পট। ফলে প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন নাগরিকরা।
ইসদাইর ৬ নং ওয়ার্ডের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকায় মাদকের বিস্তার আরও বেড়েছে। আগে সীমিত আকারে চললেও এখন এটি রীতিমতো প্রকাশ্য ব্যবসা।
একজন স্থানীয় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আমরা এমন ভয়াবহ মাদক দেখতে পাইনি। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পর মাদকের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। পরিবার নিয়ে এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দা জানান, এই ব্যবসার সঙ্গে বিএনপির কিছু প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা-কর্মীর যোগসূত্র রয়েছে। তাদের ছত্রছায়া থাকায় সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
গোপন সূত্রের দাবি, মাদক কারবারিদের অনেককে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতে দেখা যায়। এমনকি দলীয় মিটিংয়েও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
একজন বিএনপি কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের দল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শের। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী লোক বিএনপির নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা করছে। এর ফলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা শিগগিরই তাদের নাম প্রকাশ করব।
এলাকার সাধারণ মানুষ বলছে, যারা এই ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলে তারা হামলার শিকার হয়। দেশীয় অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে মাদক ব্যবসায়ীরা। এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতেও ভয় পাচ্ছে।
প্রশাসনিকভাবে এ পর্যন্ত মাদকবিরোধী কোনো বড় অভিযান হয়নি। প্রশাসন চাইলে চিরুনি অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করতে পারত বলে মনে করছেন সচেতন মহল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—কেন প্রশাসন নিরব?
অনেকে মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা, তাই পুলিশও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না বা নিতে চাইছে না।
স্থানীয়দের মতে, মাদকের কারণে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আসক্ত হয়ে পড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে অপরাধ। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, পারিবারিক অশান্তি—সবকিছুর পেছনেই মাদককে দায়ী করছেন তারা।
একজন অভিভাবক জানান, আমাদের ছেলেরা রাতে বাড়ি ফেরে না। মাদকের নেশায় তারা চুরি করে, মারামারি করে। পরিবার ভাঙছে। সমাজ অস্থির হয়ে পড়ছে।
সচেতন নাগরিকদের দাবি, খাল-বিল পরিস্কার করার আগে সমাজ থেকে মাদক পরিষ্কার জরুরি। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে না তুললে প্রশাসনের পক্ষে একা সফল হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য রাজনৈতিক নেতাদেরকেও নিজেদের দলে থাকা মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
সবাই এখন এক প্রশ্ন করছে—এই মাদক ব্যবসার আসল হোতা কারা? কে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা প্রশাসনকে অকার্যকর করে রেখেছে? অনুসন্ধান সূত্র বলছে, স্থানীয়ভাবে কিছু বিএনপি নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা আছে। তবে এর পেছনে আরও বড় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা, তা জানতে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
ফতুল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ শরিফুল ইসলাম জানায়, আমরা বিষটি অবগত হয়েছে , দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুর কাছেই যখন প্রকাশ্যে মাদকের হাট বসে, তখন প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্রযন্ত্র কি অকার্যকর হয়ে পড়েছে? প্রশাসনের বার বার অভিযানের পরেও কিভাবে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হয় তাও ডিসি ও এসপি অফিসের সামনেই এই নিয়ে হতাশ সাধারণ মানুষ।
এলাকাবাসীর প্রত্যাশা—রাজনৈতিক ছত্রছায়া ভেঙে দ্রুত চিরুনি অভিযান চালানো হোক। না হলে অচিরেই এই শহর মাদকের নগরীতে পরিণত হবে।
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ প রক শ য র জন ত ক ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫