Risingbd:
2025-11-03@07:52:10 GMT

কলম্বো ছেড়ে এবার বাড়ির পথে

Published: 18th, January 2025 GMT

কলম্বো ছেড়ে এবার বাড়ির পথে

বিকালে এখানকার সবচেয়ে বড় আর প্রসিদ্ধ গ্রেগরি লেকে ঘুরতে গেলাম। শ্রীলঙ্কার ইকোনমিক অবস্থা তেমন ভালো না। তাই নতুন সরকার পর্যটন খাত থেকে ইনকাম বাড়ানোর জন্য সব পর্যটন এলাকায় এন্ট্রি ফি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই লেকে প্রবেশের জন্য দিতে হবে ৬০০ রুপি। যদিও বাংলাদেশের টাকায় মাত্র ২০০ টাকা, তাও আমাদের মতো বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য বিদেশে এসে এ টাকাও গায়ে লাগে। কিছুদূর হাঁটার পর লেক ভিউসহ একটা কফিশপ পেয়ে গেলাম। জায়গাটা ভারি সুন্দর আর নিরিবিলি। দেখে খুব বসতে ইচ্ছা করল ৷ ৫০০ রুপিতে কফি অর্ডার করে ফেললাম। ছোট কেটলিতে প্রায় তিন কাপ কফি দিয়ে গেল। বাহ! সুন্দর হীম শীতল পরিবেশে এমন ধোঁয়া ওঠা কফি পেয়ে মন আরো চনমনে হয়ে উঠল। 

পরবর্তি গন্তব্য বহু প্রতীক্ষিত অ্যাডামস পিক বা শ্রীপদ। যা সব ধর্মের লোকের তীর্থ স্থান বলে স্বীকৃত। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের শ্রীপাড়া প্রদেশে অবস্থিত এই পর্বত চূড়া যা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের কাছে অতি পবিত্র স্থান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্নটি গৌতম বুদ্ধের, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্নটি তাদের দেবতা শিবের এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন এটি পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ:)-এর পদচিহ্ন। নুয়ারা এলিয়া হয়ে হাটর্ন, গাড়ি পাল্টে মাস্কেলিয়া থেকে ডালহাউজি হয়ে ভেলিগামা মাদাস্তুতা, এরপর নাল্লাতান্নি, বাসে বাসে দিন পার। শ্রীলঙ্কার এক প্রান্ত থেকে চলে এলাম অন্যপ্রান্তে। ছিলাম সাগরে, সেখান থেকে পাহাড়ে। এই চূড়ায় একটি পায়ের ছাপ আছে যার দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। উচ্চতা ২২৪৩ মিটার বা ৭৩৫৯ ফুট। 

চূড়া পর্যন্ত উঠতে পার করতে হবে ৫৫০০ কংক্রিটের সিঁড়ি। পাহাড়ের চারপাশের বনাঞ্চল নানা ধরনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার। যেখানে হাতি থেকে চিতাবাঘ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির এবং অনেক স্থানীয় প্রজাতি বাস করে। এই পর্বতকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর জলস্রোত ভাগ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কেলানি নদী, ওয়ালাওয়ে নদী এবং কালু গঙ্গা নদীর প্রধান উৎস। 

নাল্লাতান্নির একটা হোটেলে ব্যাগ রেখে আমরা এডামস পিকের দিকে রওনা হলাম। তখন প্রায় বেলা ৩টা বেজে গেছে। মূলত সবাই রাতে যাত্রা শুরু করলাম ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্য। আমাদের হাতে সময় কম, তাই বিকেলের গোধূলি লগ্ন উঁচু পাহাড় দেখব বলে হাঁটা শুরু করলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা একটু বিরক্তিকর বটে। শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগে পর্বতারোহী রিফাত ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন কষ্ট করে চূড়াতে উঠে আপনি হতাশ হবেন। উঠেই যাচ্ছি কিন্তু এই সিঁড়ি যেনো আর শেষ হয় না। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দিগন্ত রেখা দেখব বলে যে আশা করেছিলাম পাহাড়ের উপরের দিকে মেঘের কোলে তা ঢাকা পড়েছে। আমি পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম, সায়েমকে আর খুঁজে পেলাম না। চূড়ার কিছু দূর আগে পোল্যান্ডের সায়মনের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমার হাতের ক্যামেরা তাকে দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলতে অনুরোধ করলাম। সে তার ফোন আমাকে দিল ছবি তুলে দিতে। সায়মন সাউথ এশিয়াতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন মাস ধরে। কোনো বাংলাদেশীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। তার ভ্রমণ তালিকায় বাংলাদেশ আছে জেনে আমিও বেশ উৎসাহ দেখালাম এবং নিমন্ত্রণ জানালাম। 

বিদায় নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। যদিও আমাদের আবার নিচে দেখা হয়েছিল এবং পরবর্তিতে সায়মন বাংলাদেশেও এসে আমার বাড়িতে থেকেছে। চূড়ার যত কাছে যেতে থাকলাম তত ঠান্ডা লাগা শুরু হলো। উইন্ডশিলটা গায়ে পরে নিলাম। একদম উপরে উঠে জুতা খুলতে হয়। একটা মন্দিরের মতো ঘর তৈরি করা আছে, তার চারপাশে পুণ্যার্থীরা বসে আছে। হিম শীতল থমথমে পরিবেশ। পদচিহ্নর জায়গা খানিকটা উঁচু এবং পুরাটাই ঢেকে রাখা। অল্প একটা অংশ পূজার জন্য খোলা রাখা আছে। বিশাল আকারের একটা ঘণ্টা রাখা আছে, একেকজন আসছে আর লম্বা দড়িতে ঝোলানো লোহার পাত দিয়ে সেই ঘণ্টায় আঘাত করা মাত্র তার প্রকট শব্দে চারপাশ প্রকম্পিত হচ্ছে। মনে হলো সেই ঘণ্টার শব্দে পর্বতজুড়ে দৈববাণী করতে করতে কেউ অবতরণ করবে। 

ঘুরে ফিরে দেখে কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিলাম। পাশে বসা একজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলো। তার থেকে জানলাম এখানে বছরের একটা সময়ে ডিসেম্বরের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত পুণ্যার্থীদের ব্যাপক সমাগম হয়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় লক্ষ করলাম ভারী ভারী বস্তা নামাচ্ছে শ্রমিকেরা। ভালো করে দেখলাম তাতে তালা লাগানো আর ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। আসলে উপর থেকে পয়সার বস্তা নামানো হচ্ছে। ‘পিকে’ সিনেমার ‘ডার কা বিজনেস’র কথা মনে পড়ে গেল। পৃথিবীর সব জায়গায়ই এসব চলছে। চূড়ায় ওঠানামার সময় অসংখ্য খাবারের দোকান, এবং বাহারি জিনিসের দোকান চোখে পড়বে। অনেকে থেমে থেমে চা-পানি খেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আমি মোটামুটি আড়াই ঘণ্টার মধ্যে টপে উঠে গিয়েছিলাম। এই চূড়ায় এসেছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং মার্কো পোলো। 

ফিরতি টিকিট থাকায় এক জায়গায় বেশিদিন থাকার সুযোগ ছিল না। এডামস পিক থেকে আমরা চলে আসি মিরিসসা। আবার স্বচ্ছ সুন্দর সমুদ্রতট। একবার দেখলে বারবার দেখার ইচ্ছা জাগে মনে। মিরিসসার কোকোনাট হিল জায়গাটা বেশ প্রসিদ্ধ। একবার হলেও এই জায়গায় পর্যটকরা যাবেই। এখানেও স্কুবা, স্নোরকলিং, সারফিংয়ের ভালো আয়োজন আছে। এরপর হিরিকিটিয়াতে এক রাত থেকে ‘গল’ চলে আসলাম। সমুদ্রতীরে ডাচদের বানানো গল ফোর্ট ইতিহাসের অনন্য সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে আছে। চারপাশে সমুদ্র আর বিশাল এলাকাজুড়ে এই দুর্গের বিস্তৃতি। ১৬০০ শতাব্দিতে পর্তুগিজরা এ অঞ্চলে আসা শুরু করে। এই দুর্গের সঙ্গে সমুদ্র বন্দর ছিল এবং এখানে ইবনে বতুতার জাহাজ নোঙ্গর করেছিল। এখানে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে পুরনো লাইব্রেরি আছে, ডাচ স্ট্রীটে। নির্মাণকাল ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ।  

গল ফোর্টের সীমানায় মেরিটাইম মিউজিয়াম এবং গল মিউজিয়াম রয়েছে। খুব সুন্দর একটা মসজিদ রয়েছে গল ফোর্টের পাশে। রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ইফতারের টাইমে মসজিদে প্রবেশ করে সাজানো ইফতারির সারিতে এসে বসলাম। কাঞ্জি নামে এক ধরনের খিচুড়ি, স্যুপের মতো খাবার পরিবেশন করা হলো। বেশ অন্যরকম তবে উপাদেয়। রমজানে এই কাঞ্জি ছাড়া ইফতারের কথা এখানে কেউ ভাবতে পারে না। সঙ্গে থাকে খেজুর, ফল ও পানি। কাঞ্জিতে ডালের সঙ্গে মুরগির মাংস মিহি করে মিশিয়ে দেয়া হয়। এর সঙ্গে নারকেলের দুধ এবং আরো কিছু উপকরণ আছে। খেতে ভালোই লাগল। 

গলের ডাচ কলোনি বেশ পরিপাটি, সুন্দরভাবে সাজানো। অনেক বাড়িতে এখন যাদুঘর, রেস্টুরেন্ট এবং থাকার হোটেল বা গেস্ট হাউজ বানিয়েছে। পর্যটকরা রেড ফোর্টে থাকার স্বাদ নিয়ে নিতে পারে। গলের সমুদ্রতট মন ছুঁয়ে দেয়। বিকালের এক চিলতে রোদ ওই দূর আকাশ থেকে ঠিক সমুদ্রে আছড়ে পড়েছে। আলোর আঁকিবুঁকিতে আকাশে কেউ যেন ছবি এঁকেছে। অনেকক্ষণ শুধু চেয়েছিলাম। তাও চোখ জুড়ালো না। এ কি সুন্দরের মাঝে বিধাতা এনে দাঁড় করাল! চোখ ফেরানো দায়। দারুণ একটা বিকেল কাটিয়ে দিলাম! নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসেন এই ফোর্টে ঘুরতে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া ডিপার্টমেন্ট থেকে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী এসেছে। দল বেঁধে ছবি তুলছে ফোর্টের কর্নারে উঁচু জায়গা থেকে। সমুদ্রের বিশালতা সঙ্গে দিগন্তরেখার লাল আভা, মিলেমিশে একাকার। কি অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি! 

এখানে ব্রিটিশদের তৈরি ঐতিহাসিক এবং সবচেয়ে প্রাচীন লাইট হাউজ রয়েছে যার নির্মাণকাল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ। উচ্চতা ৮৭ ফিট। এই লাইট হাউজের আলো ১৯ কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যায়। একে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এখন আর পর্যটকদের উপরে উঠতে দেওয়া হয় না। বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম ভালো করে। নানা এঙ্গেলে ছবি তুললাম। সাদা ধপধপে এই লাইট হাউজ দূর থেকে দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে। 

পরদিন গল রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভোরবেলা কলম্বো শহরের ট্রেন ধরলাম।  সমুদ্রের পাড় ধরে এত সুন্দর রেললাইন হতে পারে ধারণাতেও ছিল না। গল থেকে কলম্বো আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা দশ মিনিট সময় লাগল। ভোরের দিকে যখন ট্রেনে চড়েছিলাম তখন তেমন যাত্রী ছিল না। একটা ছেলের সঙ্গে কথা হলো, সে পড়াশোনা করছে, একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। আবার বিকালেই ফিরে যাবে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার ফিরে আসবে ট্রেনে চেপে। চলতি পথে কতজনের সঙ্গে দেখা হয় কথা হয়। তারা আমাকে ভুলে যাবে, আমিও ভুলে যাবো ওদের। পথের আলাপ পথেই পড়ে থাকবে; পড়ে থাকে বেশির ভাগ সময়ই। 

আলো ফুটতে শুরু করলে স্থানীয় মানুষজনের ভিড় বাড়তে লাগল। বেশিরভাগ মানুষ কাজের জন্য শহরের দিকে যাচ্ছে। আমি কলম্বো শহর ছাড়িয়ে বাড়ির পথে যাব। ট্রেনের কু-ঝিকঝিক শব্দের মধ্যে বুঁদ হই আর বিস্তৃর্ণ নীল জলের দিকে তাকিয়ে থাকি। জলের তলায় অপার্থিব যে মায়াবি দুনিয়া আছে মনজগত সেখানে প্রবেশ করে। বাহারি রঙের মাছেরা আমার সামনে দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, আমি তাদের ধরতে গেলে এক ঝলকে দূরে চলে যাচ্ছে। সাগরের জল মনে হয় আজ অনেক শীতল। আমার মনের মধ্যেও অন্যরকম শীতলতা অনুভব করছি। (শেষ)  
 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য ব স কর কলম ব করল ম র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ