চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ‘মব’ সৃষ্টি করে সাংবাদিকের ওপর হামলা
Published: 20th, October 2025 GMT
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ‘মব’ সৃষ্টি করে এক সাংবাদিকের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। আহত অবস্থায় ওই সাংবাদিককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের রেলগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
আহত সাংবাদিকের নাম লিটন কুমার চৌধুরী। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি এবং সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাড়ি সীতাকুণ্ড পৌর সদরের রেলগেট এলাকাতেই।
লিটন কুমার চৌধুরীর ওপর হামলার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘সীতাকুণ্ড সম্মিলিত নাগরিক কমিটি’ নামের একটি ফেসবুক পেজে দেওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক লিটনকে ঘিরে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন লিটনকে মারধর করছেন। লিটনকে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’, ‘মিথ্যা নিউজ ছড়ানোর হোতা’ ইত্যাদি সম্বোধন করা হচ্ছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মারধরের পর রক্তাক্ত অবস্থায় লিটন চৌধুরীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ লিটন চৌধুরীকে সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
লিটন চৌধুরীর ছেলে রাকেশ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাতে তাঁর বাবা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় হঠাৎ কয়েকজন যুবক এসে তাঁর বাবাকে উদ্দেশ্য করে নানা রকম বাজে মন্তব্য করেন এবং তাঁকে মারধর করতে থাকেন। তাঁর বাবার মুঠোফোন ও মানিব্যাগও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। হামলায় তাঁর বাবার মাথায় গুরুতর জখম হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের সভাপতি এস এম ফোরকান আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘মব করে সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। হামলাকারীদের ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, কয়েকজন যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় লিটন চৌধুরীকে থানায় নিয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। তাঁকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হামলার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল টন চ ধ র
এছাড়াও পড়ুন:
রটে গেছে—নির্বাচন হবে না, এই গুজব কেন?
গুজব কী? এর সরল অর্থ হলো মিথ্যা রটনা। কেউ এমন একটা কিছু বলল, যেটা বাস্তবে নেই, কিন্তু সেটাকেই সত্য বলে প্রচার করা। কথায় আছে, একটা মিথ্যা বারবার বললে সেটি সত্য হয়ে যায়। মানুষ সেটিই বিশ্বাস করতে থাকে। তখন আসল সত্যটি হারিয়ে যায়। আর আসল সত্যের কথা তখন কেউ যদি উচ্চারণ করে, সে পড়ে যায় মহাঝামেলায়।
একটা প্রবচন আছে, ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’। শব্দশিল্পীরা চমৎকার কিছু কথা আউড়ে গেছেন, যেমন ‘মিথ্যার মতো সুন্দর’ কিংবা ‘সত্যের মতো বদমাশ’।
ইন্টারনেট ঘেঁটে গুজব প্রসঙ্গে বেশ কিছু উদ্ধৃতি পেয়েছি। একেকটা উদ্ধৃতির সঙ্গে বিখ্যাত কোনো মনীষীর নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না:
১. গুজব হলো অপ্রমাণিত সত্যের ছদ্মরূপ: মার্ক টোয়েন।
২. গুজব ছড়ানো সহজ, কিন্তু তা মোকাবিলা করা কঠিন : আলবার্ট আইনস্টাইন।
৩. যে ব্যক্তি গুজব বিশ্বাস করে, সে নিজের বিচারক্ষমতা হারায় : হেলেন কেলার।
৪. যে তথ্য যাচাই ছাড়া ছড়ায়, তা গুজবের সমতুল্য : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫. গুজবের প্রভাব কখনো হালকা হয় না: নেলসন ম্যান্ডেলা।
৬. গুজব মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং বিশ্বাসকে ক্ষয় করে : চার্লস ডিকেন্স।
৭. গুজব হলো অজ্ঞতার ফল : লিও তলস্তয়।
৮. গুজব ছড়ানো মানে অন্যের মানহানি করা : উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
আরও পড়ুনফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে যা ঘটবে, সেটা বহন করার মতো শক্তি আমাদের নেই২৩ অক্টোবর ২০২৫মানুষ অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়। তারপর ঠেকে শেখে। ওপরের বাক্যগুলো নীতিকথা মনে হলেও এসবই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত উপলব্ধি।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। মুসলমানের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে পবিত্র কোরআন। দেখা যাক সেখানে এ প্রসঙ্গে কী বলা হয়েছে। সুরা বনি ইসরাইলের ৩৬ নম্বর আয়াতে তিনি বলছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তা অনুসরণ কোরো না। কান, চোখ, মন—প্রত্যেকের কৈফিয়ত তলব করা হবে।’
এ দেশে আমরা অনেকেই ‘হুইন্যা মুসলমান’। আমাদের যা বলতে ও করতে নিষেধ করা হয়েছে, আমরা তা-ই বেশি বেশি করি। আমরা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াই, ঝগড়া তৈরি করি। কেন করি? আমার মনে হয়, এর পেছনে দুটি কারণ আছে।
যদি ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বছর ধরি, তাহলে যেসব সমস্যার সমাধান গত ৫৪ বছরে হয়নি, বা ১৯৪৭ সালকে যদি ভিত্তি বছর ধরি, তাহলে যার সুরাহা গত ৭৮ বছরে হয়নি, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকিয়ে দিতে পারলেই কি সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে?এক. কোনো একটা মতলব থেকে আমরা মিথ্যা প্রচার করি, গুজব রটাই। একটা মিথ্যাকে আমরা এমন নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করি যে মানুষ সেটি বিশ্বাস করে পঙ্গপালের মতো ছোটে। দুই. সমাজে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক আছে। তারা কাউকে ভালো থাকতে দেয় না। গুজব রটিয়ে মজা পায়। এটা তাদের কাছে বিনোদন। তাদের রটনায় সমাজের যে কত ক্ষতি হয়ে যায়, এ নিয়ে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ এক আজব জিনিস বানিয়েছেন—ফেসবুক। আমরা এর একটা গালভরা নাম দিয়েছি—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তো জাকারবার্গের ফেসবুক এখন একটা গুজবের আড়ত। সম্পাদনার বালাই নেই। মূলধারার গণমাধ্যমে সবার প্রবেশাধিকার নেই।
আরও পড়ুনজাতীয় নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা ও সতর্কতাগুলো কী০১ ডিসেম্বর ২০২৫কিন্তু ফেসবুক হচ্ছে উন্মুক্ত মাধ্যম। এখানে সবাই স্বাধীন, যখন যা খুশি বলতে পারছেন, উগরে দিচ্ছেন। আজকাল এখান থেকেই হচ্ছে সাংবাদিকতা। একে বলা যায় ফেসবুক সাংবাদিকতা। এখানে সংবাদের উৎস হলো ফেসবুকে পাওয়া খবর। যে যা খুশি বলছে, লিখছে। ওপরে ছড়ি ঘোরানোর কেউ নেই।
শুরুতে মনে হয়েছিল, মূলধারার গণমাধ্যমে যে সিন্ডিকেট কাজ করে, তার দেয়াল ভেঙে মুক্ত সাংবাদিকতার স্ফুরণ ঘটবে। মুশকিল হলো, সবার তো শিক্ষা, রুচি আর লক্ষ্য এক নয়। ফলে একটি সম্ভাবনাময় গণযোগাযোগের মাধ্যম এখন মূর্খ আর ভাঁড়দের ভাগাড়ে পরিণত হতে চলেছে। ক্রমাগত চলছে মিথ্যাচার, অপতথ্য ছড়ানো আর চরিত্রহনন। আর আছে অশ্রাব্য শব্দের ব্যবহার, যেটাকে আমরা বলি স্ল্যাং। বাক্যে ও বক্তব্যে স্ল্যাং ব্যবহারের একটা প্রতিযোগিতা চলছে। যাঁরা শোভন ও সুশীল হিসেবে সমাজে পরিচিত, তাঁরা অনেকেই বাজার পাওয়ার লোভে এই জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন।
একটি পত্রিকায় কিংবা টিভি চ্যানেলে আপনি কাউকে অমুক চতুষ্পদের বাচ্চা বলে গালি দিতে পারবেন না। কিন্তু ফেসবুকে তা পারবেন অনায়াসে। যে কথা আপনি আপনার মা–বাবা বা সন্তানের সামনে উচ্চারণ করতে লজ্জা পাবেন, তা অবলীলায় ঝেড়ে দিচ্ছেন ফেসবুকে।
আরও পড়ুনমেডলিং, ডিপফেক, গুজব ও অপতথ্যের সুনামি ঠেকাবেন কী করে ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে গুজব। মূলধারার মাধ্যমগুলো এর মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা এখন ‘ফ্যাক্ট চেকার’ দিয়ে তথ্য যাচাইয়ে নেমেছে। কিন্তু তারা অনেকটাই অসহায়। মিথ্যার শক্তি বড় বেশি। মানুষের হাতে হাতে মুঠোফোন। ভাত-কাপড়ের পর এটি জীবনযাপনের প্রধান উপকরণ আর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে।
এতক্ষণ মন খারাপ করা কিছু কথা বললাম। এবার আসি একটি সাম্প্রতিক বিষয়ে। বিষয়টি রাজনৈতিক। দেশে একটা নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, রোজা শুরু হওয়ার আগে। অনুমান করি, নির্বাচনটি হবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলেই জানা যাবে কোন তারিখে হবে ভোটাভুটি।
ইতিমধ্যে রটে গেছে, নির্বাচন নাকি হবে না। কয়েকজন বেশ জোরের সঙ্গেই এ কথা বলছেন। এটা শঙ্কা বা গুজব যা-ই হোক না কেন, সেটি ভালো বাজার পেয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, নির্বাচন হবে না।
আরও পড়ুনস্বৈরাচারীর সাইবার বাহিনী, গুজব ও সামনের লড়াই১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪যথাসময়ে নির্বাচন না হওয়ার তিনটি কারণ থাকতে পারে। এক. বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাবে না; দুই. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন খারাপ হবে যে নির্বাচনের আয়োজন করা আদৌ সম্ভব হবে না; তিন. ভয়ংকর রকমের একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে, যেখানে অগুনতি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া নির্বাচন সময়মতো না হওয়ার আর কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আগেভাগেই নেতিবাচক প্রচারণার কারণে মানুষের মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে যেতে হবে। কারণ, এটি ‘অন্তর্বর্তী’। একটি নির্বাচনই কেবল এই সরকারকে একটি এক্সিট দিতে পারে। ওপরে যে তিনটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেছি, তার কোনো একটি না ঘটলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
নির্বাচন না হলে এর চেয়ে ভালো কী হবে, সেটি বোঝা যাচ্ছে না। সমাজে একটি মত আছে—নির্বাচন করে লাভ কী? এতে কি জনগণের মুক্তি আসবে? আমাদের
সব ইহজাগতিক সমস্যার সমাধান হবে? জানি, হবে না। কিন্তু নির্বাচন না হলে কি সব সমস্যার চটজলদি সমাধান হয়ে যাবে?
যদি ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বছর ধরি, তাহলে যেসব সমস্যার সমাধান গত ৫৪ বছরে হয়নি, বা ১৯৪৭ সালকে যদি ভিত্তি বছর ধরি, তাহলে যার সুরাহা গত ৭৮ বছরে হয়নি, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকিয়ে দিতে পারলেই কি সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে?
সুরা হুজুরাতের ৬ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, যদি কোনো সত্যত্যাগী তোমাদের কাছে কোনো খবর আনে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজান্তে তোমরা (তাদের আনা খবর শুনে) কোনো জনগোষ্ঠীকে আঘাত না করে বসো এবং পরে তোমাদের কাজের জন্য লজ্জা না পাও।’
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
[৫ ডিসেম্বর ২০২৫ প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা ‘গুজবে সয়লাব দেশ, আমরা কী করিব’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]