আড়াইহাজারে জনতার হাতে আটক সেই কনস্টেবল প্রত্যাহার
Published: 25th, January 2025 GMT
আড়াইহাজারে ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সহযোগিতার অভিযোগে জনতার হাতে আটক ইমরান হোসেনকে (কনস্টেবল নম্বর ১১৮৪) প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সহকারী পুলিশ সুপার (সি- সার্কেল) মেহেদী হাসান। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন বলে জানান এএসপি।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে উপজেলার ব্রাক্ষন্দী ইউনিয়নের মারুয়াদী এলাকা থেকে ইমরানকে আটক করা হয়। আটক কনস্টেবল জেলার রূপগঞ্জ থানায় কর্মরত। ঘটনার দিন তার ডিউটি ছিল বাণিজ্য মেলায়।
মাসুম উপজেলার মারুয়াদী দেওয়ান পাড়া গ্রামের নাঈমের ছেলে। কনস্টেবল ইমরানের বাড়ি চাদঁপুর জেলায়। এক সময় তিনি আড়াইহাজার থানায় কর্মরত ছিলেন।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে মারুয়াদী এলাকায় বেশ কয়েকজন যুবকের সঙ্গে মিশে ইমরান বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছিলেন।
অভিযোগ আছে, তিনি পুলিশের পোশাক ও হ্যান্ডকাপ ব্যবহার করে ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সহযোগিতা করেন। এ অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল ইমরান ও মাসুম নামে ২ জনকে আটক করে জনতা পুলিশের হাতে তুলে দেন।
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ইমর ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইসলামে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ধারা
নানা ধর্মের উৎস কী, কেমন করে সেগুলোর বিকাশ ঘটল, তাদের মূল নীতিমালাই–বা কী, কোথায় তাদের পরস্পরের সঙ্গে মিল, আর কোথায় অমিল—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় যে শাস্ত্রে, তার নাম তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব।
সহজ করে বললে, এটি ধর্মগুলোর ইতিহাস আর বিশ্বাসের ভিন্নতা নিয়ে কথা বলে। তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, পারস্পরিক মিল আর অমিলের জায়গাগুলো তুলে ধরে। এই শাস্ত্র পাঠের উদ্দেশ্য একটাই—ধর্মের প্রকৃতিকে জানা, আর তার অনুসারীদের বোঝা।
ধর্মতত্ত্ব হলো বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসগুলোকে দর্শনের ভাষায় প্রকাশ করার মাধ্যম। এর প্রয়োজন কেন? ধর্ম তো আসলে বিশ্বাসের বিষয়, একান্তই ব্যক্তিগত এক অনুভূতি।
কিন্তু এই অনুভূতি যখন সব মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তখন তার একটি জাগতিক ও যৌক্তিক ভাষার দরকার হয়। এমন এক ভাষা, যার দাঁড়িপাল্লায় মানুষ সত্য-মিথ্যা পরখ করতে চায়। এই তাগিদ থেকেই প্রতিটি ধর্মের জ্ঞানীরা নিজ নিজ বিশ্বাসের এক দার্শনিক রূপ দিয়েছেন।
একেক শাস্ত্রে এর একেক নাম—ইলমুল কালাম, অধিবিদ্যা বা থিওলজি।
মুসলমানদের সামনে কোরআনই প্রথম ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস আর সম্প্রদায়ের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ তুলে ধরে তাদের দাবি ও যুক্তিগুলোকে সামনে এনেছে। আবার সেসব দাবির দুর্বলতা আর যুক্তির ফাঁকগুলোও উন্মোচন করেছে।কোরআনের আলোয় ভিন্ন মতএই শাস্ত্রের শিকড় প্রোথিত আছে পবিত্র কোরআনে। মুসলমানদের সামনে কোরআনই প্রথম ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস আর সম্প্রদায়ের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ তুলে ধরে তাদের দাবি ও যুক্তিগুলোকে সামনে এনেছে। আবার সেসব দাবির দুর্বলতা আর যুক্তির ফাঁকগুলোও উন্মোচন করেছে।
ইহুদি ও নাসারাদের কথা কোরআনে বহুবার এসেছে। তাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করে কোরআন সেগুলো খণ্ডন করেছে। আহলে কিতাব বা গ্রন্থধারী জাতিদের নিয়ে কোরআনে বিশদ আলোচনা আছে। যেন সত্যের পথে আহ্বানের তারাই প্রথম হকদার। কোরআনের মতানুযায়ী, আহলে কিতাবদের তাদের কাছে পাঠানো ঐশীগ্রন্থকে বিকৃত করে ফেলেছে। অথচ বিকৃতির আগে ইসলাম ও তাদের ধর্মের মৌল নীতি ও বিশ্বাস ছিল এক।
কোরআনে তাই আহলে কিতাবদের প্রতি রয়েছে সঠিক পথে ফিরে আসার এক উদাত্ত আহ্বান। আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও যে হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক কথার দিকে এসে যাও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই রকম। (আর তা এই যে) আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না।
তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে আমরা একে অন্যকে প্রভু বানাব না। তথাপি যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, সাক্ষী থাক যে আমরা মুসলিম।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৬৪)
কোরআন কেবল ইহুদি-নাসারাদের কথাই বলেনি, বলেছে আরও বহু ধর্ম ও বিশ্বাসের কথা। কিছু ছিল ঐশী, আর কিছু মানুষের গড়া। মূর্তি পূজারি থেকে শুরু করে ফেরেশতার উপাসনাকারীদের কথাও সেখানে এসেছে।
আরও পড়ুনসাপ্তাহিক ছুটির দিন সম্পর্কে ধর্ম কী বলে২১ অক্টোবর ২০২৫বস্তুবাদী দর্শনের মুখোমুখিপ্রাচীনকালে ‘দাহরিয়া’ নামে একটি গোষ্ঠীর কথা জানা যায়, যাদের দর্শনকে এখন বস্তুবাদ বলা হয়। তাদের বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা বলে, জীবন বলতে যা কিছু, তা ব্যস আমাদের এই পার্থিব জীবনই। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি, আর আমাদেরকে কেবল কালই ধ্বংস করে, অথচ এ বিষয়ে তাদের কোনোই জ্ঞান নেই। তারা কেবল ধারণাই করে।’ (সুরা জাসিয়াহ, আয়াত: ২৪)
প্রাচীন আরবি গদ্য সাহিত্যিক জাহিয তাঁর হায়াওয়ান গ্রন্থে এই দাহরিয়াদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, তাদের বিশ্বাসের ভিত ছিল কেবল ইন্দ্রিয়ের ওপর। ইন্দ্রিয় দিয়ে যা বোঝা যায়, তার বাইরে তারা কিছুই বিশ্বাস করত না। চোখে দেখা বা অনুভব করার বাইরে কোনো সত্যে তাদের আস্থা ছিল না।
ইরানি বহুবিদ্যাবিশারদ আল-বেরুনিও দাহরিয়াদের মতামত তুলে ধরেছেন। নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের তারিখ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এক দাহরিয়াবাদী জ্যোতির্বিদের মত উল্লেখ করেন। সেই জ্যোতির্বিদ প্রাচীন এক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে প্রতি ১ লাখ ৮০ হাজার বছর পরপর পৃথিবীতে বন্যা হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। আল-বেরুনি একে অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা বলে চিহ্নিত করেছেন। (আল-আছারুল বাকিয়াহ আনিল কুরুনিল খালিয়াহ, পৃ. ২৫)
ধর্মতত্ত্ববিদ আবুল ফাতহ শাহরাস্তানি তাঁর বিখ্যাত আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থে অবিশ্বাসীদের দুটি ধারার কথা বলেছেন। একদল কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে বিশ্বাস করে, যুক্তিতে নয়। আরেক দল ইন্দ্রিয় ও যুক্তি দুটিতেই বিশ্বাস স্থাপন করে—তারাই দাহরিয়া। (আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল, ২/৩০৭)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অপ্রতুলতাইসলামের আগে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। কারণ, এক ধর্ম সহজে অন্য ধর্মের ঐতিহাসিকতাকে স্বীকার করত না। ইহুদিরা ঈসা (আ.)–কে নবী মানে না। খ্রিষ্টানদেরও ইহুদিদের প্রতি ছিল একই মনোভাব। বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মেও পারস্পরিক বোঝাপড়ার এই সংকট ছিল।
ইহুদিরা বলে, খ্রিষ্টানদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ এরা সকলে (আসমানি) কিতাব পড়ে।কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ১১৩কোরআন তাদের এই সংকটের কথা তুলে ধরে বলেছে, ‘ইহুদিরা বলে, খ্রিষ্টানদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ইহুদিদের (ধর্মের) কোনো ভিত্তি নেই। অথচ এরা সকলে (আসমানি) কিতাব পড়ে। অনুরূপ (সেই মুশরিকগণ) যাদের কোনো (আসমানি) জ্ঞান নেই, তারাও এদের (কিতাবিদের) মতো কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে আল্লাহই কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে বিষয়ে ফয়সালা করবেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১১৩)
এটি ছিল তৎকালীন ধর্মগুলোর এক সাধারণ চিত্র। এক অপরের অস্তিত্বকে স্বীকার না করায় তুলনামূলক আলোচনার কোনো সুযোগই ছিল না। অথচ বহুত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেই জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে।
মুসলিম মনীষীদের হাত ধরে নতুন দিগন্তআধুনিক কালে ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ বলতে বিভিন্ন ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠকে বোঝানো হয়, যার নির্দিষ্ট নীতিমালা ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকেই বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পাঠের আগ্রহ দেখা যায়। তারা একে গবেষণার এক স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা প্রচলিত ধ্যানধারণার ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি ধর্মের মূল উৎস গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন তাঁরা। বিশ্বের নানা ধর্মের বর্ণনা, বিশ্লেষণ, তুলনা ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ শারকাভীর মতে, কোরআনের আলোচনার প্রভাবেই মুসলমানদের মধ্যে এই শাস্ত্রের আগ্রহ জন্মেছিল। এই শাস্ত্রে তাঁরা লিখেছেন বড়–ছোট বিভিন্ন ধরনের বই। (গাজ্জালির লেখা আর-রাদ্দুল জামিল গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ শারকাভীর লেখা ভূমিকা দ্রষ্টব্য)
মুসলিম সমাজে ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এক বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতার জন্ম দেয়। বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ, আলোচনা, বিতর্ক ও সংলাপের এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবেই শুরু হয় বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা। তখন এর নাম ছিল ‘ইলমুল মিলাল ওয়ান-নিহাল’। এর মানে ধর্ম ও মতবাদ বিদ্যা। (আল-হাযারাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল কারনিল রাবিইল হিজরি, ১/৩৮৪)
পশ্চিমা পণ্ডিত ফ্রাঞ্জ রোজেন্থাল বলেছেন, ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইসলামি সভ্যতারই অন্যতম এক আবিষ্কার, যা মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখেছে।’ (গোলাম হায়দার আসি, মুসলিম কন্ট্রিবিউশনস টু দ্য হিস্ট্রি অব রিলিজিওনস)
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও স্বীকার করে, ‘এদিকে, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব পশ্চিমা খ্রিষ্টীয় জগতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে মধ্যযুগের স্কলাস্টিক দর্শনে, যেখানে যুক্তি ও ঐশী বাণী উভয়ের মূল্যকেই অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছিল। অন্য ধর্মগুলো সম্পর্কে মুসলমানদের জ্ঞান ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল।’ (দ্য নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা: স্টাডি অব রিলিজিওন, ১৫/৬১৫)
কাজি আবদুল জব্বার (মৃত্যু ৪১৫ হিজরি) খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে আত-তাছবিত নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। পশ্চিমা গবেষকদের মতে, এই বইটিতে খ্রিষ্টধর্মের অনেক বিরল তথ্যের সন্ধান মেলে। ডেভিড সক্সের মতো পণ্ডিতেরা তার কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুনইসলাম কি কোনো ধর্ম নাকি জীবনবিধান?১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে মুসলিমদের অবদানঅনেকে মনে করেন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষণা শুরু হয়েছে ফ্রিডরিখ ম্যাক্স মুলারের হাতে। এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। এর বহু আগেই মুসলিম গবেষকরা ধর্মের ইতিহাস ও তুলনা নিয়ে অসংখ্য কাজ করেছেন। (ড. মুহাম্মদ শারকাভী, মানাহিজু মুকারানাতিল আদইয়ান ফিল ফিকরিল ইসলামি, পৃ. ৫০৮)
তাঁদের মধ্যেই কে প্রথম, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। হেনরি পিনার্ড দে লা বুল্লের মতে, ইবনে হাযম আন্দালুসিই এই শাস্ত্রের জনক। (আদ-দিরাসাতুল মুকারানাতু লিল-আদইয়ান)
আবার জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যাডাম মেটজের মতে, এর সূচনা হয় আবু মুহাম্মদ নাওবাখতির আল-আরা ওয়াদ দিয়ানাত (মতবাদ ও ধর্মসমূহ) গ্রন্থের মাধ্যমে। (আল-হাযারাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল কারনিল রাবিইল হিজরী, ১/৩৮৫)
কারও মতে, শাহরাস্তানির আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থটিই এর ভিত্তি। আবার কেউ আবু ঈসা ওয়াররাকের প্রবন্ধগুলোকে এই ধারার প্রথম কাজ বলে মনে করেন। (কমপেরেটিভ রিলিজিওন আ হিস্ট্রি, পৃ. ১১)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইসলামি সভ্যতারই অন্যতম এক আবিষ্কার, যা মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখেছে।পশ্চিমা পণ্ডিত ফ্রাঞ্জ রোজেন্থালহাসান বিন মুসা নাওবাখতি, আবুল হাসান হুযালি, ইযযুল মুলক মিসবাহি এবং আবু মনসুর ইসফারায়েনির মতো অগণিত পণ্ডিত এই শাস্ত্রে অবদান রেখেছেন।
কেউ আবার মনে করেন, আবু ঈসা ওয়াররাক তাদেরও আগে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেগুলো ‘মাকালাত’ (প্রবন্ধসমগ্র) নামে বই বানানো হয়েছিল। এই মতের পক্ষে আছেন ড. ইবরাহিম তুর্কি। (নাশআতু ইলমি মুকারানাতিল আদইয়ান ফিল ফিকরিল ইসলামিয়্যি, পৃ. ৬০০)
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর গবেষণার জন্যে পরিচিত হাসান বিন মুসা নাওবাখতি। তিনি ছিলেন দার্শনিক ও শীআ ফকিহ। তিনি লিখেছিলেন আল-আরা ওয়াদ দিয়ানাত (মতবাদ ও ধর্মসমূহ), আর-রাদ আলা আসহাবিত তানাসুখ ওয়াত তানাসুখিয়্যাহ (জন্মান্তর ও জন্মান্তরবাদীদের খণ্ডন) নামে দুটি বই। (ইবনে নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, ৫/২২৫)
আবুল হাসান আলী বিন হুসাইন হুযালি (মৃত্যু ৩৪৬ হিজরি) লিখেছিলেন, আল-মাকালাত ফি উসুলিদ দিয়ানাত (বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিমালা)। এখানে বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতিমালা নিয়ে তিনি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন।
ইযযুল মুলক মুহাম্মদ বিন আবিল কাসিম মিসবাহি (মৃ. ৪২০ হি.) লিখেছিলেন দারকুল বুগয়াহ ফি ওয়াসফিল আদইয়ান ওয়াল ইবাদাত। এটা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার একটা বিরাট গ্রন্থ।
আবু মানসুর ইসফারায়েনি (মৃ. ৪২৯ হি.) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন দুটি গ্রন্থ। এক. আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল, দুই. আল-ফারক বাইনাল ফিরাক (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে চিন্তার বৈচিত্র)। এই গ্রন্থের শুরুতে তিনি গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
তাঁর ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর কাছে একটা হাদিসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়েই এই গ্রন্থ তিনি লিখে ফেলেছেন। হাদিসটি হলো, ‘ইহুদিরা বিভক্ত হয়ে গেছে একাত্তর দলে। খ্রিষ্টানরা বিভক্ত হয়ে গেছে বায়াত্তর দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হয়ে যাবে তিয়াত্তর দলে। (আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ, শারহুস সুন্নাহ)
তাঁর ছাত্ররা চেয়েছিল, তিনি এই হাদিসের ব্যাখ্যা এমনভাবে করবেন, যেন বিভিন্ন দলের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। পরিষ্কার হয়ে যায় নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য। ইসফারায়েনি এই গ্রন্থ রচনায় অবলম্বন করেছেন অলংকারপূর্ণ খণ্ডনমূলক যুক্তিপদ্ধতি।
আল-বেরুনি তাঁর বইগুলোতে আলোচনা করেছেন ইহুদি, হিন্দু ও ভারতের অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে। তাঁর গবেষণায় ছিল সূক্ষ্মতা ও নিরপেক্ষতা।
ইবনে হাযম আন্দালুসি তাঁর আল-ফিসাল গ্রন্থে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গবেষণার কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল চোখে পড়ার মতো:
১. তিনি সমালোচনার জন্য বেছে নিতেন শুধু সেসব কথা, যার ভিন্ন কোনো অর্থ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেছেন, ‘কোনো উক্তি বা উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে যদি ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার—হোক তা দূরবর্তী—অবকাশ থাকে, তাহলে সেটার ওপর ভিত্তি করে আমি সমালোচনা করিনি।’ (আল-ফিসাল ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়াই ওয়ান নিহাল, ১/২৩৬)
২. কোনো উদ্ধৃতি ব্যাখ্যার সময় তিনি তার আগের ও পরের প্রসঙ্গের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। এটিই ছিল যৌক্তিক ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠ উপায়। পাঠ্যের সমালোচনার ক্ষেত্রে যদি পূর্বাপরের দিকে লক্ষ রাখা না হয়, তাহলে সে সমালোচনা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ড. আবদুর রহমান বাদাভী বলেছেন, ‘সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য, শব্দ ও বাক্যকে সর্বদা পূর্বাপরের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করতে হয়।’ (ড. আবদুর রহমান বাদাভি, মানাহিজুল বাহসিল ইলমিয়্যি, পৃ. ২০৭)
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করতে এবং নিজের আদর্শিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পাঠ অপরিহার্য। মানুষের সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুভূতি হলো তার ধার্মিকতা।৩. যাদের মত তিনি খণ্ডন করতেন, তাদের পক্ষে কী কী আপত্তি তোলা হতে পারে, তা–ও তিনি আগে থেকেই অনুমান করে জবাব দিয়ে যেতেন।
অন্যদিকে ইমাম শাহরাস্তানি ছিলেন আরও নির্মোহ এক পর্যবেক্ষক। তাঁর আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মতামত তুলে ধরেছেন একে অপরের পাশাপাশি। তাঁর লক্ষ্য ছিল তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা, তীব্র সমালোচনা নয়। (মুহাম্মদ বিন নাসের বিন সিহিবানি, মানহাজুশ শাহরাস্তানি ফি কিতাবিহ আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ. ২৮৫)
এই পথ ধরেই এগিয়েছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। লিখেছেন আল-জাওয়াবুস সহিহ লিমান বাদ্দালা দীনাল মাসিহ। এই গ্রন্থে তিনি কোরআনের সেসব আয়াতের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন—যেগুলোকে খ্রিষ্টানরা নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে যুক্তি পেশ করে। এই গ্রন্থ রচনায় তিনি অবলম্বন করেছেন তুলনামূলক বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি।
তাঁর ছাত্র ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ লিখেছেন হিদায়াতুল হায়ারা ফি আজওইবাতুল ইয়াহুদি ওয়ান নাসারা। গ্রন্থ রচনায় তাঁর পদ্ধতি ছিল বর্ণনামূলক, সমালোচনামূলক ও তুলনামূলক। বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণে তিনি ব্যবহার করেছেন উসুলুল ফিকহ ও ভাষাতত্ত্বের নীতিমালা।
আরও অনেকেই আছেন পূর্ববর্তীদের মধ্যে, যাঁরা গভীরভাবে গবেষণা করেছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। তাঁদের সবার কথা এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
আধুনিক কাল: দুই ধারাসময়ের স্রোতে এই ধারা এসে পৌঁছেছে একালে। বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
একদিকে রয়েছে দাওয়াতি বা প্রচারমূলক ধারা। এই ধারার ব্যক্তিত্বরা গণমাধ্যমে কাজ করেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নেন। শাইখ আহমাদ দিদাত, ড. জাকির নায়েক, মুহাম্মদ হিজাব প্রমুখ এই ধারার সুপরিচিত মুখ।
অন্যদিকে রয়েছে গবেষণাধারা। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ বিভাগ এই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন অসংখ্য গবেষক। ড. আহমাদ শালাবী, ড. মুহাম্মদ শারকাভী, ইসমাইল রাজি আল-ফারুকির মতো পণ্ডিতেরা এই ধারার পথপ্রদর্শক।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করতে এবং নিজের আদর্শিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পাঠ অপরিহার্য। মানুষের সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুভূতি হলো তার ধার্মিকতা। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের বোঝার মতো করে কথা বলো।’ (বুখারি, হাদিস নং: ১২৭)
মানুষের মন আর মনন বুঝতে হলে, তার বিশ্বাসের গভীরে পৌঁছাতে হয়। আর সেই পথের প্রথম সোপান হলো তার ধর্মকে জানা।
আরও পড়ুনধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: পশ্চিমা অনুকরণ থেকে মুক্তির পথ২২ আগস্ট ২০২৫