গাজীপুরে অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বনলতা এক্সপ্রেস। ঢাকা-জয়দেবপুর রেলপথের ধীরাশ্রম এলাকায় গতকাল রোববার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে । এ সময় ট্রেনটিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ যাত্রী ছিলেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, লক ভেঙে হঠাৎ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল রেললাইনের এক পাশের স্লিপারের প্রায় ২০ মিটার অংশ। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু রেলকর্মী ও এলাকাবাসী ঘটনাস্থলের একটু সামনে লাল পতাকা ঝুলিয়ে দেন। দূর থেকে তা দেখতে পান বনলতা এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার (চালক)। তিনি প্রায় ৪০-৫০ মিটার দূরে এসে ট্রেনটি থামাতে সক্ষম হন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রায় ১ হাজার ২০০ যাত্রী নিয়ে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুপুর ২টার পর ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। পৌনে ৩টার দিকে টঙ্গী রেলওয়ে জংশন ছাড়িয়ে সেটি ধীরাশ্রম এলাকায় যাওয়ার পরপরই লোকোমাস্টার রেললাইনের ওপর বিপদসংকেত দেখতে পান। তাঁর চোখে পড়ে লাইনের ঠিক মাঝখানে লাল পতাকা উড়ছে। পরে তিনি ট্রেনটির গতি কমিয়ে আনেন। বেঁকে যাওয়া অংশের প্রায় ৪০-৫০ মিটার দক্ষিণে ট্রেনটি থামাতে সক্ষম হন তিনি।
ওই ট্রেনের যাত্রী রুবেল হোসেনের ভাষ্য, স্টেশন ছাড়াই যখন হঠাৎ ট্রেনটি থেমে যায়, তখন যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে তারা ট্রেন থামার কারণ জানতে পারেননি। পরে লাইন সরে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। অল্পের জন্য সব যাত্রী প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, বনলতা ট্রেন আসার অল্পক্ষণ আগেও একটি ট্রেন এই লাইন অতিক্রম করে। তখনও লাইনটি বাঁকা ছিল না। হঠাৎ বাঁকা হয়ে যায়। সেখানে তখন রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের কর্মীরা কাজ করছিলেন। লাইন বাঁকা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাদের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই দিকের স্টেশন মাস্টারকে বিষয়টি জানিয়ে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া। তবে কোনো স্টেশন থেকেই রেললাইন বাঁকা হয়ে যাওয়ার খবরটি বনলতা এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার বা পরিচালককে জানানো হয়নি। বিপদসংকেত দেখেই লোকোমাস্টার ট্রেনটি থামিয়েছেন।
আলী হোসেন নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, স্টেশন ছাড়া এভাবে মাঝপথে হঠাৎ ট্রেন থামানো হচ্ছে দেখে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা পরে লাইন বেঁকে যাওয়ার বিষয় জানতে পারেন।
বনলতা এক্সপ্রেসের পরিচালক মোখলেছুর রহমান সমকালকে বলেন, রেললাইনের স্লিপারের লকগুলো কীভাবে খুলে গেছে, লাইন কীভাবে বাঁকা হয়েছে– এর কারণ বুঝতে পারছেন না।
বিষয়টি জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার হানিফ আলী। শীতকালে এভাবে রেললাইন বাঁকা হয়ে যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটেছে বলে তাঁর জানা নেই। হানিফ আলী বলেন, গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। ট্রেনের চাকার ঘর্ষণে লাইনটা কি লম্বা হয়ে গেছে কিনা, সেটা জানতেও তদন্ত
চলছে। স্টেশন মাস্টারের ভাষ্য, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা লাইনটি মেরামত করতে সক্ষম হই। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রকৃতির আলোয় সিলেটের বনলতা
গ্রীনলাইন পরিবহনের রাজারবাগ কাউন্টারে বসা আমরা। বাস ছাড়ার মিনিট পাঁচেক আগেই বাসে উঠে পড়ি। সময় মতোই বাস ছাড়লো। শেষ বিকেলের সোনালি রোদ পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি সিলেটের দিকে। ঢাকার বিখ্যাত যানজট তেমন আজ পেল না আমাদের। শুদ্ধ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের আতিথেয়তায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য শুদ্ধ যেখানেই যায় না কেন বাসে উঠলেই সে ঘুম দেবে। সে ৩০ মিনিটের যাত্রা হোক আর হোক পাঁচ ঘণ্টার।
বাস চলছে। আমারো চোখ বন্ধ হবার উপক্রম। এর মাঝে যাত্রাবিরতীর ঘোষণা শোনা গেল। নেমে হালকা খেয়ে নিলাম আমরা। বাস থেকে নামার সময় বলা হলো, যাত্রাবিরতী বিশ মিনিট। কিন্তু এই যাত্রাবিরতী আধ ঘণ্টায় শেষ হলো। আবার যাত্রা শুরু। সন্ধ্যা শেষে রাতের নিস্তব্ধতা। রাত তখন ১০টা ৩০ মিনিট; বাস এসে থামলো সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে। আগে থেকেই আমাদের থাকার স্থান নির্ধারিত ছিল। ইকো রিসোর্ট বনলতা। সিলেট শহর হতে খুব কাছে মাত্র ৪০ মিনিটের পথ। আমরা বাস থেকে নেমেই বনলতার পথে পা বাড়ালাম। ক্লান্তি এখন দেহজুড়ে। তাই যত তাড়াতাড়ি বনলতায় যাওয়া যায় তত ভালো।
বনলতা নামে কেমন জানি মায়া জড়িয়ে আছে। জীবনানন্দ দাশের জন্যও হয়তো। আমরা এগিয়ে চললাম বনলতার পানে। শুরুতে দারুণ এক শহীদ মিনার দেখলাম নগরীর চৌহাট্টায়। মনে হলো পাহাড়ের মধ্যে শহীদ মিনারটি দাঁড়িয়ে আছে। চৌহাট্টা পাড়ি দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। চলতি পথে দুই পাশে চা বাগান। যাওয়ার পথে একবার নয়, দু’দুবার প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু আঁধার রাতে ছবি তুলতে পারলাম না। আঁকাবাকা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছালাম বনলতায়। বনলতায় ঢোকার সাথে সাথে প্রকৃতির উষ্ণ অভ্যর্থনা। শহরের কোলাহল হতে মুক্তি পাওয়ার এ যেন এক বড় পাওয়া।
আরো পড়ুন:
জলাবদ্ধতা নিরসনে সিসিকের কন্ট্রোল রুম চালু
প্রথমবারের মতো শাবিপ্রবিতে হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক চা প্রদর্শনী
আমাদের সব ক্লান্তি মুছে গেল বনলতায় ঢুকে। ছোট্ট একটি লেকে নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। আলো আঁধারের মাঝে ঝিঝি পোকা ছন্দে গেয়ে চলেছে। আমারা পদব্রজে এগিয়ে চললাম। সারি সারি গাছের ফাঁকে আলো-আঁধারের খেলা অসাধারণ লাগছিল! প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে বনলতা গড়ে উঠেছে। আমি আর শুদ্ধ উঠলাম বাঁশের অরণি কটেজে। বাকিরা উঠলো মাটির কটেজ লাবণ্যে। একটু পরেই আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংক দেওয়া হলো। সারাদিন ক্লান্তি শেষে লেবুর শরবত ক্লান্তি দূর করল। সেখানকার সার্ভিস পারসন বললেন, এই শরবতের লেবু রিসোর্ট থেকেই সংগ্রহ করা। একটু পরেই আমাদের রাতের খাবার দেওয়া হলো। অনেক দিন পর মাটির থালাবাসনে খাবার খেলাম। অসাধারণ স্বাদ! আমি অনেক জায়গায় ঘুরতে যাই কিন্তু বনলতার রান্নার স্বাদ একটু ভিন্ন। যাই হোক চটপট রাতের খাবার খেয়ে আমরা নিদ্রায় গেলাম।
পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙলো সকালে। দিনের আলোয় এবার আমাদের বনলতাকে দেখার পালা। চারটি কটেজের দেখা পেলাম। সবগুলো ইকো কটেজ। কোনটি বাঁশের, আবার কোনটি মাটির। কটেজগুলোর নামের ভিন্নতা মুগ্ধ করেছে আমাদের! কোন কটেজের নাম অরণী, কোনটা লাবণ্য, কোনটা সূর্যশিশির আবার কোনটা চারুলতা। পাহাড় সমভূমি সমন্বয়ে দারুণ ব্যাপার! শুদ্ধ ঘুম থেকে উঠেই দোলনায় দুলতে লাগলো। অন্য সদস্যরা কেউ ক্যারাম খেলার ঘরে, কেউ আবার লুডু খেলায় মগ্ন হয়ে পড়লো। কিছু সময় পর সকালের নাস্তা দেওয়া হলো ডিম ভাজা আর ভুনা খিচুড়ি, অসাধারণ স্বাদ! আমি মনে মনে ভাবছিলাম রান্নার এতো স্বাদের কারণ কী? একবার বনলতার হেঁশেলে যেতে হবে। সকালের পেট পূজা শেষে আমরা চলে গেলাম রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে। বনলতা থেকে একেবারে হাঁটার দূরত্বে রাতারগুল। ঘড়ির কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময় যে কিভাবে ছুটে চলে! রাতারগুল থেকে ঘুরে এসেই সরাসরি বনলতার হেঁশেলের দিকে পা বাড়ালাম।
রোসনা খালা নামে একজন খুব মন দিয়ে রান্না করছেন মাটির চুলায়। বনলতার রান্নার এতো স্বাদের কারণ এবার বুঝতে পারলাম। এবার মধ্যাহ্ন ভোজন। আগে থেকেই আমরা মেন্যু বলে দিয়েছিলাম। খাবার জন্য দারুণ একটি ব্যবস্থা দেখলাম! একসাথে অনেকজন বসা যায়। সেখান থেকে পুরো রিসোর্ট দেখা যায়। বাড়তি পাওয়া হলো পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের নয়নাভিরাম পাহাড়ের সৌন্দর্য। খাবার টেবিলে খাওয়া যখন এলো আর তর সইছিল না। আগেই বলেছি, মাটির চুলায় রান্নায় অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। সেই স্বাদ আমাদের মুগ্ধ করে। খুব যত্নের সাথে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো। খরচটাও খুব কম। মোটামুটিভাবে সবার জন্য সহজলভ্য। আজ খাওয়াটা একটু বেশিই হলো। খাওয়া শেষ করে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার বনলতার ছায়াবিথীতে গেলাম।
প্রকৃতির অনন্য রূপ বারবার মুগ্ধ করছিল আমাদের! সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের বিকালের নাস্তা দেওয়া হলো। খুবই ঘরোয়া পরিবেশে আমরা যেমন বাসাবাড়িতে সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা খাই তেমন। রাতে ছিলো বারবিকিউ। ঝিঝি পোকার ডাক আর গ্রামীণ আবহ আমাদের তৃপ্ত করলো। রাতের খাবার খেয়েই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা উঠেই আমাদের রওনা দিতে হবে নগরজীবনের পথে। এবার যাওয়ার পালা। দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ফিরছিলাম। বনলতা পুরোটাই প্রকৃতির সাথে নিবিড় হয়ে আছে। যখন ফিরে আসছি, তখন পেছন থেকে সীমান্তের দিগন্ত ছোঁয়া মেঘালয় পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে, আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও বন্ধু। বনলতার নয়নাভিরাম প্রকৃতি কাউকে নিরাশ করবে না আশাকরি।
যেভাবে যাবেন
বনলতা সিলেট শহর থেকে ৪০ মিনিট দূরত্বে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের কাছেই রামনগরে অবস্থিত। একেবারে মূল রাস্তার উপর বনতলার অবস্থান। শহরের আম্বরখানা থেকে সাহেব বাজার অভিমুখী সিএনজি নিয়মিত পাওয়া যায়। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৩০ টাকা। সাহেব বাজার পৌঁছে রামনগর বনলতা ইকো রিসোর্টে যাবো বললে যে কেউ নিয়ে যাবে।
খরচ কেমন
খাবার খরচ ১৫০ টাকা হতে শুরু করে ৫০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খাবার তালিকায় দেশি মাছ, মুরগি, হাঁস পাবেন। শ্রেণীভেদে কটেজ ভাড়া ২৫০০ টাকা হতে শুরু করে ৬০০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রতিটি কটেজে এটাচড ওয়াশ রুম আছে। আছে তাবু নিবাসের ব্যবস্থা। তাবু নিবাস মাত্র ৫০০ টাকা। প্রতিটি কটেজের ক্ষেত্রে সকালের নাস্তা এবং বিকালের নাস্তা ফ্রি। যোগাযোগ : ০১৭১৭৬৭৪৩১০
তারা//