গতকাল শনিবার অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে– এমন বিষয়বস্তু ঠেকাতে’ পাণ্ডুলিপি আগেই বাংলা একাডেমি দ্বারা যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন।
গত বছর–আওয়ামী লীগের আমলে–একুশে বইমেলায় তিনটি বই বাংলা একাডেমি নিষিদ্ধ করে। মজার বিষয়, এসব বইয়ের কাটতি আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনটি বই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও ছিল বেশ চমৎকার। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’, ফাহাম আব্দুস সালামের লেখা ‘মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ ও জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’। বই তিনটি নিষিদ্ধ করার কারণ হলো, এগুলো আওয়ামী লীগের উন্নয়নের গাঁজাখুরি চিত্র উদোম করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশে বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় শাসকমহল নিজেদের অপরাধ ও অস্বস্তি গালিচার নিচে লুকিয়ে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত ঘটে। ভারতবর্ষে ইংরেজ সরকার জাতীয় কবি নজরুল ইসলামে ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ করেছিল। তারা ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’-এর মতো কবিতা নিষিদ্ধ করেছিল, যা ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল, যেটি ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধের তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই সরকার ‘জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অঙ্গনের বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রকাশের জন্য’ তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯৮৮ সালে সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশ পায়। বইটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল।
বিশেষ কোনো কারণ দেখিয়ে কোনো বই নিষিদ্ধ করার ফজিলত আদৌ আছে কি? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। আধুনিক দুনিয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে রয়েছে ব্যাপক সমর্থন। এটি চলমান এক প্রক্রিয়া। সমাজের বৌদ্ধিক পরিপক্বতার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ জনগোষ্ঠীর মতপ্রকাশ উপভোগ করার পরিসরের বিস্তৃতি ঘটে। এ কারণে এখানে লেখক ও পাঠক দুই পক্ষের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। যেমন– সরকারের গণতান্ত্রিক মনোভাব কতুটুকু, শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ইত্যাদি।
সমাজে মিথ্যা ও দুর্বল বয়ান আগে-পরে ঠেকে না। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আওয়ামী বয়ানও চুরমার হতে দেখেছি। তাই ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে’ এমন কারণ দেখিয়ে পাণ্ডুলিপি যাচাইয়ের ডিএমপির পরামর্শ যুক্তিযুক্ত নয়, বরং আপত্তিজনক। বিষয়টি অর্থনীতির গ্রেশাম’স ল-এর মতোই। এ আইন অনুযায়ী, খারাপ মুদ্রা বাজার থেকে ভালো মুদ্রাকে বিতাড়িত করে। গুণসম্পন্ন বইয়ের কাছে খারাপ বইয়ের পরাজয় ঘটবেই।
তাই বিশেষ কোনো বই কিংবা চিন্তা গ্রহণ বা বর্জনের দায় পাঠকের। এ কারণে বই প্রকাশে বাংলা একাডেমি কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত সরকারের আমলে নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের পরিসরের বিস্তৃতি ঘটবে– সেটিই প্রত্যাশিত। বিশেষ কোনো কারণ দেখিয়ে বিশেষ মত চাপা না দিয়ে বরং সরকার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন– জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আর্কাইভ করা, শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, গবেষণায় আরও তহবিল বাড়িয়ে দেওয়া।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৌদ্ধিক উৎকর্ষের উন্নতি ঘটলে বিশেষ কোনো চিন্তার কারণে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা কমতে
থাকে। এ কারণে দায় যতটা ব্যক্তিমানুষের, তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রের। তাই পাণ্ডুলিপি যাচাইয়ের দায়িত্ব পাঠকের হাতে ন্যস্ত করাই যুক্তিযুক্ত।
ইফতেখারুল ইসলাম:
সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর সরক র বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ মির্জা ফখরুলের
গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নে দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গণসংযোগের সময় দেওয়া বক্তব্যে এই আহ্বান রাখেন তিনি।
শেখ হাসিনার শাসন আমলে বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। গুম, খুন, ভিত্তিহীন মামলা, লুটপাট, টাকা পাচার, বাকস্বাধীনতা হরণ ও ভোট চুরিসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
আরো পড়ুন:
জুলাই গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ ৪০৮ জনের বিরুদ্ধে আরেক মামলা
হাসিনা-রেহানাসহ ২২ জনের গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ১২ মে
শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীদের গুম করা হয়েছে। লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের ঘরে থাকতে দেননি আপনি। আমরা তো কোথাও পালিয়ে যাইনি। আদালতে মিথ্যা মামলা আইনের মাধ্যমে ফেইস (মোকাবিলা) করেছি। উকিল ধরে জামিন নিয়েছি। আপনি (শেখ হাসিনা) পালিয়ে আছেন কেন? আপনিও মামলা লড়েন। আপনি দেশে এসে দাড়ান না দেখি।”
জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা অনেকে মনে করেন শেখ হাসিনা আবারো দেশে ফিরে আসবেন। তিনি তো ১৫ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তার তো দেশ থেকে পালানোর কথা ছিল না। তিনি পালালেন কেন? কারণ তিনি একজন ডাইনি ছিলেন। জনগণের ওপর এমন নির্যাতন করেছেন যে, তিনি পালাতে বাধ্য হয়েছেন। জনগণ যদি সেদিন তাকে পেত, তাহলে ছিঁড়ে খেত।”
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, “হাসিনা দেশে ফিরে রাজনীতি করলে আমাদের কিছু করতে হবে না, জনগণই তাকে দেখে নেবে।”
আওয়ামী লীগের শাসনামলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন আওয়ামী লীগের মতো অন্যায় না করে; এতে মানুষ ভালোবাসবে না। দলের কোনো নেতাকর্মীরা অন্যায় করলে যেন জেলার নেতারা তাদের শক্ত হাতে দমন করেন; তারা যেন অন্যায়কারীদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। তাই অপকর্ম বন্ধ করুন, না হলে আওয়ামী লীগের মতো অবস্থা হবে।”
ত্রোদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দৃষ্টি রেখে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। মির্জা ফখরুলসহ দলটির শীর্ষ নেতারা সভা-সমাবেশ করছেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা, না রাখা নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে; সেই সঙ্গে আইনি ঝক্কিও সামনে আসছে।
গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া কয়েক শত ফৌজদারি মামলায় তিনি আসামি। অনেক মামলায় তাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। তবে ভারতের আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর কোনো নিশ্চয়তা এখনো তৈরি হয়নি।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ছোট বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। সেদেশে উচ্চনিরাপত্তা শৃঙ্খলে বসবাস করছেন বলে আন্তর্জাতিক সাংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়ে থাকে। সেখান থেকে দেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনলাইনে তার কথোপকথনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যা নিয়ে অস্বস্তির কথা ভারতকে জানিয়ে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার।
ঢাকা/মঈনুদ্দীন/মাসুদ