মিথ্যা না বলার শাস্তি ১৬ বছর কারাবাস
Published: 2nd, February 2025 GMT
‘বিডিআর বিদ্রোহের দিন ডিউটিতে ছিলাম না। পরদিন বাড়ি চলে আসি। যোগদানের পর মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় কারাগারে পাঠানো হয়। মিথ্যা না বলার শাস্তি হিসেবে ১৬ বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে।’ যন্ত্রণাময় জীবনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিল্লাল হোসেন।
মুক্তি পেয়ে গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কালীর বাজার ইউনিয়নের বুদুর গ্রামে ফেরেন তিনি। বিল্লালের বাবা সুরুজ মিয়াও অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য। দীর্ঘ দেড় যুগ পর বাড়িতে প্রথম বইছে আনন্দের জোয়ার। আপ্লুত স্বজন তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করেন।
সরেজমিন শনিবার বাড়িতে ভিড় দেখা যায় এলাকাবাসীর। যারা আসছেন, বিল্লালকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। ছোট দুই বোন ফুল হাতে যখন বরণ করলেন, বিল্লাল নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। হাউমাউ করে কাঁদলেন। এরই ফাঁকে মুক্তির জন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার ও গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ দেন। বিল্লাল বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে না গেলে হয়তো আমরা কারাগার থেকে মুক্তি পেতাম না।’
সুরুজ মিয়া বিডিআরের সৈনিক ছিলেন। অবসরের পর একমাত্র ছেলে বিল্লালকেও বাহিনীর চাকরিতে উৎসাহ দেন। ২০০৭ সালের ৮ জুলাই সৈনিক পদে যোগ দেন বিল্লাল। প্রশিক্ষণ শেষে ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়নে শুরু করেন কর্মজীবন। সেখান থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি ফেরেন ঢাকায়। কিছুদিন পর বিল্লালকে খেলা উপলক্ষে পিলখানা সদরদপ্তরে পাঠানো হয়।
বিল্লাল বলেন, ‘২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার সময় আমার ডিউটি ছিল না। এমএমএস বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় থাকতাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। এর পর ফায়ারিংয়ের শব্দে সবাই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। প্রথমে টায়ার বিস্ফোরণ মনে হলেও পরে বুঝতে পারি, গোলাগুলি হচ্ছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা থেকে কুমিল্লা চলে আসি। পরে ঘোষণা অনুযায়ী পিলখানার ৩ নম্বর গেটে যোগদান করলে ৩ মার্চ আবাহনী মাঠ থেকে পিলখানায় প্রবেশ করায়। সিআইডিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করে বিদ্রোহে সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আমার ব্যাটালিয়নকে ঠাকুরগাঁওয়ে যোগ দিতে বলা হয়।
তিনি বলেন, পরে আমাকে সাক্ষী হতে বললে না করে দিই। আমি তো ঘটনার সময় পিলখানায় ছিলাম না। মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারব না। এক পর্যায়ে ২০১০ সালের ৫ মে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলাম। অবশেষে ১৬৮ জনের সঙ্গে মুক্তি পেয়েছি।
কারাগারের স্মৃতিচারণ করে বিল্লাল বলেন, অনেক কষ্টে দিন কেটেছে। কারাগারে যাওয়ার আগে যেদিন গ্রামে এসেছিলাম, আমার ছোট বোন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। মুক্ত হয়ে দেখছি, ওর মেয়েই প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। জীবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিছু দিয়েই পূরণ সম্ভব নয়। আমার এখন একটিই চাওয়া– হারানো সম্মান যেন ফিরে পাই। মিথ্যা কলঙ্ক থেকে মুক্তি চাই। আমি আবার চাকরিজীবনে ফিরতে চাই।
বিল্লালের বাবা বলেন, আমার পরিবারটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। বিল্লালের মা রেহেনা বেগম বলেন, ‘একমাত্র ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি– এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।