বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হলো ইশারা ভাষা। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’।

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ, আর পৃথিবীতে ৭০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। অর্থাৎ এই ভাষা যে পৃথিবীর এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাষা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ প্রতিনিয়ত অবহেলা আর বৈষম্যের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এই ভাষা ও ভাষার মানুষেরা। বাংলাদেশে সবে মাত্র একটা গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো বৈষম্যর বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের সব চালিকা শক্তির সংস্কারে মনোযোগ সবার। সবাই সবার চাওয়া ন্যায্যতার ভিত্তিতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে চলেছে প্রতিনিয়ত; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো ৩০ লাখ শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কথা কারও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কারণ, তাদের ভয়েস নেই। তারা ইশারায় কথা বলে। তাদের কথা আমরা কেউ বুঝি না, বুঝতে চাই না।

দৃষ্টি বা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কথা বলতে পারেন, তাই তাঁরা কথা বলে তাঁদের অধিকার বা দাবিগুলোর বার্তা পৌঁছে দিতে পারছেন সহজেই। পক্ষান্তরে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ইশারায় সারা দিন বক্তব্য দিলেও কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেন না, শুনছেন না কেউ। বুঝতে পারছেন না তাঁদের বুকফাটা আর্তনাদ। ফলে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান অন্য যেকোনো সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরও নিচে।

চিকিৎসা, চাকরি, শিক্ষার সুযোগ থেকে বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার শুধু ভাষাগত পার্থক্যের কারণে। একুশ শতকে এসেও ভাষাগত পার্থক্যের কারণে যোগাযোগ বিভ্রাট ঘটবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। চীনা, জাপানি, আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় যদি কাজ-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তবে ইশারা ভাষায় এত বাধা কেন। কেনই–বা ভাষার কারণে তাঁরা অবহেলিত থাকবেন? বঞ্চিত হবেন চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার সুযোগ থেকে?

বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদে (ইউএনসিআরপিডি) স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই আমরা আশা রাখি এই ভাষা ও ভাষার মানুষ আজ যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তা একদিন থাকবে না। সে ক্ষেত্রে জনগণকে সেবা প্রদানে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সরকারি-বেসরকারিভাবে ইশারা ভাষার প্রশিক্ষণের আয়োজন করা খুবই দরকার। এতে মানুষ ইশারা ভাষা বুঝতে পারবে, ফলে বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। আর তাহলেই কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা নিজের প্রয়োজন অন্যকে বোঝাতে সক্ষম হবে।

সেখানে নিঃশব্দে ’৭১–এর মতো নাটক দেখেছেন ঢাকাবাসী। শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অসাধারণ অভিনয় সবাইকে মুগ্ধ করেছে, পেশাদার শিল্পীদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয়নি তাঁদের। তাই শুধু একটি ভাষা শিখলে, শেখালে, ভালোবাসলে বা গুরুত্ব দিলেই ৩০ লাখের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে সামনের দিনগুলোতে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর (জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন) হোক বা বাংলা একাডেমি হোক, ইশারা ভাষাকে প্রমিত করতে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং ইশারা ভাষার অভিধান তৈরি করতে হবে। এতে ইশারা ভাষা বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি, এনজিও, আইএনজিওগুলোতে কর্মক্ষেত্রের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ইশারা ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে শ্রবণ-বাক্‌প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত হবে। হাসপাতালে ইশারা ভাষার প্রচলন ঘটলে ভুল চিকিৎসা হওয়ার আশঙ্কা থোকে রক্ষা পাবেন তাঁরা।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস পালিত হয়। শুধু বছরের এই একটি দিন পালন করে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি? বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিবছর এই দিনে তাদের অধিকার বা দাবিদাওয়াগুলো উপস্থাপন করার সুযোগ পান; কিন্তু ইশারা ভাষায় উপস্থাপন হওয়ার ফলে সেটি গুরুত্ব হারাচ্ছে তদন্ত। কারণ, কর্তাব্যক্তিদের কেউই তাঁদের ভাষা বোঝেন না।

ইশারায় তাঁরা যতই বলুক, তাঁদের ভাষাকে প্রমিতকরণের জন্য একটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, তাঁদের চাকরির সুযোগ দিতে হবে, তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতালে দোভাষী প্রয়োজন বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দোভাষী দরকার। এই দাবিগুলোর কোনোটিই গুরুত্ব পাচ্ছে না; কারণ, তাঁরা ইশারায় বলছেন। অনেকে আবার মনে করেন, তাঁরা হাত নেড়ে উল্টাপাল্টা বলছেন আর দোভাষীরা সাজিয়ে–গুছিয়ে অনুবাদ করে দিচ্ছেন।

একজন দৃষ্টি বা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখে বোঝা যায় যে তাঁর প্রতিবন্ধকতা আছে। তবে বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দেখে বোঝার কোনো উপায় নেয়। তাঁর হাত আছে, পা আছে, চোখ আছে, আছে সুন্দর হাঁটার স্টাইল, দেখতে স্মার্ট—এই বলে বলে তাদের দূরে রাখা হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের থেকে। আবার চাকরি বা পড়ালেখা করতে গেলে সবার আগে তাঁকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।

ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও খুব সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এই ভাষার মানুষদের। কারণ, একটাই, তা হলো ভাষা। অন্য সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেও শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশগ্রহণ নেই সবখানে। থাকলেও চুপচাপ বসে থাকছেন এক কোণে। অথবা তাদের কথা অনুবাদ করার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না সব জায়গায়। শুধু অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য কোথাও কোথাও তাদের শোপিসের মতো বসিয়ে রাখা হচ্ছে।

নিজেদের আগ্রহ বা পরিবারের প্রয়োজনেই যাঁরা এই ভাষা শিখেছেন, অর্থাৎ যাঁরা ইশারা ভাষার দোভাষী, তাঁদেরও কর্মক্ষেত্রে সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই নতুন করে ইশারা ভাষার দোভাষী তৈরি হচ্ছে না। হাতেগোনা যে কয়জন দোভাষী আছেন তারাও অন্য পেশা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।

এ তো গেল হতাশার কথা, তবে আশার কথা হলো শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন ইশারা বা সাংকেতিক ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এই টেলিভিশনের উপস্থাপকেরা অনুবাদক হিসেবে কাজ করছেন। তাই বলা যায়, ইশারা ভাষাকে জনমনে বাঁচিয়ে রেখেছে বিটিভি। তবে প্রকৃতপক্ষে এই ভাষার ধারক ও বাহক শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস বিশ্বকে সোশ্যাল বিজনেসের আইডিয়া দিয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ইশারা ভাষা এই সোশ্যাল বিজনেসের বড় একটি অংশ হতে পারে। অন্যের উপকার করার মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হতে পারে এই ইশারা ভাষা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছুদিন আগে ঢাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ঢাকা থিয়েটারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসব ২০২৪।

সেখানে নিঃশব্দে ’৭১–এর মতো নাটক দেখেছেন ঢাকাবাসী। শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অসাধারণ অভিনয় সবাইকে মুগ্ধ করেছে, পেশাদার শিল্পীদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয়নি তাঁদের। তাই শুধু একটি ভাষা শিখলে, শেখালে, ভালোবাসলে বা গুরুত্ব দিলেই ৩০ লাখের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে সামনের দিনগুলোতে।

আহসান হাবিব সংবাদ উপস্থাপক (ইশারা ভাষা), বাংলাদেশ টেলিভিশন
ই–মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র এই ভ ষ ৩০ ল খ সরক র উপস থ

এছাড়াও পড়ুন:

সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না, মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন: সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'আমাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে একটা নেতিবাচক সংবাদ দেখলেই যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার করে দেওয়া হয়। অত্যন্ত ভিত্তিহীন সংবাদও আমরা শেয়ার করে দেই।'

সিইসি বলেন, 'দয়া করে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না। এই মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন। তথ্যটা যেন আগে যাচাই করে তারপরে শেয়ার করেন।'

আজ সোমবার রাজধানীর ভাটারায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নে (এজিবি) এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন সিইসি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভুয়া সংবাদের প্রচার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ রোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি এসব কথা বলেন।

থানা আনসার কোম্পানি/প্লাটুন সদস্যদের আনসার মৌলিক প্রশিক্ষণের (৪র্থ ধাপ) সমাপনী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিইসি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সংবাদ দেখা মাত্রই নাগরিকদের যাচাইবাছাই করতে আহ্বান জানান সিইসি। নিশ্চিত হওয়ার আগে শেয়ার না করতে বলেন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আনসার ভিডিপির ভূমিকাকে মূল শক্তি বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, 'এনারাই অধিক সংখ্যায় নিয়োজিত থাকেন। এবং আমাদের হিসেব করতে গেলে প্রথম এদেরকেই হিসেব করতে হয় যে, কতজন আনসার ভিডিপি সদস্য আমরা মোতায়েন করতে পারব। মূল কাজটা আঞ্জাম (সম্পাদন) দিতে হয় কিন্তু আনসার এবং ভিডিপির সদস্যদের।'

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। নির্বাচনকালীন জনগণের নিরাপত্তা, ভোট কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণে আনসার বাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি। নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রায় ৬ লাখ আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্বপালন করবেন বলেন মহাপরিচালক।

অনুষ্ঠানে মহড়ায় ঢাকা মহানগর আনসারের চারটি জোনের অধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩২০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য অংশ নেন।  আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা টহল, দায়িত্ব বণ্টন ও জরুরি প্রতিক্রিয়া অনুশীলনে অংশ নেন।

মহড়ায় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া, ভোটারদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ভোট প্রদানে সহায়তা, জাল ভোট প্রতিরোধ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা এবং সেনা, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন জোনের অধিনায়ক এবং প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ