মালেকা বেওয়ার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। রেলওয়ে জংশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ভিড়লেই যাত্রীদের কাছে সকাল-সন্ধ্যা হাত পাতেন। রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েন রেলবস্তির ঝুপড়িতে। হাড়কঁাপানো শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় জীবনযাত্রা অচলপ্রায়। বেলা গড়ালেও রেলস্টেশনে যাত্রীদের তেমন আনাগোনা নেই।
মালেকা বেওয়ার ঝুলিতে ভিক্ষা জুটেছে মাত্র ১১ টাকা। দুপুরে খাবার জুটবে কীভাবে, তা নিয়ে ভাবছেন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা দুইটা ছুঁই ছুঁই। রেলওয়ে জংশনে ভ্যানভর্তি খাবার আর কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে হাজির হলেন আজিজুল হক (৫১)। স্টেশনজুড়ে তাঁকে সবাই ‘রাজা’ নামেই চেনেন। ছিন্নমূল মানুষের উদ্দেশে রাজার হাঁক, আসেন, বসেন, গরম–গরম খাবার খেয়ে নেন।
মালেকা বেওয়ার মতো রেলস্টেশনের প্রায় ১৫০ জন ভবঘুরে ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, মুসাফির ও অনাহারি মানুষকে বসিয়ে সবার পাতে গরম ভাত আর কাতল মাছের আলুঘাঁটি পরিবেশন করলেন আজিজুল। ছিন্নমূল মানুষেরা পেটপুড়ে খেলেন সেদিন।
স্টেশনজুড়ে তাঁকে সবাই ‘রাজা’ নামেই চেনেন। ছিন্নমূল মানুষের উদ্দেশে রাজার হাঁক, আসেন, বসেন, গরম–গরম খাবার খেয়ে নেন।এ দৃশ্য গত ২২ জানুয়ারি বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার রেল জংশনের। করোনার সময় থেকে শুরু করে পাঁচ বছর ধরে রেলস্টেশনে অনাহারি ও নিরন্ন মানুষের মুখে আহার তুলে দিচ্ছেন আজিজুল হক ওরফে রাজা।
দুপুর ও রাতের আহার ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোজাদার মানুষের মধ্যে সাহ্রি ও ইফতারি বিতরণ করেন তিনি। নিজ উদ্যোগে সপ্তাহে এক দিন এবং অন্যদের দানের টাকায় মাসে এক দিন বড় করে খাবারের আয়োজন করেন আজিজুল। শুধু কি খাবার, অসহায়–দরিদ্রদের মধ্যে কম্বল ও গরম কাপড় বিতরণ, রেলস্টেশনের যাত্রীদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, অসুস্থ যাত্রীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, বৃদ্ধ ও অসহায় যাত্রীদের ট্রেনে ওঠানামায় সাহায্য করা, জংশনে ফেলে যাওয়া মূল্যবান জিনিসপত্র নিজ উদ্যোগে প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ নানা মানবিক কাজ করেন তিনি। এ জন্য সান্তাহার রেলস্টেশনের মানুষজন আজিজুল হক রাজাকে ‘গরিবের রাজা’ বলেও ডাকেন।
স্টেশনের ভিক্ষুক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী রেলবস্তির মো.
কৈশোর থেকেই মানবসেবা
সান্তাহার পৌরসভার মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডসংলগ্ন ঢাকাপট্টি মহল্লার বাসিন্দা আজিজুল হক পেশায় কুঁচিয়া মাছ ব্যবসায়ী। তাঁর আদি বাড়ি রানীনগর উপজেলার বেলোবাড়ি গ্রামে। জন্ম ১৯৭২ সালে। বাবা মনসুর আলী ছিলেন রেলগাড়ির চালক।
দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আজিজুল হক সান্তাহার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক পাস করেন। এরপর থিতু হন কুঁচিয়া কেনাবেচার ব্যবসায়। এলাকা থেকে পাইকারি দরে কুঁচিয়া মাছ কিনে ঢাকায় সরবরাহ করেন।
মানবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল হক জানান, বাবা রেলগাড়ির চালক হওয়ায় শৈশব কেটেছে রেল জংশনে। কিশোর বয়স থেকেই রেলস্টেশনে ছিন্নমূল, ভবঘুরে মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতার অভ্যাস তৈরি হয় তাঁর। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে প্রায়ই রুটি-বিস্কুট কিনে দিতেন।
আজিজুল হকের একমাত্র ছেলে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়েন। স্ত্রী রেহেনা আকতার ব্র্যাকের হিসারক্ষক পদে কর্মরত। স্বামীর কাজকর্ম সম্পর্কে রেহেনার ভাষ্য, ‘একসময় বিরক্ত হতাম। এখনতো রান্নাবান্না করে ওর কাজে সাহায্য করি।’
করোনাকাল থেকে শুরু
২০২০ সালের ২৪ মার্চ দেশে করোনা অতিমারি ও বিধিনিষেধের সংকটকাল শুরু হয়। ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ায় রেলজংশনে কয়েক শ মানুষ অনাহারে দিন কাটাতেন। এসব মানুষকে দুই বেলা আহারের মাধ্যমে জংশনে মানবিক কর্মকাণ্ডের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
বর্তমানে নিজ অর্থায়নে প্রতিদিন সাত-আটজন ভিক্ষুককে দুপুর বা রাতে এক বেলা খাওয়ান আজিজুল। এ ছাড়া দুই মাস পরপর ১৫০-২০০ জনকে মধ্যাহ্নভোজ করান।
আজিজুল হক বলেন, প্রতিদিন আটজন মানুষকে এক বেলা খাওয়াতে খরচ হয় ৪০০ টাকা। সে হিসাবে মাসে ১২ হাজার, আর বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। বছরে পাঁচ-ছয়টি বড় ভোজের আয়োজনে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা করে। এর বাইরে পিঠা উৎসব, শরবত বিতরণ, ইফতারি বিতরণে খরচ হয় আরও ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এসবই তিনি নিজ খরচে করেন। ব্যাংকে তাঁর কোটি টাকার সঞ্চয় আছে। সেখান থেকে দরিদ্রদের কল্যাণে বছরে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়।
বর্তমানে নিজ অর্থায়নে প্রতিদিন সাত-আটজন ভিক্ষুককে দুপুর বা রাতে এক বেলা খাওয়ান আজিজুল। এ ছাড়া দুই মাস পরপর ১৫০-২০০ জনকে মধ্যাহ্নভোজ করান।আজিজুল হকের মানবিক নানা উদ্যোগের প্রশংসা করে সান্তাহার পৌরসভার সাবেক মেয়র তোফাজ্জল হোসেন বলেন, তাঁর কাজ প্রশংসনীয়। তিনি খুবই মানবিক মানুষ। তাঁর এ মহতী কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু রেলওয়ে জংশন এলাকায় নয়, গোটা সান্তাহার শহরেই আজিজুল হক ‘গরিবের রাজা’ নামে পরিচিত।
আজিজুল হক বলেন, ‘আজীবন মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই। একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ার স্বপ্ন আছে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব তরণ
এছাড়াও পড়ুন:
দিনাজপুরে শিয়ালের কামড়ে আহত ৮
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় শিয়ালের কামড়ে আটজন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার রাত আটটা থেকে নয়টার মধ্যে উপজেলার পুঁটিমারা ইউনিয়নের আন্দলগ্রাম সারাইপাড়া, নয়াপাড়া, চণ্ডীপুর ও বেড়ামাইল গ্রামে এসব ঘটনা ঘটে।
আহত ব্যক্তিরা হলেন আন্দলগ্রাম সারাইপাড়া এলাকার রকিব মিয়া (৬২), চড়ারহাট এলাকার এনামুল হক (৪৬) ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৩৫), ইসাহাক আলী (৪৫), আবদুল হক (৫০), হীরা (২৬), চণ্ডীপুর গ্রামের ফসি উদ্দিন (৪৫) ও বেড়ামাইল গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন (২৫)।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, শিয়ালের কামড়ে আহত আটজনের মধ্যে পাঁচজন গতকাল রাতেই বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (ইউপি সদস্য) শেফালী বেগম ও আহত রকিব মিয়া বলেন, শুক্রবার রাত আটটার দিকে নবাবগঞ্জের চড়ারহাট বাজার থেকে কয়েকজন পথচারী হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে নয়াপাড়া গ্রামে ঢোকার সময় রাস্তায় একটি শিয়াল অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শিয়ালটি দৌড়ে এসে পথচারীদের পায়ে ও হাঁটুর নিচে কামড় দেয়। এ সময় কেউ কেউ শিয়ালটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করলে সেটির সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয়। পরে শিয়ালটি পালিয়ে যায়।
শেফালী বেগম বলেন, ওই রাতেই নয়াপাড়া গ্রামে মরিয়ম বেগম নামের এক নারী বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি শিয়াল এসে তাঁর পায়ে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে সারাইপাড়া, নয়াপাড়া, বেড়ামাইল ও চণ্ডীপুর গ্রামের আটজনকে শিয়াল কামড় দেয়।
বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তাহাজুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে শিয়ালের কামড়ে আহত পাঁচজন রোগী হাসপাতালে আসেন। তাঁরা সবাই চিকিৎসা নিয়ে রাতেই বাড়ি ফিরে গেছেন।