রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা
Published: 11th, February 2025 GMT
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ বহাল চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। নাম পরিবর্তনের এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা। দাবির পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি যুক্তি চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও।
নাম পুনর্বহাল চাওয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামটি পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করে। রংপুর শহরে বেগম রোকেয়ার নামে একটি সরকারি মহিলা কলেজ আছে। একই নামে পাশাপাশি দুটি সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচয় দিতে অস্বস্তিতে ভোগেন।
তবে নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় রাখার পক্ষে থাকা শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বলছেন, বেগম রোকেয়ার লেখা ও কর্ম সারা বিশ্বে স্বীকৃত। বেগম রোকেয়ার বাড়ি রংপুরে হওয়ায় তাঁর নামের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় একটি আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। নাম পরিবর্তনের দাবির পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল অনেক পুরোনো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালে ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটির আর শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রংপুরের মানুষের দাবির মুখে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া একাধারে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। ভারতের কলকাতায় ১৯৩২ সালের একই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
যে যুক্তিতে নাম পরিবর্তন চান তাঁরানাম পরিবর্তনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির সদস্যসচিব রহমত আলী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক শামসুর রহমান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভাগীয় শহরে হওয়ায় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামটি পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বেগম রোকেয়ার নামে বিশেষায়িত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেত। কেননা রংপুর শহরে (পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে) বেগম রোকেয়া সরকারি মহিলা কলেজ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নারীদের উচ্চশিক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। একই নামে পাশাপাশি দুটি সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচয় দিতে অস্বস্তিতে ভোগেন।
সংবাদ সম্মেলনে নামকরণ পুনর্বহালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাত দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুনবেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন২২ ঘণ্টা আগেএ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার রহমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই আন্দোলন হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর চাওয়া নামকরণ পুনর্বহালের। সেই জায়গা থেকে আমরা কোনো ব্যানার গ্রহণ করিনি। দলমত–নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’
আরেক শিক্ষার্থী শামসুর রহমানের দাবি, এই আন্দোলন হঠাৎ করে নয়। ২০১৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাম পুনর্বহালের আন্দোলন করে আসছেন। কয়েক মাস ধরে স্মারকলিপি, গণস্বাক্ষর, বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ইউজিসি ও শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
শামসুর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কবর রচনা করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ রংপুরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি মোড়কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু একটি নামের মধ্য দিয়ে। আমরা এটার প্রতিবাদ করছি। এখানে ব্যক্তি বেগম রোকেয়াকে কোনোভাবে আনছি না।’
নাম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বেগম রোকয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবিনা আক্তার মনে করেন, বেগম রোকেয়া সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী বেগম রোকেয়ার নাম বহাল রাখার পক্ষে উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁরা বেগম রোকেয়ার লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত এবং তাঁকে নিয়ে গবেষণার জন্য দাবি জানান। অথচ উল্টো এখন বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোয়েব শাহিন গতকালের সংবাদ সম্মেলনের একটি ছবি তাঁর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘আচ্ছা এইগুলো কি ফাজলামি মনে হয় না? কমপ্লিট শাটডাউন দেওয়ার পক্ষে ক’জন, নাম পরিবর্তনের পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই আছে। আর আপনারা দেখি মাঝেমধ্যেই বলেন, কাল থেকেই নাম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আপনাদের হাতে কি বিশ্ববিদ্যালয় তুলে দেওয়া হইছে?’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব গম র ক য় র ন ম সরক র র ন মকরণ হওয় য়
এছাড়াও পড়ুন:
ভৈরব পৌর স্টেডিয়াম থেকে সরানো হলো আইভি রহমানের নাম
কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর স্টেডিয়াম থেকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভি রহমানের নাম সরানো হয়েছে। নতুন নাম করা হয়েছে ‘উপজেলা স্টেডিয়াম’।
আইভী রহমান ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। তিনি তখন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন।
নাম বদলকে কেন্দ্র করে ভৈরবে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। স্থানীয় একজন সাংস্কৃতিক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নামকরণ বা পরিবর্তনের পেছনে কোনো সার্বজনীন চিন্তা কাজ করেনি; বরং এতে ক্ষমতার প্রভাবই স্পষ্ট।’
স্বাধীনতার পর তিন একর জায়গায় ভৈরব-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ভৈরবপুর উত্তরপাড়ায় এই স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। তখন এর নাম ছিল ‘ভৈরব পৌর স্টেডিয়াম’। শুরু থেকেই এর ব্যবস্থাপনায় ছিল পৌর প্রশাসন।
আইভি রহমানের স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও তাঁর বাবার বাড়ি ভৈরবে। তাঁর ছেলে নাজমুল হাসান পাপন কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মায়ের নামে স্টেডিয়ামটির নামকরণের উদ্যোগ নেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মাণের পর ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ আইভি রহমান পৌর স্টেডিয়াম’ হিসেবে এটি উদ্বোধন করা হয়।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর স্টেডিয়ামসহ আইভি রহমানের নামে করা বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে স্টেডিয়ামের নতুন নাম ‘উপজেলা স্টেডিয়াম’ নির্ধারণ করে উপজেলা ও পৌর প্রশাসনকে জানানো হয়। পরে পুরোনো নামফলক সরিয়ে নতুন নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।
ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে আইভি রহমানের নাম সরিয়ে দিল। আবার সুযোগ বুঝে আমরাও টানিয়ে নিব।’
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক শবনম শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে নাম পরিবর্তনের চিঠি পাওয়ার পর স্টেডিয়ামের নামফলক পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন থেকে এটি অফিশিয়ালি ‘উপজেলা স্টেডিয়াম’ নামে পরিচিত হবে।