দেশে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সমাজের বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

কারণ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হলো কোনো ব্যক্তি এবং ব্যবসার নির্দিষ্ট পরিচয়, আয়ের স্তর বা ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে একটি কার্যকর, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে আর্থিক সেবা এবং পরিষেবাগুলোতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার একটি সুচিন্তিত প্রক্রিয়া।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনের অবসানের পরপরই দেশের সামগ্রিক খাতে পরিবর্তনের দাবি ওঠে। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্তনের দাবি ছিল সবার ওপরে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্বের পরিবর্তনসহ অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু ত্বরিত পদক্ষেপ হাতে নেয়।

এখনো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে, যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের গুরুত্ব বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে এখনো যথেষ্ট মাত্রায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আরও পড়ুনব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে কী করে১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য হ্রাসের মতো একটি বিরাট ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে।

তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে এখনো তিন কোটি মানুষ আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে আছে।

আর বিশ্বের মোট ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা গ্রামীণ এলাকায় থাকেন, তাঁরা এখনো তাঁদের সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ঋণ, বিমা সুবিধা ও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার মতো মৌলিক আর্থিক পরিষেবাগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এখনো ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত।

এই বিশাল জনসংখ্যাকে প্রায়ই অনানুষ্ঠানিক আর্থিক চ্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেকটা অবিশ্বাস্য, অনিরাপদ ও ব্যয়বহুলও বটে।

সুতরাং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।

এটি অসংখ্য মানুষের, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির ব্যাপক সম্ভাবনা রাখে।

কিন্তু এখনো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুনবাংলাদেশ ব্যাংককে কথা নয় কাজ দেখাতে হবে২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক৩৪ শতাংশের বেশি মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন।

এ অঞ্চলগুলোতে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট আউটলেটের অভাবের কারণে অনেক মানুষ ব্যাংকিং পরিষেবা গ্রহণ করতে পারেন না।

অনেক সময় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে তাঁদের সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থিক সাক্ষরতার হার মাত্র ২৮ শতাংশ, তার মানে প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ এখনো ব্যাংক, ব্যাংকিং প্রোডাক্ট বা সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, এ সম্পর্কে পরিচিত নন।

আর্থিক সাক্ষরতার এই জ্ঞানের অভাব আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবাগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেককে অবিশ্বাস্য ও অনিশ্চয়তার লেনদেনের দিকে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে কারও জীবনকে আর্থিক ভয় ও উদ্বেগের দিকে ধাবিত করতে পারে।

এ ছাড়া দেশের প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার নারীদের জন্য সংস্কৃতিগতভাবে সীমাবদ্ধতা, চলাফেরায় ধীরস্থিরতা এবং আর্থিক অক্ষমতার কারণে তাঁরা আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবাগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল ব‍্যাংকিং ও ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার উত্থান বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচেষ্টায় বিপ্লব এনেছে।

দেশে মোবাইল ফোনের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, ডিজিটাল পেমেন্টের উদ্ভাবনের সঙ্গে মিলিত হয়ে গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মানুষদের জন্য ব্যাংক শাখার প্রয়োজন ছাড়াই আর্থিক পরিষেবা গ্রহণে করতে সক্ষম হচ্ছেন।

আরও পড়ুনআলোচিত ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কী১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার প্রসারের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে বিকাশ, যা প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ গ্রাহক ব্যবহার করেন এবং নগদ, যা প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহক ব্যবহার করেন।

উভয় প্ল্যাটফর্ম দুটি প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি কীভাবে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খুব সহজে অর্থ প্রেরণ, অর্থ গ্রহণ, বিল পরিশোধ, সঞ্চয় ও ডিজিটাল ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব স্বীকার করেছে।

দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখার প্রয়াসে আর্থিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার জন্য সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল ও ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য, পূর্বের সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষেত্রে সুযোগ উন্মুক্ত করার জন্য, আর্থিক প্রোডাক্টের জন্য গ্রাহকের ভিত্তি সম্প্রসারণ করার জন্য, দেশের একটি প্রাণবন্ত এবং স্থিতিশীল আর্থিক খাত গঠনে অবদান রাখার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ চালু করেছে।

এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখা ও ক্ষুদ্রঋণ খোলার জন্য নিয়মকানুন তৈরি করা, সেই সঙ্গে আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি এবং স্কুল ব্যাংকিং ও কৃষি ব্যাংকিং উদ্যোগসহ নো-ফ্রিল অ্যাকাউন্ট খোলার কর্মসূচি চালু করা ইত্যাদি।

পাশাপাশি সরকার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে থাকে, যাতে ব্যাংকগুলো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের জন্য সরকারঘোষিত ভর্তুকি এবং প্রণোদনা প্রদানের কাজ চালিয়ে যায়।

অধিকন্তু সরকার আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস অর্থাৎ অভিবাসীদের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করছে।

মোদ্দাকথা সরকার আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন‍্য যথেষ্ট আন্তরিক, তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।

বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

এর ফলে লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা নিজ উদ্যোগে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করতে বা তাঁদের জীবিকা উন্নত করতে এবং দারিদ্র্যের চক্র থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন।

আরও পড়ুনব্যাংকিং খাতের যেসব সমস্যার জরুরি সমাধান প্রয়োজন০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২০২৩ সালের ৩০ জুনের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন, যাঁর মধ্যে ৩ কোটি ১৫ লাখই ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা।

তবু ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ও ঋণচক্রের জন্যও কারও কারও দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো কিছু সমালোচনাকে উপেক্ষা করে বা আমলে নিয়ে আরও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সারা দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ক্ষুদ্রঋণ আরও টেকসই এবং সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, তা নিশ্চিত করা।

দেশের প্রতিটি কোণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুবিধা পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল অবকাঠামোতে আরও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাভারেজের সম্প্রসারণ ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবাগুলোকে সহজতর করতে এবং সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

ডিজিটালাইজেশনের বাইরেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সাফল্যের জন্য আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী।

এ ছাড়া নারী-পুরুষের আর্থিক বৈষম্য দূর করতে হলে সমগ্র দেশে নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ দশমিক ৮০ শতাংশ।

দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনশক্তি তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার, যাঁদেরকেও আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত হতে উৎসাহিত করতে হবে।

ইতিমধ্যে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্রঋণ আর্থিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তথা ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।

একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন সব প্রোডাক্ট উদ্ভাবন করতে হবে, যা ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।

নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের জন্য তৈরি আকর্ষণীয় সুবিধার সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা এবং বিমা পণ্যগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেশজুড়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।

অন্যদিকে আর্থিক ব্যবস্থায় জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি ও উদ্যোগগুলোকে যথাযথভাবে প্রচার করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাত আরও টেকসই ও সুনিয়ন্ত্রিত হবে।

ইতিমধ্যে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্রঋণ আর্থিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তথা ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ ক্ষেত্রে সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাধাগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, যা সব নাগরিককে ক্ষমতায়ন করে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

এম এম মাহবুব হাসান, বাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ষ ঠ ন ক আর থ ক আর থ ক ব যবস থ ম ট জনস খ য র আর থ ক প র ন র জন য র র জন য ও আর থ ক র জন য ব ব শ ষ কর য দ র কর গ র হক সরক র গ রহণ ত করত র করত

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন ৬৮% শিক্ষার্থী, গুনতে হয় বাড়তি টাকা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাকিবুল হাসান তিনবার হলে আসন পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। একজন অধ্যাপকের সুপারিশও ছিল। এরপরও তিনি শহীদ হবিবুর রহমান হলে উঠতে পারেননি। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একটি মেসে থাকছেন। ভাড়া আড়াই হাজার, খাওয়াদাওয়া ও যাতায়াত মিলিয়ে মাসে তাঁর খরচ হচ্ছে চার হাজার টাকার মতো।

এই টাকা জোগাড় করা তাঁর জন্য কঠিন উল্লেখ করে শাকিবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইরে থাকতে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। রোজ রিকশাভাড়া দিতে হয়। হলে থাকলে খরচ ও চিন্তা দুই–ই কমত।’

নৃবিজ্ঞান বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাসবির হাসানের ভাগ্য অবশ্য শাকিবুলের মতো মন্দ নয়। তিনি আসন পেয়েছেন শাহ মখদুম হলে। তাঁর বড় ভাই একই হলে থাকায় আসন পাওয়া সহজ হয়েছে। তাসবির বললেন, ‘হলে ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা। বাইরে থাকলে মাসিক ভাড়া দুই-তিন হাজার টাকা হতো।’

অথচ দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসনসুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। বাস্তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হচ্ছে।

সাড়ে তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন সামনে রেখে আবাসনসংকটের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা আবাসনসংকট দূর করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

বাইরে থাকতে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। রোজ রিকশাভাড়া দিতে হয়। হলে থাকলে খরচ ও চিন্তা দুই–ই কমত।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাকিবুল হাসানশিক্ষার্থী কত, হল কয়টি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। তখন স্থায়ী ক্যাম্পাস ছিল না। রাজশাহী কলেজ, বড়কুঠিসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ক্লাস ও অফিস চলত। শুরুতে শিক্ষার্থী ছিলেন মাত্র ১৬১ জন। ১৯৫৮ সালে নিজস্ব ক্যাম্পাস গড়ার কাজ শুরু হয়, আর ১৯৬৪ সালে মতিহারের ৭৫৩ একর জায়গায় বর্তমান ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয়।

এখন ১২টি অনুষদের আওতায় ৫৯টি বিভাগ ও ৬টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তাঁদের জন্য আছে ১৭টি আবাসিক হল ও একটি আন্তর্জাতিক ডরমিটরি। এর মধ্যে ছেলেদের জন্য ১১টি, মেয়েদের জন্য ৬টি হল। আন্তর্জাতিক ডরমিটরিতে থাকেন বিদেশি শিক্ষার্থী ও এমফিল-পিএইচডি পর্যায়ের গবেষকেরা। সব মিলিয়ে আবাসনসুবিধা আছে মাত্র ৯ হাজার ৬৭৩ জনের জন্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর ৩২ শতাংশ হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।

হলে ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা। বাইরে থাকলে মাসিক ভাড়া দুই-তিন হাজার টাকা হতোনৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাসবির হাসানবিভাগ বেড়েছে, হল বাড়েনি

বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৫ বছরে বিভাগ বেড়েছে ২৩টি, নতুন অনুষদ হয়েছে ৭টি। একই সময়ে ৪টি নতুন ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে। এর গত ১৫ বছরে ১৪টি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে।

২০১৫ সালে চারুকলাকে পূর্ণ অনুষদে রূপান্তর করে এর অধীনে ৩টি বিভাগ চালু হয়। জীববিজ্ঞান অনুষদে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ এবং ফিশারিজ ও ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদও এই সময়ে গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভস থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন প্রায় ২১ হাজার, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজারে। অর্থাৎ ২৫ বছরে শিক্ষার্থী বেড়েছে ৯ হাজার। কিন্তু এ সময়ে নতুন হল হয়েছে মাত্র ৩টি।

বেগম খালেদা জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শারমিন হামিদ জানান, তাঁর হলে বরাদ্দ আসন ১ হাজার ২০০। আসনসংকটে অর্ধেক শিক্ষার্থীই জায়গা পান না।ছাত্রী হলে ‘গণরুম’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ছাত্রী হলে আসনসংকট আরও প্রকট। প্রতিটি হলে গণরুম চালু আছে, যেখানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। এতে পড়াশোনা ও ঘুম দুই–ই ব্যাহত হয়। রোকেয়া হলের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আর্থিক অবস্থার কারণে মেসে থাকতে পারিনি। হলে আসতে হয়েছে শিক্ষকদের সুপারিশে। কিন্তু এখানে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।’

বেগম খালেদা জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শারমিন হামিদ জানান, তাঁর হলে বরাদ্দ আসন ১ হাজার ২০০। আসনসংকটে অর্ধেক শিক্ষার্থীই জায়গা পান না। বিকল্প হিসেবে গণরুম চালু করে বাড়তি ১০০ ছাত্রীকে রাখা হচ্ছে। অন্য ছাত্রী হলগুলোরও একই অবস্থা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভস থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন প্রায় ২১ হাজার, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজারে। অর্থাৎ ২৫ বছরে শিক্ষার্থী বেড়েছে ৯ হাজার। কিন্তু এ সময়ে নতুন হল হয়েছে মাত্র ৩টি।আসন–বাণিজ্য ও নির্যাতন

বিগত সরকারের শেষ মেয়াদে হলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হাতে। প্রাধ্যক্ষরা কার্যত আসন বরাদ্দ দিতে পারতেন না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলে আসন পেতে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘ঘুষ’ দিতে হতো ছাত্রলীগের নেতাদের। অভিযোগ আছে, যাঁরা স্বাভাবিক নিয়মে আসন নিতেন, তাঁদের নির্যাতন করে বের করে দেওয়া হতো। অনেক কক্ষ দখল করে রাখতেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের অছাত্র নেতা-কর্মীরা। হলে রাজনৈতিক ব্লক গড়ে ওঠে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। প্রশাসনের দাবি, এখন মেধার ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

নতুন দুই হলেও সংকট কাটবে না

২০১৮ সালে ১০ তলার শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও শেখ হাসিনা হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। কামারুজ্জামান হলের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। আগামী ডিসেম্বরে সেখানে শিক্ষার্থীরা উঠতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এতে আসন থাকবে এক হাজার। শেখ হাসিনা হলের ধারণক্ষমতা হবে ৮০০ জনের। তবে এটির কাজ হয়েছে মাত্র ৬০ শতাংশ। আগামী জুনে এটির কাজ শেষ হতে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক এস এম ওবায়দুল ইসলাম জানান, কামারুজ্জামান হলে ৫১৯টি কক্ষ থাকবে, প্রতিটিতে দুই আসন। হাউস টিউটরসহ প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী জায়গা পাবেন। শেখ হাসিনা হল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হলে আরও ৮০০ শিক্ষার্থী যুক্ত হবে। তবে এতে সমাধান আসবে সীমিত পরিসরে, কারণ মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় এই আসন সংখ্যা নগণ্য।

আবাসনের সুবিধা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রচুর সমস্যায় ভোগেন। আমরা নির্বাচিত হলে নতুন হল নির্মাণের দাবি জানাব এবং যেস শিক্ষার্থী এই সুবিধা পায় না, তাদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থার জন্য জোরালো দাবি জানাব।ছাত্রদল–মনোনীত জিএস প্রার্থী নাফিউল ইসলামরাকসু নির্বাচনে আবাসন বড় ইস্যু

রাকসু নির্বাচন সামনে রেখে আবাসন সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন প্রার্থীরা। এ বিষয়ে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মেহেদী সজীব বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার পর থেকেই যেন সব শিক্ষার্থী হলে থাকতে পারেন—এ দাবিকে আমরা গুরুত্ব দেব।’

ছাত্রদল–মনোনীত জিএস প্রার্থী নাফিউল ইসলাম (জীবন) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসনের সুবিধা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রচুর সমস্যায় ভোগেন। আমরা নির্বাচিত হলে নতুন হল নির্মাণের দাবি জানাব এবং যেস শিক্ষার্থী এই সুবিধা পায় না, তাদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থার জন্য জোরালো দাবি জানাব।’

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘আবাসন ভাতা’ দেওয়ার দাবি জানিয়ে শিবির–সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফাহিম রেজা। তিনি বলেন, আবাসনসংকট নিরসন না হওয়ায় ভাতা দিতে হবে। তাঁরা নির্বাচিত হন বা না হন, তাঁরা এই দাবি বাস্তবায়নে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন।

দুই হলের কাজ চলছে। কামারুজ্জামান হলে এ বছরের ডিসেম্বরেই শিক্ষার্থীরা উঠতে পারবেন। শেখ হাসিনা হলের নির্মাণকাজ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া পাঁচটি নতুন হল নির্মাণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। শেরেবাংলা ফজলুল হক হল ভেঙে ১০ তলা ভবন করার প্রস্তাবও একনেকে পাঠানো হয়েছে।সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন

‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী তাসিন খান হলে আসন না পাওয়া নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করলে নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারকে জানাব।’

শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকট সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। তবে এ বিষয়ে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, দুই হলের কাজ চলছে। কামারুজ্জামান হলে এ বছরের ডিসেম্বরেই শিক্ষার্থীরা উঠতে পারবেন। শেখ হাসিনা হলের নির্মাণকাজ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া পাঁচটি নতুন হল নির্মাণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। শেরেবাংলা ফজলুল হক হল ভেঙে ১০ তলা ভবন করার প্রস্তাবও একনেকে পাঠানো হয়েছে। আবাসনসংকট সমাধানের তাঁরা চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ