কোনো জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বহুত্বকে একটি আধিপত্যশীল সংস্কৃতির অধীনে আনার চেষ্টা কিংবা একটি ভাবাদর্শের নামে কোনো সাংস্কৃতিক চর্চাকে আক্রমণ করা, বিরত রাখা এবং ওই জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে কাটছাঁট করে একটি কল্পিত শুদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণের ধারণাই সাংস্কৃতিক একান্তবাদ। এর উদ্ভব হয়তো বিশুদ্ধ সংস্কৃতির ধারণা থেকে। কিন্তু বিশুদ্ধ ভাষার ধারণার মতো সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার কল্পনাও একটি মিথ। নানা দেশের ফ্যাসিস্ট সরকার বা গোষ্ঠী এই মিথকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে। কাজেই সাংস্কৃতিক একান্তবাদ একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। সুনির্দিষ্ট করে বললে, একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক প্রকল্প।

বিশুদ্ধ সংস্কৃতি বলে কিছু হতে পারে না। এমনকি জাতিসংস্কৃতিও বিশুদ্ধ নয়। জাতিসংস্কৃতি বলতে সাধারণত কোনো জাতিগোষ্ঠীর কতিপয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকেই কেবল মোটাদাগে চিহ্নিত করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন সমাজের নানা তলে ভিন্ন ভিন্ন রকম, তেমনি দেখা যাবে, স্থান-কালভেদে ওই সংস্কৃতির ভেতর তৈরি হচ্ছে বিচিত্র গড়ন। যে বস্তুগত উপাদান ও কর্মকাণ্ড দিয়ে সংস্কৃতির একেকটি নকশা বা ছক তৈরি হয়, তার ভেতর যেমন ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির উপাদান যুক্ত থাকে, তেমনি ওই সব উপাদান ছড়িয়ে যায় অন্যান্য সংস্কৃতির ভেতর। সংস্কৃতির এই বুনন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ কেবল এক জাতির দেশ নয়। এ দেশের সংস্কৃতিকে জাতিসংস্কৃতির ভেতর আঁটানো অসম্ভব। আমাদের সংস্কৃতির প্রধান উপাদানগুলো—যেমন ভাষা, সাহিত্য, কৃষি—কেবল একটি জাতির সৃষ্টি ও উদ্ভাবন নয়। এ দেশের সংস্কৃতির পরিবেশনাগত ও বস্তুগত উপাদান, যেমন সংগীত, লোকাচার, লোক-উৎসব, লোকশিল্প ইত্যাদিতে নানা জাতির মানুষের অবদান আছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত আছেন নানা জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ। এসব কর্মকাণ্ড ও সাংস্কৃতিক উপাদানকে কেবল একটি ভাবাদর্শ দিয়ে কাটছাঁট করতে গেলে সেই ভাবাদর্শ এক নিরঙ্কুশ ফ্যাসিজমের জন্ম দেবে।

আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা, কিন্তু অন্য অনেক ভাষার মানুষও এ দেশে বাস করেন। প্রতিটি ভাষারই আলাদা সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে, প্রতিটি ভাষাই ধারণ করে আলাদা একেকটি জগৎ। এই বিচিত্র পরিপ্রেক্ষিতকে কোনো একান্তবাদী ধারণা দিয়ে ফ্রেমবন্দী করার চেষ্টা জবরদস্তিমূলক। অন্যদিক থেকে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এ দেশের মানুষের যে দার্শনিক চিন্তা, বিশ্বাস ও বোধকে প্রকাশ করে, তাকে একান্তবাদের ফ্রেমে বাঁধতে যাওয়া মানে খোলা আকাশকে নীল রিবন দিয়ে মোড়ানোর চেষ্টা।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আছে নানা জাতি, ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষের অবদান। যে প্রাকৃত ভাষায় সরহ, কাহ্ন কিংবা ভুসুকুপা চর্যাপদ ও ‘দোহাকোষ’ লিখেছেন, তা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভবে বৌদ্ধ সহজিয়াদের তত্ত্বীয় বাহাস-বিতর্ক ও চিন্তার দ্বন্দ্ব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। প্রথম বাংলা গদ্য লিখেছেন বৌদ্ধ সহজিয়ারা এবং তাঁরা ‘চম্পুকাব্য’ লিখেছেন বাংলা গদ্য-পদ্য মিলিয়ে। বাংলার চৈতন্যভক্তরা সংস্কৃত ভাষায় না লিখে বইপত্র লিখেছেন বাংলা ভাষায়। যদিও তখনকার দিনে তাঁদের ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় বইপুস্তক সংস্কৃততে লেখাই ছিল নিয়ম। বাংলায় লেখার কারণে বৈষ্ণব সহজিয়াদের গৌড়ীয় গোস্বামীদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। বাংলায় লিখেছেন বলে কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বইটি যমুনা নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন শ্রীজীব গোস্বামী। তথাপি সহজিয়া বৈষ্ণবেরা বাংলাতেই লিখেছেন। তাঁরা কাব্য, দর্শনতত্ত্ব ও চরিতাখ্যান লিখে বাংলা ভাষার এক বিস্তৃত ভাবজগৎ নির্মাণ করেন।

বাংলা ভাষায় লেখার জন্য এ দেশের সুফি কবি ও সুফিসাধকদেরও সামাজিক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আরবি-ফারসিতে না লিখে বাংলায় লেখার কারণে তাঁরা গোঁড়া মুসলমানদের তোপের মুখে পড়েছেন। সেই ষোলো-সতেরো শতকেও তাঁদের বিরুদ্ধে ভাষা ব্যবহারে হিন্দুয়ানির অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তাঁরা স্থানীয় ধর্ম ও দর্শনের পরিভাষা ব্যবহার করেই সুফিতত্ত্ব প্রচার করেন এবং বাংলায় লেখার যুক্তি তুলে ধরেন। সেই সময় সুফিরা জোরালোভাবে বাংলায় লেখার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং আমরা দেখতে পাই, কবি আবদুল হাকিম বিরোধী পক্ষকে ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ বলে ধিক্কার দিয়েছেন।

এটা স্পষ্ট যে সংস্কৃতি দিয়েই নির্ধারিত হয় কোনো একটা জনগোষ্ঠীর চিন্তার জগৎ। কাজেই সংস্কৃতির মতো চিন্তার বিশুদ্ধতা বলেও কিছু থাকতে পারে না, যেমনটা আমরা দেখি সুফিতত্ত্ব ও সুফিসংস্কৃতির ক্ষেত্রে। আরব ও পারসিক সুফি ধারাগুলো ভারতবর্ষ হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে তেরো-চৌদ্দ শতকে। এর কয়েক শ বছরের মধ্যে এসব ধারার সঙ্গে স্থানীয় দর্শন ও সংস্কৃতির একটা নিবিড় সংযোগ তৈরি হয়। ষোলো ও সতেরো শতকে লেখা সুফিসাহিত্যের বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, বাংলার সুফিসাধক ও সুফি কবিদের মধ্যে জাত-ধর্ম নিয়ে পরিচয়বাদী কোনো ভেদজ্ঞান কাজ করেনি। তাঁরা স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর চিন্তা প্রকাশের পরিভাষা ও সাধনপদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। তাঁরা সুফিতত্ত্ব প্রচার করতে গিয়ে সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধসহ নানা সম্প্রদায়ের তত্ত্বীয় পরিভাষা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেন। পরমার্থ লাভের জন্য যোগপদ্ধতি অনুসরণেও তাঁদের কোনো সমস্যা হয়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় চট্টগ্রামে পাওয়া যোগ-কলন্দর বইয়ে।

ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শ ও একান্তবাদী সাংস্কৃতিক প্রকল্প তার একান্তবাদ দিয়ে শুধু যে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে তাই না, পাশাপাশি এর মাধ্যমে জনগণের ভবিষ্যৎ আচরণকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সুফি কবি মীর সৈয়দ সুলতান নিরাকার পরম সত্তাকে বোঝাতে বৌদ্ধ ‘নিরঞ্জন’ কিংবা সাংখ্য ‘পুরুষ’ কথাটি ব্যবহার করেন। কবি হাজী মুহাম্মদ তাঁর নূরজামাল তথা সুরতনামা বইয়ে লেখেন ‘যেই আল্লা সেই খোদা গোসাঞি তার নাম।’ সুফি কবি আলী রজা ওরফে কানু ফকির তাঁর এক কবিতার ভণিতায় লেখেন, ‘শিশু আলী রজা ভণে শ্যাম কালিকা দাস।’ সেই সময় অনেক মুসলমান কবিই বৈষ্ণব কবিতা লিখেছেন। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য বাংলার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি বইয়ে এমন শতাধিক কবির কবিতা সংকলিত করেন। সতেরো শতকের বাংলায় বৈষ্ণব সহজিয়া এবং সুফিতত্ত্বের পরিভাষা ও ভাবাদর্শ এতটাই কাছাকাছি ছিল যে ১৬২৫ সালে লেখা অকিঞ্চন দাসের বিবর্ত বিলাস বইটি উনিশ শতকে মুদ্রিত হয় ‘বৈষ্ণব ও ফকিরি সম্প্রদায়ীদিগের ধর্ম্ম ও নিগূঢ় তত্ত্বাবলী’ উপশিরোনাম দিয়ে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও সুফিদের মতো জৈন, নৈয়ায়িক, নাথপন্থী ও বাউলদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। জৈন প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা প্রাকৃতের মিল কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। একইভাবে আমরা মিল পাই জৈন লিপির সঙ্গে বাংলা লিপির। দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরা যুক্তিতর্কের যে পরিভাষা ব্যবহার করি, তাতে আছে ন্যায়শাস্ত্রীদের ব্যবহৃত পরিভাষা। বাংলা অঞ্চলের বহু পুরোনো কৃষি সমাজে উদ্ভূত দেহাত্মবাদী চিন্তা এখনো টিকে আছে এ দেশের সুফি-সন্ত ও বাউল-ফকিরদের তত্ত্বচিন্তায়। ভাষা-সাহিত্য ও দর্শনের মতো এ দেশের লোকপ্রযুক্তি, লোকশিল্প, সংগীত, নৃত্য, নাট্য, লোকক্রীড়া এবং খাদ্যাভ্যাসেও যুক্ত হয়েছে নানা ধর্ম ও জাতির মানুষের জ্ঞান ও সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞা।

এমন একটি বহুত্ববাদী এবং সমন্বয়ী সংস্কৃতির ওপর যদি একটি একান্তবাদী ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেই ভাবাদর্শ এ দেশের জন্য নিশ্চয়ই বড় একটা আপদ হয়ে উঠবে। আমরা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আগে দেখেছি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি কট্টর সেক্যুলার ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে; এবং এটা করা হয়েছে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র নামে। নানা রকম অনুষ্ঠান, উৎসব, ঘোষিত-অঘোষিত আদেশ-নির্দেশ, আইন ও বিধিবিধান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি একমাত্রিক ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে এ দেশের বহু মানুষকে সব সময় প্রমাণ দিতে হয়েছে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। একটি একান্তবাদী সংস্কৃতির মাপকাঠি দিয়ে ফ্যাসিস্ট শাসক তার শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করেছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণ-অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন এক ধরনের সাংস্কৃতিক একান্তবাদের রাজনৈতিক প্রকল্প চালু হয়েছে। সুফিসাধকদের দরগা, মাজার শরিফ আর ওরস অনুষ্ঠানে হামলা হচ্ছে, আক্রমণ হচ্ছে বাউলগানের অনুষ্ঠানে কিংবা হুমকি দিয়ে এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বইপুস্তক, খেলাধুলা, বসন্ত উৎসব ও নাট্যোৎসবও তাদের সেন্সরশিপের আওতায় পড়ছে। ইসলামপন্থী কোনো কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে বলছে, ইসলামি ভাবাদর্শবিরুদ্ধ হওয়ায় তারা এগুলো বন্ধ করতে বলেছে। এটা সন্দেহাতীত যে হামলা ও প্রতিরোধের সব ঘটনাই ঘটছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষজনকে যুক্ত করা হচ্ছে তাদের ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এ রকম এক বা একাধিক গোষ্ঠী বা দলের হাতে যদি বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত হয়, তারা কি সাংস্কৃতিক একান্তবাদ প্রতিষ্ঠায় ভাষা–পুলিশ, সাহিত্য–পুলিশ, উৎসব–পুলিশ ইত্যাদি গঠন করবে?

ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শ ও একান্তবাদী সাংস্কৃতিক প্রকল্প তার একান্তবাদ দিয়ে শুধু যে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে তা–ই নয়, পাশাপাশি এর মাধ্যমে জনগণের ভবিষ্যৎ আচরণকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আধিপত্যবাদী ভাবাদর্শ এমনভাবে কাজ করে যে শাসক নির্দেশ না দিলেও তার মিত্ররা বুঝতে পারে, কোন পরিস্থিতিতে তাদের কী করতে হবে। তারা বুঝতে পারে, কোনো নাগরিক ঠিক কোন কাজ করলে বা কী লিখলে তাদের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে হবে। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিমে আমরা এমন হাজারো মামলা হতে দেখেছি। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রেও এর মিত্রদের কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশ বা আদেশ দিতে হচ্ছে না। ‘তৌহিদী জনতা’ আগে থেকেই জানে, কোন উৎসবগুলো বন্ধ করতে হবে, কোন লেখকের বই বিক্রি ঠেকাতে হবে কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঙতে হবে।

ধর্মভিত্তিক সাংস্কৃতিক একান্তবাদ সব সময় ফ্যাসিবাদের সহযোগী। এ ক্ষেত্রে মনুবাদ-হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে ‘তৌহিদী’ নামধারী উগ্রবাদের কোনো ফারাক নেই। সাংস্কৃতিক একান্তবাদীরা সব সময় এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখে, যে সমাজে মানুষের আচরণ হবে সুনির্দিষ্ট ও অনুমানযোগ্য। সেখানে আগে থেকেই বলা যাবে, কোন পরিস্থিতিতে, কখন এবং কোথায় সে কী করবে। এমন একটা সমাজ ফ্যাসিবাদের উর্বর ভূমি, কারণ তারা ভাবাদর্শিক দিক থেকে একেকটি প্রস্তুত রেজিমেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং সেখানে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা সংহত করা যেমন সহজ, তেমনি তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাও খুব সহজ।

কট্টর সেক্যুলারবাদ যেভাবে রাজনৈতিক ইসলামকে একটি একান্তবাদী সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখিয়েছে, একইভাবে ইসলামপন্থীদের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ নিঃসন্দেহে কট্টর সেক্যুলারদের শক্তিশালী করবে। খুব শিগগির যদি এই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে ঠেকানো না যায়, বাংলাদেশ অচিরেই হয়তো একটি বড় রকমের সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যে পড়বে। সে ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ও পরমতসহিষ্ণু বাংলাদেশ গড়ার লড়াই দীর্ঘতর হবে।

রায়হান রাইন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক; কথাসাহিত্যিক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ক প রকল প চ হ ন ত কর র জন ত ক প স ফ তত ত ব ভ ব দর শ এ অন ষ ঠ ন র পর ভ ত র এক পর ভ ষ উপ দ ন ক জ কর ন একট সহজ য় ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ