যে চুক্তি ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতে পারবে না
Published: 26th, February 2025 GMT
ইউক্রেনের জনগণ এখনো রুশ বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে যুদ্ধ এখন এক দীর্ঘায়িত, কঠিন পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতি টুকরা ভূমির জন্য লড়াই অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এতে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে ইউক্রেনের সহ্যশক্তি আর পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা।
এই সংকটময় সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন ইউক্রেন নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা দ্রুত একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। গত সপ্তাহে মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তারা সরাসরি আলোচনায় বসেন সৌদি আরবে। সেখানে ইউক্রেনকে রাখা হয়নি। এই বৈঠক ও ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের নামে বড় ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কূটনৈতিক সমাধান অনুসরণ করা উচিত কি না, সেটি ইউক্রেনের জন্য মূল প্রশ্ন নয়। কারণ, শেষ পর্যন্ত যেকোনো যুদ্ধই আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়। বরং আসল প্রশ্ন হলো, সেই আলোচনার শর্ত কী হবে? যদি মূল লক্ষ্য শুধু দ্রুত যুদ্ধ থামানো হয়, তাহলে ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এতে হয়তো যুদ্ধ সাময়িকভাবে স্তিমিত হবে, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না।
সাম্প্রতিক সময়েই এমন যেকোনোভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার নজির পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। দুই মাস পর রুশ সেনারা স্থানীয় রুশপন্থী বাহিনীর সহযোগিতায় পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে কিছু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেই বছরের আগস্টে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় কিয়েভকে এক অসম শান্তি চুক্তির আলোচনায় বসতে বাধ্য করা হয়। লক্ষ্য ছিল সংঘর্ষ বন্ধ করা।
এ আলোচনার ফলাফল ছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত মিনস্ক-১ চুক্তি। কিন্তু এটি ছয় মাসও টেকেনি। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মস্কোপন্থী বাহিনী ও রাশিয়ার নিয়মিত সেনারা নতুন করে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তী মাসে ফেব্রুয়ারিতে মিনস্ক-২ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে শর্ত দেওয়া হয়, কিয়েভকে কার্যত রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া দনবাস অঞ্চলের দুটি অংশের ‘বিশেষ মর্যাদা’ স্বীকার করতে হবে।
এই যুদ্ধ শুধু হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের লড়াই নয়, এটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার লড়াইও। এখন প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর নীতি এই লক্ষ্যকে সমর্থন করবে, নাকি শুধু নিজেদের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের দিকে ঝুঁকবে? এ প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে এই যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ।শেষ পর্যন্ত মিনস্ক চুক্তিগুলো টেকসই শান্তি আনতে কোনো কাজে লাগেনি। চুক্তি হয়েছিল সংঘর্ষ সাময়িকভাবে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে। ফলে রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ডগুলোর ওপর আরও শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ইউক্রেন রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে যায়।
মিনস্ক চুক্তির ব্যর্থতা আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও জনগণের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে কোনো সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে পারবে না। তা বরং পরবর্তী সংঘাতের পথ প্রশস্ত করবে।
ইউক্রেনের জনগণ তিন বছর ধরে এ যুদ্ধের ভয়াবহতা সহ্য করে আসছে। যেকোনো শান্তি চুক্তিতে অবশ্যই সেই জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করতে হবে।
যুদ্ধের ধকল একটি বাস্তব বিষয়। এই ক্লান্তির প্রতিফলন ঘটে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইউক্রেনের নাগরিকদের মধ্যে পরিচালিত গ্যালাপের এক জরিপে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা শান্তি আলোচনাকে সমর্থন করেছেন। তবে যখন প্রশ্ন আসে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে, তখন মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন, ইউক্রেনের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্রেনীয় কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে শান্তি চুক্তি করার বিষয়টিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই পরিসংখ্যানগুলো একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরে—রাশিয়ার দখলকৃত এলাকা বৈধতা দেবে, এমন কোনো শান্তি চুক্তির পক্ষে ইউক্রেনে ব্যাপক সমর্থন নেই। কোনো ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব যদি এমন চুক্তির পথে হাঁটে, তবে তা জনসাধারণ মেনে নেবে না। এমনকি যদি কূটনৈতিক পর্যায়ে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ও বাস্তবে তা কার্যকর করার চেষ্টা কঠোর অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।
এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা যদি দ্রুত কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন, তবে তাঁরা ইউক্রেনীয় জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। যদি তাঁরা সত্যিই একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চুক্তি চান, তবে তাঁদের উচিত, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান ধরে রাখা কেবল তখনই সম্ভব, যখন সামরিক ময়দানে তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবে আর তাদের মিত্ররা ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত ইউক্রেন নিয়ে তাদের নীতিনির্ধারণে রাশিয়ার বিভ্রান্তিকর প্রচারের ফাঁদে পা না দেওয়া। মস্কো তার দুর্বলতা আড়াল করে কেবল শক্তির ভান দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তুবে রাশিয়া অভ্যন্তরীণভাবে নানা সংকটের মুখে রয়েছে।
রুশ কর্মকর্তারা দাবি করে আসছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। ফলে তাদের সামরিক অভিযান দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রুশ প্রতিনিধিরা নাকি বলেছেন, মস্কোর ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে, রেস্তোরাঁগুলো লোকে লোকারণ্য এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কেবল পশ্চিমা অর্থনীতিই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
রাশিয়ার বার্তাটি স্পষ্ট। তারা যত দিন প্রয়োজন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। আর পশ্চিমারা ধীরে ধীরে এর চাপ সহ্য করতে না পেরে পিছু হটবে। এ ধারণা থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে কিছু নীতিনির্ধারক মনে করছেন, এমনকি ইউক্রেনের পক্ষ থেকে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও দ্রুত একটি শান্তি চুক্তি করাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।
কিন্তু এটি মোটেও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। রাশিয়াকে তুষ্ট করার মানে হবে তাদের আরও আগ্রাসনের সুযোগ দেওয়া। অতীতে দেখা গেছে, আপসের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রাশিয়াকে আরও আগ্রাসী করে তুলেছে।
ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হলে একটি শক্তিশালী যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তা হতে পারে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ, দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি বা ইউরোপীয় নেতৃত্বাধীন একটি সুসংগঠিত নিরাপত্তাব্যবস্থা। কিন্তু চুক্তি যা–ই হোক, সেখানে যদি ইউক্রেনের জন্য স্পষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে নতুন করে সংঘাতের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওয়াশিংটন ইউক্রেনে তাদের ভূমিকাকে পুনর্মূল্যায়ন করবে। অনেক কিছুই অনিশ্চিত। তবে একটি ব্যপার স্পষ্ট, এই যুদ্ধ শুধু হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের লড়াই নয়, এটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার লড়াইও। এখন প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর নীতি এই লক্ষ্যকে সমর্থন করবে, নাকি শুধু নিজেদের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের দিকে ঝুঁকবে? এ প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে এই যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ।
মাক্সিম স্ক্রিপচেঙ্কো প্রেসিডেন্ট, ট্রান্সআটলান্টিক ডায়ালগ সেন্টার
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য় এই য দ ধ পরবর ত র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ডাকসুর ব্যালট পেপারে ২ ভোট নিয়ে যা বলছে নির্বাচন কমিশন
গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে টিএসসি কেন্দ্রে এক ব্যালট পেপারে পূর্বেই দুই ভোট থাকার অভিযোগ তোলেন এক শিক্ষার্থী।
ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পর এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আরো পড়ুন:
প্রথম কার্যনির্বাহী সভায় সিনেটে ৫ ছাত্র প্রতিনিধি ঠিক করল ডাকসু
ডাকসু নির্বাচনে জয়ী ৭ নারী
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ডাকসু নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস থেকে চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মো. জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত ‘টিএসসি কেন্দ্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য' শীর্ষক এক বিবৃতিতে এ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দিন আনুমানিক সকাল ১১টা নাগাদ টিএসসি কেন্দ্র থেকে কেন্দ্র প্রধান আমাকে ফোনে জানান, একজন ছাত্রী (ভোটার) এক নম্বর টেবিল থেকে ব্যালট গ্রহণ করে বুথে প্রবেশ করেন। প্রায় ১ মিনিটের বেশি সময় পর তিনি বুথ থেকে বের হয়ে দাবি করেন, তার একটি ব্যালটে দুটি প্রার্থীর পক্ষে পূর্ব থেকেই ক্রস চিহ্ন দেওয়া ছিল।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ছাত্রীটি ওই ব্যালটে ভোট প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে সেখানে উপস্থিত পোলিং অফিসার এবং ভোট ব্যবস্থাপকদের সহায়তায় তার কাছ থেকে চিহ্নিত ব্যালটটি সংগ্রহ করে আলাদা একটি প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয় এবং তাকে নতুন করে ব্যালটের ১ নম্বর পাতাটি প্রদান করা হয়। পরে তিনি পুনরায় বুথে প্রবেশ করে ভোট দেন এবং চলে যান।
ঘটনার বিষয়ে অবহিত হওয়ার পরপরই আমি চিহ্নিত ব্যালটটি সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেই এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের অনুরোধ জানাই। পরে সেখানে উপস্থিত তিনজন শিক্ষককে আমরা ঘটনাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি এবং তাদের বর্ণনার সঙ্গে কেন্দ্র প্রধানের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। ফলে ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে মীমাংসিত হয় এবং প্রচলিত নিয়ম ও প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
বিবৃতিতে রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানান, পরবর্তীতে আমাদের হাতে ঘটনাটির ভিডিও ফুটেজ আসে। ফুটেজ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ছাত্রী চারবার বুথে প্রবেশ করেন। প্রথমবার আনুমানিক ৪০ সেকেন্ড, দ্বিতীয়বার আনুমানিক ৬৬ সেকেন্ড, তৃতীয়বার আনুমানিক ২ সেকেন্ড এবং চতুর্থবার আনুমানিক ১০ মিনিটেরও বেশি সময় বুথে অবস্থান করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ভোট দিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করেন।
তবে ভোটকেন্দ্রে তার বারবার বুথে প্রবেশ ও বের হওয়া এবং সেখানে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতা আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী