ট্রাম্পের দ্বিতীয় জমানার বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু; কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষণা
Published: 4th, March 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের হাত থেকে মুক্তি পাবে না কানাডা, মেক্সিকো ও চীন—পরিষ্কারভাবে এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আজ ৪ মার্চ থেকেই তিন দেশের ওপর কার্যকর হবে অতিরিক্ত শুল্ক। এ ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা, দরাদরি করার আর কোনো সুযোগ নেই। ফলে মেক্সিকো ও কানাডার ওপর আরোপিত হচ্ছে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক। অন্যদিকে চীনের ওপর আরোপ করা হলো অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক। খবর বিবিসির
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে রীতিমতো ধস নেমেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সূচক ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়ালের পতন হয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ; এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের পতন হয়েছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ আর নাসডাক সূচকের পতন হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তিন বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারের পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হলো। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে এবং দেশটিতে আবারও মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলেই শঙ্কা। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় তার প্রভাব পড়তে পারে।
এবারের নির্বাচনী প্রচারণা থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন, ক্ষমতায় এলে এসব শুল্ক আরোপ করা হবে। এমনকি ক্ষমতায় নেওয়ার প্রথম দিনেই তা করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি সেই পথে হাঁটেননি তিনি। প্রাথমিকভাবে শুল্ক কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে এসেছিলেন। কানাডা ও মেক্সিকোকে তিনি ৩০ দিন সময় দিয়েছিলেন। দুই দেশের তরফে সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি নিয়ে আশ্বাস পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেই কারণেই শুল্ক চাপানোর বিষয়ে তাঁর নরম মনোভাব দেখা যায়।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার ভোল বদল করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অতিরিক্ত সময় না দিয়ে আজ মঙ্গলবার থেকেই কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর আমদানি শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করলে এই দেশগুলোও পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলাইন জলি সাংবাদিকদের গতকাল সোমবার বলেছেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার; ট্রাম্প যদি কানাডার পণ্যে শুল্ক আরোপ করেন, আমরাও প্রস্তুত।’
মেলাইন জলি আরও বলেছেন, কানাডা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। প্রাথমিকভাবে কানাডা ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শুল্ক আরোপ করতে প্রস্তুত—পাস্তা, কাপড়চোপড় ও সুগন্ধিতে এই শুল্ক আরোপ করা হবে।
জলি আরও বলেন, কানাডা শুল্ক যুদ্ধ শুরু করতে চায়নি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ শুরু করায় তাদের উপায়ন্তর নেই।
অন্যদিকে মেক্সিকো ও চীন আগেই বলে রেখেছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করলে তারাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধের ফ্রন্ট আরও বড় হবে।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও ঘোষণা দিয়েছেন, ১২ মার্চ থেকে সব ধরনের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে যেসব দেশ মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করবে, সেসব দেশের পণ্যেও পাল্টা শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকিও তিনি দিয়ে রেখেছেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।