পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে শুরু হয়েছে ট্রাকে করে খোলা বাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম।

সুলভ মূল্যে টিসিবি পণ্য ক্রয় করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কাঙ্খিত পণ্য ক্রয় করতে না পেরে হতাশা প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা।

টিসিবি পণ্যের বিক্রির জন্য নির্ধারিত ১০টি স্থানে ১২টার দিকে পণ্য নিয়ে ট্রাক পৌঁছে। কিন্তু ক্রেতারা তারও দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগে থেকে অপেক্ষা করে। এরপর ট্রাক আসামাত্রই পেছনে লাইন ধরে কয়েক শ’ মানুষ। এরমধ্যে ২০০ জনের মাঝে বিক্রি করা হয় পণ্য। বাকিরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এমনই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে সিটি কর্পোরেশনের সামনে রাস্তায়, জেলা প্রশাসক কাযার্লয়, তাজমহল মোড়ে, গোহাইল ও কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পণ্য বিক্রির ট্রাকে।

জানা যায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন ১০টি ট্রাকের মাধ্যমে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে সারা দেশের ন্যায় ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকায় সুলভ মূল্যে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল এবং খেজুর বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ৫৯০ টাকা প্যাকেজে পাঁচ ধরনের পণ্য বিক্রির এই কার্যক্রম চলবে ২৮ মার্চ পর্যন্ত।

সায়শ্রী মূল্যে দুই লিটার তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ডাল, দুই কেজি ছোলা এবং ৫০০ গ্রাম খেজুর পেয়ে খুশি ভোক্তারা। তবে অনেকে ট্রাকের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য ক্রয় করতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শৃঙ্খলার মধ্যে আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য আসা রেহেনা খাতুন বলেন, “ট্রাকে পণ্য বিক্রির বিষয়টি আগে থেকে কাউকে জানানো না হলেও আমরা আন্দাজ করে সিটি কর্পোরেশনের সামনে সকাল ১০টা থেকে এসে বসে থাকি। কিন্তু ট্রাক যখন আসে তখন মানুষ হুড়োহুড়ি করে ট্রাকের পেছনে ছোটে। আমি শেষে পড়ে যাওয়ায় পণ্য ক্রয় করতে পারিনি। এটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা প্রয়োজন। না হয় যার জোর আছে সেই পণ্য পাবে, আমর মতো অনেকেই বঞ্চিত হবে।”

৫৯০ টাকা প্যাকেজে পাঁচ ধরনের পণ্য বিক্রির এই কার্যক্রম চলবে ২৮ মার্চ পর্যন্ত।

জেলা প্রশাসক কাযার্লয়ের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেননি সাহিনা বেগম। তিনি বলেন, “২০০ জনের মাঝে পণ্য বিক্রি করা হলেও লাইনে দাঁড়ায় ৩০০—৪০০ জন। তাহলে আমরা দুর্বল মানুষ যারা আছি তারা কী করে পণ্য পাব?”
 
মেসার্স আকন্দ এন্টারপ্রাইজের ডিলার শরীফুল ইসলাম বলেন, “পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে আসতে ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা বেজে যায়। এরমধ্যে লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রাক ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এতে পণ্য বিক্রি করতে আমাদের অনেক সমস্য হয়। এলাকার অনেকে আবার প্রভাব খাটাতে চায়। এ নিয়ে আমরা অনেক সমস্যায় আছি। যারা ট্রাকের পেছনে থাকে তাদেরকেই পণ্য দিতে হয়; কিন্তু ২০০ পণ্যের মধ্যে ৩০০ লোক এলে দেওয়া সম্ভব হয় না।”

টিসিবি ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কাযার্লয়ের যুগ্ম-পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “৫৯০ টাকার প্যাকেজে খেজুর, ছোলা, মশুর, ডাল, তেল এবং চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। এতে আমাদের কিছু করারও নেই। মানুষ যেনো পণ্য ক্রয় করতে পারে সে দিকটা আমরা দেখছি। প্রথম প্রথম হওয়ায় লোকজনের চাপ একটু বেশি। আশ রাখছি কয়েক রোজা গেলে চাপ কমে যাবে।”

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র স মন

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ