সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রবল বিতর্ক দেখা গেছে। এই বিতর্কে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকের বক্তব্য বাস্তবতাবিবর্জিত ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তারা যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ– এটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

 

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড.

জাহিদ হোসেনের বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা গাড়ির লোন পান, মাসিক ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মেইনটেন্যান্স ভাতা ভোগ করেন এবং তুলনামূলক ভালো বেতন পান, তাই মহার্ঘ ভাতা প্রয়োজন নেই। তাঁর বক্তব্যের এই অংশ যথার্থ হতে পারে, কিন্তু তিনি পুরো সরকারি চাকরিজীবী শ্রেণিকে এক কাতারে ফেলে দিয়েছেন।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৩০টি সুপারনিউমারারি পদসহ উপসচিবের অনুমোদিত পদ ১ হাজার ৪২৮টি, কর্মরত প্রায় ১ হাজার ৭০২ জন। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার সংখ্যা ৩ হাজারও নয়। অথচ সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫.৫ লাখের ওপরে। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেতন ১৩ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই শ্রেণির জন্য ৪-৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত ভাতা নিছক ‘সুবিধা’ নয়, বরং ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কয়েক হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অপ্রয়োজনীয়তার অজুহাতে কীভাবে ১৫ লাখ মানুষের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়?

 

থমাস পিকেটির বৈষম্য তত্ত্ব অনুসারে, যখন একটি রাষ্ট্রের আয় ও সম্পদের বণ্টন অসম হয়, তখন সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে দেখা যাচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের নীতি উচ্চবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের জন্য নয়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। অথচ রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে ফিনল্যান্ডের মানের শিক্ষা চায়! বাংলাদেশে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১৭ হাজার টাকা বেতন পান, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ৪০ হাজার রুপি পান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ হাজার ৩২৮ টাকা। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা প্রদত্ত মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের জিডিপির সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ এবং আদর্শগতভাবে ৬ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত। সেখানে বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষায় জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়। অন্যদিকে ফিনল্যান্ডে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। 

 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, মহার্ঘ ভাতা সরকারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাইরের খরচ বাড়াবে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এখানে একটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে– যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে এবং সরকার নতুন বেতন কাঠামো দিতে ব্যর্থ হয়, তখন মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয় মূল্যস্ফীতির ভারসাম্য রক্ষার জন্যই।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে মূল্যস্ফীতি ৩০০-৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সরকার ২০১৫ সালের পর নতুন কোনো পে-স্কেল দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, ২০২০ সালে একটি নতুন পে-স্কেল এবং ২০২৫ সালে আরেকটি পে-স্কেল দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দুটি পে-স্কেলের পরিবর্তে একটি মহার্ঘ ভাতা দিয়েই সমস্যার সমাধান করতে চাওয়া হচ্ছিল। আবার সেই মহার্ঘ ভাতা নিয়েও নাটকের অন্ত নেই।

 

এই পরিস্থিতি শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। কার্ল মার্ক্স শ্রেণিভিত্তিক শোষণের যে ধারণা দিয়েছেন, তা এখানেও প্রাসঙ্গিক। কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত– বুর্জোয়া (শাসক শ্রেণি) এবং প্রলেতারিয়েত (শ্রমজীবী শ্রেণি)। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। উচ্চপদস্থ আমলা ও নীতিনির্ধারকরা যখন নিজেদের স্বার্থের কথা বলেন, তখন সাধারণ কর্মচারীদের শোষিত হতে হয়।

 

মহার্ঘ ভাতা বিতর্ক শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি নীতিগত ও নৈতিক প্রশ্ন। উচ্চপদস্থ কয়েক হাজার কর্মকর্তার সুবিধার অজুহাতে লক্ষাধিক সাধারণ চাকরিজীবীর অধিকার কেড়ে নেওয়া কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের জন্য কাজ করতে চায়, তবে বৈষম্য দূর করার জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করা উচিত।

মাহমুদুর রহমান সাঈদী: শিক্ষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mahmud.saadi@cu.ac.bd

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র চ কর জ ব কর মকর ত র চ কর জ ব র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি

ফরিদপুর-৪ আসনের ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়ন ফরিদপুর-২ আসনের নগরকান্দায় যুক্ত করার প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ ও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান মোল্লা বিষয়টিকে জনগণের আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আবেদন জানিয়েছেন।

এদিকে, ভাঙ্গা উপজেলা থেকে কেটে নেওয়া হামিরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোকন মোল্লা এলাকাবাসীর পক্ষে চেয়ারম্যানের পাঁচটি দাবির কথা তুলে ধরে মীমাংসার আহ্বান জানিয়েছেন। 

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুল হাসান মোল্লা ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ২১৪ ফরিদপুর-৪ আসনে অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। 

জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষরিত ওই চিঠি সূত্রে জানাগেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত গেজেটের সূত্র উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ফরিদপুর-২ এবং ফরিদপুর-৪ এর সংসদীয় সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। উক্ত তালিকায় ফরিদপুর-৪ এর অন্তর্গত ভাঙ্গার দুটি ইউনিয়ন, আলগী ও হামিরদী জাতীয় সংসদীয় আসন ফরিদপুর-২ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

তালিকা প্রকাশিত হওয়ার ফলে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নসহ ভাঙ্গা উপজেলার সাধারণ জনগণ উক্ত আসন বিন্যাস বাতিলের দাবিতে মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। 

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভকারীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়, ভাঙ্গা থানা, হাইওয়ে পুলিশের কার্যালয় ও সরকারি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও বিক্ষোভকারীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে। তৎপ্রেক্ষিতে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণকে তীব্র ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবির সমর্থনে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) সংসদীয় আসনের ভাঙ্গা হতে আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর-২ আসনের সাথে যুক্ত করে সংসদীয় আসন পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি দুইটি সংসদীয় আসনের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। উক্ত দুইটি আসনের সর্বস্তরের জনগণ এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছে মর্মে জানা যায়। এ প্রেক্ষিতে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা না হলে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, বর্ণিত অবস্থায়, জাতীয় সংসদীয় আসন ২১২ ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা ও সালথা) এর অন্তর্গত ভাঙ্গা উপজেলার দুটি ইউনিয়ন আলগী ও হামিরদীকে জাতীয় সংসদীয় আসন ২১৪ ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) এর মধ্যে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করা হলো।

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বার্তায় হামিরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোকন মোল্লা পাঁচটি দাবির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি পাঁচটি দাবিকে ভাঙ্গাবাসীর প্রাণের দাবি হিসেবে উল্লেখ করে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ দাবিগুলো মেনে নেওয়া হলে তারা ঘরে ফিরে যাবেন।

দাবিগুলো হলো- আলগী এবং হামিরদী ইউনিয়নকে পুনরায় ভাঙ্গা উপজেলার সাথে সংযুক্ত করতে হবে; চেয়ারম্যানসহ সকলকে মুক্তি দিতে হবে; নিরীহ নিরপরাধ জনগণের ওপর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে; নতুন কোনো মামলা দেওয়া যাবে না; রাতের বেলায় প্রশাসন দিয়ে সাধারণ জনগণকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা/তামিম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
  • পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি
  • অকার্যকর ডেমু ট্রেন কেনায় রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি
  • পুরোনো পথে সরকার, প্রশাসনে পদ ছাড়াই পদোন্নতি
  • এই সরকারও পুরোনো পথে, প্রশাসনে পদ ছাড়াই পদোন্নতি
  • তিন জেলার ডিসি প্রত্যাহার
  • কক্সবাজারের নতুন ডিসি আ. মান্নান