মহার্ঘ ভাতা বিতর্ক: বৈষম্যের শিকড় কোথায়?
Published: 10th, March 2025 GMT
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রবল বিতর্ক দেখা গেছে। এই বিতর্কে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকের বক্তব্য বাস্তবতাবিবর্জিত ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তারা যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ– এটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড.
বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৩০টি সুপারনিউমারারি পদসহ উপসচিবের অনুমোদিত পদ ১ হাজার ৪২৮টি, কর্মরত প্রায় ১ হাজার ৭০২ জন। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার সংখ্যা ৩ হাজারও নয়। অথচ সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫.৫ লাখের ওপরে। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেতন ১৩ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই শ্রেণির জন্য ৪-৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত ভাতা নিছক ‘সুবিধা’ নয়, বরং ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কয়েক হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অপ্রয়োজনীয়তার অজুহাতে কীভাবে ১৫ লাখ মানুষের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়?
থমাস পিকেটির বৈষম্য তত্ত্ব অনুসারে, যখন একটি রাষ্ট্রের আয় ও সম্পদের বণ্টন অসম হয়, তখন সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে দেখা যাচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের নীতি উচ্চবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের জন্য নয়।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। অথচ রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে ফিনল্যান্ডের মানের শিক্ষা চায়! বাংলাদেশে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১৭ হাজার টাকা বেতন পান, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ৪০ হাজার রুপি পান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ হাজার ৩২৮ টাকা। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা প্রদত্ত মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের জিডিপির সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ এবং আদর্শগতভাবে ৬ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত। সেখানে বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষায় জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়। অন্যদিকে ফিনল্যান্ডে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, মহার্ঘ ভাতা সরকারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাইরের খরচ বাড়াবে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এখানে একটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে– যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে এবং সরকার নতুন বেতন কাঠামো দিতে ব্যর্থ হয়, তখন মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয় মূল্যস্ফীতির ভারসাম্য রক্ষার জন্যই।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে মূল্যস্ফীতি ৩০০-৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সরকার ২০১৫ সালের পর নতুন কোনো পে-স্কেল দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, ২০২০ সালে একটি নতুন পে-স্কেল এবং ২০২৫ সালে আরেকটি পে-স্কেল দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দুটি পে-স্কেলের পরিবর্তে একটি মহার্ঘ ভাতা দিয়েই সমস্যার সমাধান করতে চাওয়া হচ্ছিল। আবার সেই মহার্ঘ ভাতা নিয়েও নাটকের অন্ত নেই।
এই পরিস্থিতি শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। কার্ল মার্ক্স শ্রেণিভিত্তিক শোষণের যে ধারণা দিয়েছেন, তা এখানেও প্রাসঙ্গিক। কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত– বুর্জোয়া (শাসক শ্রেণি) এবং প্রলেতারিয়েত (শ্রমজীবী শ্রেণি)। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। উচ্চপদস্থ আমলা ও নীতিনির্ধারকরা যখন নিজেদের স্বার্থের কথা বলেন, তখন সাধারণ কর্মচারীদের শোষিত হতে হয়।
মহার্ঘ ভাতা বিতর্ক শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি নীতিগত ও নৈতিক প্রশ্ন। উচ্চপদস্থ কয়েক হাজার কর্মকর্তার সুবিধার অজুহাতে লক্ষাধিক সাধারণ চাকরিজীবীর অধিকার কেড়ে নেওয়া কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের জন্য কাজ করতে চায়, তবে বৈষম্য দূর করার জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করা উচিত।
মাহমুদুর রহমান সাঈদী: শিক্ষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mahmud.saadi@cu.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র চ কর জ ব কর মকর ত র চ কর জ ব র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায়: ডাকসু
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নিয়োগের সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায় বলে দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।
রবিবার (২ নভেম্বর) ডাকসুর ভিপি মো. আবু সাদিক, জিএস এসএম ফরহাদ ও এজিএস মুহা: মহিউদ্দিন খান স্বাক্ষরিত ‘রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কাৃরের বিরোধিতা এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষুণ্ন রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ডাকসুর প্রতিবাদ' শীর্ষক এক প্রতিবাদলিপিতে এ কথা বলা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ঢাবি শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে ২ কমিটি
ঢাবিতে সপ্তাহব্যাপী শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, জুলাই বিপ্লব ছিল বৈষম্য, অবিচার ও ফ্যাসিবাদী শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে এ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার এক সম্মিলিত বিপ্লব। কেবল সরকার পরিবর্তন নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, স্বাধীন ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন, প্রশাসনিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং একটি বৈষম্যহীন-ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল এই বিপ্লবের মূল ভিত্তি। নতুন প্রজন্ম চেয়েছিল এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে কোন প্রকার বৈষম্য ও রাজনৈতিক একচেটিয়া কর্তৃত্বের জায়গা থাকবে না।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ধারাবাহিকভাবে সংস্কার কার্যকর করার বিরোধিতা করে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। বিশেষত বিএনপি এমন সব মৌলিক সংস্কারের বিরোধিতা করেছে যা সরাসরি ছাত্র–জনতার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িত। পিএসসি, দুদক, ন্যায়পাল ও মহা-হিসাব নিরীক্ষকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নিয়োগ নিশ্চিত করার সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায়।
যে বৈষম্যমূলক চাকরি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই জুলাই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সেই কাঠামো পরিবর্তনের বিরুদ্ধাচরণ করে বিএনপি নতুন প্রজন্মের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করছে। পাশাপাশি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশনের বিরোধিতা, অনুচ্ছেদ–৭০ সংস্কারে আপত্তি, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান আলাদা দুজন ব্যক্তির মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রস্তাবে বিরোধিতা, আইন পেশায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনে তাদের আপত্তি রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে বড় বাঁধার সৃষ্টি করছে। এভাবে বিএনপি মূলত জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রতিবাদলিপিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, এই সংস্কারগুলো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গঠনের নৈতিক দায়িত্ব ছাত্র ও সর্বস্তরের জনগণের। তাই সংস্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণ থেকে নিতে হবে। আর গণভোটই জনগণের ম্যান্ডেট নিশ্চিতের উপযুক্ত মাধ্যম। গণভোটের মাধ্যমেই জনগণ ঠিক করবে দেশের স্বার্থে কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে তারা সমর্থন দিবে।
কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব যদি রাষ্ট্রগঠনমূলক সংস্কারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তবে ছাত্র-জনতা সেই বাধা অতিক্রমে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেবে জানিয়ে প্রতিবাদলিপিতে আরো বলা হয়, জুলাই বিপ্লব শুধু শাসক বা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয় বরং জুলাই বিপ্লব হলো ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপ করে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণ।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী