রমজান পরবর্তী ঈদের অন্যতম ইবাদত হলো ‘ফিতরা’ দেওয়া; মানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা খাদ্য দান করা। পরিভাষায় একে বলে, ‘সদাকাতুল ফিতর’, অর্থাৎ ‘ফিতরের সদকা’। কখনো ‘যাকাতুল ফিতর’ও বলা হয়। ফিতর মানে নাশতা বা সকালের খাবার, বা যা খেয়ে রোজার সমাপ্তি করা হয়। রোজাদার ব্যক্তি দীর্ঘ এক মাস পরে অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতো খাবার খাচ্ছেন, হতে পারে রোজা পালনের সময় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে গেছে, একই সঙ্গে সমাজের দরিদ্র মানুষও যেন ঈদ উৎসবে অংশ নিতে পারেন, ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, এ-কারণেই ‘ফিতরার’ বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি এই ঈদের নামকরণ করা হয়েছে ‘ঈদুল ফিতর’ বা ফিতরের ঈদ নামে। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ এবং ছোট-বড় সবার জন্য নির্বিশেষে মহানবী মুহাম্মদ (সা.
ফিতরা যেভাবে পরিমাপ করা হয়
ফিতরা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে-পাঁচটি খাদ্য-পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলো, আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনির। এসব পণ্যের যে-কোনো একটি দ্বারা ফিতরা প্রদান করা যাবে। ফিতরার পরিমাপ হলো, গম ও চালের ক্ষেত্রে ‘অর্ধ সা’ এবং বাকি চারটি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘এক সা’ নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘সা’ হলো প্রাচীন আরব পরিমাপের একক। কেজি ও গ্রাম হিসেবে ‘এক সা’ সমপরিমাণ ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম এবং ‘অর্ধ সা’ সমপরিমাণ ১ কেজি ৬শ ৫০ গ্রাম।
আরও পড়ুনরমজানে ৬টি অভ্যাস১০ মার্চ ২০২৫ফিতরা কার জন্য বাধ্যতামূলক
প্রতিটি সচ্ছল মুসলিম ব্যক্তি, যার ওপর জাকাত ওয়াজিব, ফিতরা তার ওপর ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক। তবে এটি নিজের জন্য দেওয়ার পাশাপাশি তার ওপর কেউ যদি নির্ভরশীল থাকে তাদের জন্যও দিতে হবে। যেমন, মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান। এমনকি তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যও ফিতরা দেবেন।
ফিতরা কখন দিতে হবে
ফিতরা প্রদান করতে হয় ঈদুল ফিতর নামাজের আগে। পরে দিলেও তা ‘সদকা’ হিসেবে আদায় হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে সওয়াব তুলনামূলক কম বলা হয়।
আরও পড়ুনরোজার নিয়ত কখন করবেন১৯ ঘণ্টা আগেজাকাত ও ফিতরার পার্থক্য
জাকাত ও ফিতরার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। জাকাতের বিধানের সঙ্গে রমজান বা ঈদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফিতরার সঙ্গে রমজান ও ঈদের বিশেষ সম্পর্ক আছে। সম্পদের পরিমাণ যত বেশি থাকে জাকাতের পরিমাণও তত বেশি হয়। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে বিষয়টি সে রকম নয়। ফিতরা নির্ধারিত একটি অঙ্ক, সম্পদের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে ফিতরার পরিমাণ ওঠা-নামা করে না।
ফিতরা কারা পাবে
ইসলামের দৃষ্টিতে যিনি জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত তিনি ফিতরা পাওয়ার ক্ষেত্রেও উপযুক্ত হবেন।
বাংলাদেশে চলতি বছর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৮০৫ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১০ টাকা। এই ফিতরা নির্ধারণ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনির এই পাঁচটি পণ্যের বাজারমূল্য সংগ্রহ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এরপর এসব মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।
১. গম বা আটা ফিতরা দিলে ১ কেজি ৬শ ৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১১০ টাকা দিতে হবে।
২. যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৫৩০ টাকা।
৩. কিশমিশ দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১৯৮০ টাকা।
৪. খেজুর দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২৩১০ টাকা।
৫. পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২৮০৫ টাকা।
সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ আল-শেখ বলেছেন, ফিতরায় খাদ্যপণ্য দেওয়া উচিত। অর্থ আকারে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সৌদি গেজেট পত্রিকায় তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘যাকাত-আল-ফিতর’ খাদ্য হিসেবে দেওয়া নবীজি (সা.) এর সুন্নত।
আরও পড়ুনযাদের জাকাত দেওয়া যাবে০৭ মার্চ ২০২৫রোজা পালন করার সময় মানুষ এমন কিছু ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি করতে পারে যার জন্য তার রোজাকে মাকরুহ করে ফেলে, যেমন কোনো অশ্লীল কথা বলে ফেলেছে। ফিতরার মাধ্যমে রোজা পরিশুদ্ধ হয়। ফিতরার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈদের আগে দরিদ্র মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা বা তাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা। যাতে তারা এই অর্থ দিয়ে ঈদের দিন উদ্যাপন করতে পারে।
আরও পড়ুনজীবনজুড়ে রমজান২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না। মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?
ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো। বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে।
আরো পড়ুন:
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ
রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা
রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে।
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত।
জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।
ঢাকা/লিপি