Prothomalo:
2025-09-18@10:40:53 GMT

আলোর পথযাত্রী 

Published: 12th, March 2025 GMT

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন দিকপাল—তিনজনই আমার শিক্ষক। প্রথম দুজনের একজন হচ্ছেন প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অন্যজন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং তৃতীয়জন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। শ্রেণিকক্ষে অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে কখনো পড়াননি বটে, কিন্তু আমার উন্নয়ন অর্থনীতির পাঠ যেমন তাঁর লেখা ও বলা থেকে, আমার জীবনের বহু শিক্ষাও তাঁর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে পাওয়া। আজ ১২ মার্চ, আমার এই শিক্ষকের জন্মদিন। হৃদয়ের সমস্ত শ্রদ্ধার্ঘ্যটুকু নিয়ে নমিত চিত্তে বলি, ‘শুভ জন্মদিন স্যার।’

রেহমান সোবহানের কথা ও নাম প্রথম শুনি ষাটের দশকের শেষার্ধে। আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাবা তাঁর কথা বলতেন, বলতেন আমার কলেজশিক্ষকেরাও, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁকে দেখেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে জানতেন। তাঁরা সবাই বলতেন অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মেধা ও মনন সম্পর্কে, তাঁর বাগ্মিতা বিষয়ে, তাঁর লেখা ও কথার ধার বিষয়ে। সবকিছু শুনে তিনি আমার কাছে হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, মুগ্ধ করা একজন মানুষ। 

১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পর রেহমান সোবহানকে আমি প্রথম দেখতে পাই। প্রথম দেখাতেই তাঁর তিনটি জিনিস আমাকে আকৃষ্ট করে—তাঁর দৃপ্ত পদচারণ, তাঁর ইংরেজি বলা এবং তাঁর অন্তর্ভেদী চোখের দৃষ্টি। পরবর্তী সময়েও দেখেছি যে তাঁর কথার দার্ঢ্য, তাঁর যুক্তির ধার এবং চোখের তীক্ষ্ণতা মিলে এমন একটি আবহ তৈরি হয় যে তাঁর মুখোমুখি বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। 

ছাত্র হিসেবেই জানলাম যে পাকিস্তানের দুই অর্থনীতি তত্ত্বের তিনি অন্যতম প্রবক্তা, ছয় দফার তিনি এক বিশিষ্ট কারিগর, পাকিস্তানের চতুর্থ পরিকল্পনা প্রণয়নে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তিনি তাঁর সদস্য। আমরা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কোনো ক্লাস পাইনি, কিন্তু তাতে কি! নানা সভা-সমিতিতে তাঁর বক্তব্য শুনে এবং হামিদা হোসেন ও তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকায় তাঁর লেখা পড়ে আমার নানা শিক্ষার শুরু তাঁর কাছ থেকে—অর্থনীতির শিক্ষা, যুক্তির শিক্ষা, বক্তব্যের শিক্ষা। ফোরাম পত্রিকাটি তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরেছিল এবং আমাদের গণ-আন্দোলনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

তারপর শুরু হলো আমাদের স্বাধিকারের আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। এর প্রতিটি পরতে পরতে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাজ ও অবদান সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন। ১৯৭৫ সালে আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হয়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি খুব চাইলেন, আমি সেই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই। কিন্তু অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ধরে রাখলেন। ১৯৭৭ সালে আমি যখন উচ্চশিক্ষার্থে কানাডায় চলে যাই, তত দিনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান অক্সফোর্ডে চলে গেছেন।

রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। রেহমান সোবহান তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে আমি যুক্ত হই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নানা কর্মকাণ্ডেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, সভা-সমিতিতে উভয়েই বক্তব্য রাখি। আশির দশকের শেষের দিকে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নাগরিক কমিটি’ গঠিত হলে আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলাম রেহমান সোবহান, প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও প্রয়াত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে। তখন বাংলাদেশ অর্থনীতির স্থবিরতার ওপরে রেহমান সোবহান দ্য ডিকেড অব স্ট্যাগনেশন শিরোনামে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন। বইটির প্রথম প্রবন্ধটিই ছিল আমার লেখা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর। 

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রায়ই নানা জায়গায় আলোচনায় বসতাম। একবার অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের ফুলার রোডের বাড়িতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গেল—রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী হবে? বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু ‘রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক’ আর ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষকের’ ভূমিকাই নেবে? বিতর্কের একপর্যায়ে রেহমান সোবহান আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা এখনো আমার মনে আছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস বলেছিলেন, ‘ষাটের দশকে আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলাম। আশির দশকে তোমরা কেন অমনটা যুক্ত নও?’ মনে আছে, নানাজনের ওপরে দোষ চাপিয়ে আমি একধরনের টালবাহানা উত্তর দিয়েছিলাম। তিনি আমার সব কথা শুনলেন। তারপর শুধু বললেন, ‘শোনো, দেশের পরিবর্তন যদি করতে চাও, তাহলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বাইরে থেকে শুধু বুদ্ধিজীবীর মতামত দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ এমন অমোঘ বাণী বড় একটা শুনিনি। 

১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা হলেন রেহমান সোবহান। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির নানা দিকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, তার বিশ্লেষণ এবং আগামী পথযাত্রার রূপরেখা দেওয়ার জন্য তিনি দেশের প্রায় আড়াই শ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ নিয়ে ২৯টি কর্মদল গঠন করেন। তাঁর ডাকে তাঁরা সবাই কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এই বিশাল কাজ করে দিতে সম্মত হন। আমি নিজে সামষ্টিক অর্থনীতি এবং যমুনা সেতু কর্মদলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। প্রথম কর্মদলটির দলনেতা ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, দ্বিতীয়টির জামিলুর রেজা চৌধুরী। 

 রেহমান সোবহানের স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের নানা বিষয় ও নানা খাতের ওপর এমন একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হলে পরবর্তী সময়ে যে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাঁরা এসব কর্মদলের প্রতিবেদন থেকে একটি দিকনির্দেশনা পাবেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো যে তারপরের কোনো নির্বাচিত সরকারই সেসব প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন বিষয়ে কিছুই করলেন না। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে এমন একটি সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক কর্মযজ্ঞের পথিকৃৎ ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এই বিশাল অবদানের জন্য আমরা সর্বদা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমি জাতিসংঘে যোগ দিলে রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার কর্মযোগাযোগ বেড়ে যায়। তখন নানা সময়ে নানা বিষয়ে আমরা যৌথভাবে কাজ করেছি নানা কর্মসূচিতে। মনে আছে, একবার দিল্লিতে এমন এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, মন্টেক সিং আহলুওয়ালা, মুচকুন্দ দুবের মতো দিকপালেরা।

দেশজ রাজনীতির নানা বিষয়ে গল্পে মাততেন রেহমান সোবহান। আমি প্রবাসে থাকি বলে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা তিনি জানতে চাইতেন। রাজনীতির নানা বিষয়ে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী তিনি জানাতেন আমাকে। ভাবতে অবাক লাগে, বহুক্ষেত্রে তাঁর কথাগুলো ঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আমার দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন রেহমান সোবহান। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দার্ঢ্যের সঙ্গে বলেছেন অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সমাজচিন্তক হিসেবে আমাদের কী করণীয়, কোথায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি এবং কেন। রাখঢাক রাখেননি, যা শুনতে চেয়েছি তা বলেননি, যা আমাদের শোনা দরকার, তা-ই বলেছেন। ইদানীং নানা আলোচনা সভায় তাঁর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন এক সন্ত—নির্মম সততার সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ করছেন অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোর; আমাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন আমাদের ভবিষ্যৎ পথযাত্রার।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাই এক আলোর দিশারি, যিনি আলো দেখান, পথ দেখান। তাঁকে আমাদের বড় প্রয়োজন। তাই বলি, ‘স্যার, আপনি সুস্থ থাকুন, শতায়ু হোন এবং আমাদের মাঝেই থাকুন। জন্মদিনের নিরন্তর শুভেচ্ছা।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রথম দ এমন এক ন আম ক আম দ র ক জ কর র ওপর সরক র র দশক

এছাড়াও পড়ুন:

আক্কেলপুরের পেট্রলপাম্প থেকে চুরি যাওয়া ট্রাক পাওয়া গেল জয়পুরহাট শহরে

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌর শহরের একটি পেট্রলপাম্প থেকে চুরি হওয়ার এক দিন পর পরিত্যক্ত অবস্থায় ট্রাকটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জয়পুরহাট শহরের বাস টার্মিনাল–সংলগ্ন একটি পেট্রলপাম্পের সামনের সড়ক থেকে এটি উদ্ধার করা হয়।

আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার গভীর রাতে আক্কেলপুরে পৌর শহরের চার মাথা মোড়ের একটি পেট্রলপাম্প থেকে ট্রাকটি চুরি হয়। পরে গতকাল বুধবার বিষয়টি টের পান মালিক।

পুলিশ ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা গেছে, আক্কেলপুরের ওই পেট্রলপাম্পে দীর্ঘদিন ধরে ট্রাক ও বাস রাখেন চালকেরা। গত মঙ্গলবার রাতে মেসার্স রেখা পরিবহন নামের একটি ট্রাক সেখানে রাখেন চালক হাসান আলী। গতকাল সকালে তিনি দেখেন, ট্রাকটি আর সেখানে নেই। পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে ট্রাকটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি।
এ ঘটনায় ট্রাকটির মালিক মশিউর রহমান বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেন। আজ সকালে জয়পুরহাট শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায় উদয় পেট্রলপাম্পের সামনের সড়কে পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই ট্রাক দেখতে পাওয়া যায়। মালিক সেখানে গিয়ে ট্রাকটি শনাক্ত করলে আক্কেলপুর থানা-পুলিশ সেটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়।

মশিউর রহমান বলেন, ‘কে বা কারা আমার চুরি হওয়া ট্রাকটি জয়পুরহাট শহরের উদয় পেট্রলপাম্পের সামনে ফেলে রেখে চলে গেছে। পুলিশ গিয়ে ট্রাকটি নিয়ে গেছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ