বিকেল ফুরোচ্ছে। ঢলঢল করছে পশ্চিমের সোনা রোদ। মধুর মতন তরল রোদ্দুর গায়ে মেখে মখমলের মতন মোলায়েম হয়ে আছে ঘাস, লতা-পাতা, পুকুরের জলে ভাসা কচুরিপানা। কুরোসাওয়ার সিনেমায় ভ্যানগগের ছবির ভেতর দিয়ে যেমন এক যুবক হাঁটে, তেমনি তুমি হাঁটছ, পায়ে চলা সরু মেঠো পথে।
তোমার মন পড়ে আছে পেছনে। পেছনে ক’জন তোমার দিকে চেয়ে। তাদের চোখ ভরা মায়া, হৃদিভরা আকুলিবিকুলি। বাড়ি পেরিয়ে, সীমানা ছাড়িয়ে তারা এসেছে তোমার বিদায়ী পথের দিকে চেয়ে থাকবে বলে। আঁতুড়ঘর থেকে চেনা স্বজনদের ঘ্রাণ পেছনে ফেলে পা-সরে-না পদক্ষেপে ‘বেড়াতে যাওয়া’ তুমি এগোচ্ছ। তবু, হঠাৎ তুমি পিছু ফিরে চাও।
পথের এক মাথায় তুমি। আরেক মাথায় তোমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রিয়জনদের মধ্যিখানে শ’দুয়েক কদমের দূরত্ব। পথের এই দূরত্বটুকুর দু’পাশে ঘন হয়ে ফুটে আছে ভাঁটফুল। পথের এ’মাথা থেকে ও’মাথায় তাকাতে গিয়ে তোমার চোখে আগে পড়ে কনে-দেখা-আলোয় রাঙা ভাঁটের বহর। সিনেমায় রূপান্তর করলে এই দৃশ্যটা হবে তারকোভস্কি স্টাইলে, ধীর লয়ের শট। বিদায়ীর টলোমলো চোখ থেকে ভাঁটফুলের ওপর দিয়ে ধীরে প্যান করে ক্যামেরাটা স্থির হবে মায়াময়ীর মুখের ওপর।
মায়ামুখের সুখচ্ছবির দিকে চেয়ে আচমকা তোমার কান্না উথলে উঠবে। কী অদ্ভুত! এমন তো কখনও হয়নি আগে! নিজের কাছেই বড় নাজুক আর অচেনা লাগবে তোমাকে। কান্না লুকোতে তুমি, তড়িঘড়ি আরও একবার বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নাড়াতে-নাড়াতে, চকিতে ঘুড়িয়ে নেবে ঘাড়। আর তক্ষুনি অলক্ষুনে বার্তার মতন হঠাৎ রাস্তায়, মন তোমার বলে উঠবে, না-জানি কবে এই সুখচ্ছবি শেষ হয়ে যায়!
এই দৃশ্যটা– পথের পাশে কনে দেখা আলো গায়ে মাখা ভাঁটফুলের সারির শেষে মায়ামুখ, তোমাকে তাড়া করে ফিরবে, তোমাকে বোবা করে রাখবে। কেননা, এই বিদায় শেষ বিদায়। এমন দৃশ্য আর কোনোদিন ঘটবে না। তোমার যাওয়ার দিকে দরদ ভরে তাকিয়ে থাকার মানুষদের সাথে সেই হবে তোমার শেষ দেখা।
বিদেশ বিভুঁইয়ে হঠাৎ রাস্তায় অথবা লালবালুর অপরূপ সাগরসৈকতে ফুরোনো বিকেলের সোনা রোদ আচম্বিতে হয়ে উঠবে জাদুর সম্মোহন। রোদের আভায় তোমার মধ্যে অতর্কিতে ছায়াছবির মতন ঝিলিক দিয়ে উঠবে সারি সারি ভাঁটফুলগ্রস্ত বহু পুরোনো এক ফুরোনো বিকেল। ফুলে ভরা সেই পথের শেষে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ামুখ নিয়েছে বিদায়। তবুও জয়পুর কি পুষ্কর কি দুর্গশহর গলের রাস্তায় হঠাৎ স্মৃতিভ্রম ঘটাবে ফুরোতে থাকা বিকেলের রোদ! সহসা মনে হবে, কিচ্ছু আমার হারায়নি তো! আছে!
২.
সমস্ত না থাকা জুড়ে মানুষ আসলে ‘থাকা’ জমায়। থাকা মানে, থাকার স্মৃতি। মুঠো গলে বেরিয়ে যাওয়া জলের মতন বেরিয়ে যেতে থাকে জীবন। তাই কি মানুষের ‘জমানো’র এত তাড়া?
‘হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে, হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে’ যদি বলে, ‘বন্ধু, কী খবর বল’ তবে, কেন আমাদের এমন লাগে? কবীর সুমনের গানের মীড়ে যে আছে, সে কি আপনি নন?
যখন অঞ্জন দত্ত বলেন, ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে/ থাকবে না সাথে কোন ছাতা/ শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়/ ভিজে যাবে চটি জামা মাথা/ থাকবে না রাস্তায় গাড়িঘোড়া/ দোকানপাট সব বন্ধ/ শুধু তোমার আমার হৃদয়/ ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ’– তখন আপনার কেন এমন লাগে? গানটা আদতে কে গায়, অঞ্জন? নাকি আপনি ও আমি?
কেন আমরা ‘দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি’ দেখতে চাই আরেকবার? কেন আমাদের হৃদয় ফালা ফালা হয়ে যায়, যখন চেনাজনকে দেখি ‘অচেনার গাম্ভীর্যে’? সে যখন ‘কালো রঙের একটা গভীর দূরত্ব’ ঘনিয়ে নেয় নিজের চারিদিকে তখন কেন আমাদের পৃথিবী খানখান হয়ে যায়?
রবিঠাকুর কেন লেখেন, ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা/ ভাবিনি সম্ভব হবে কোনোদিন’। অসম্ভবকে সম্ভব করার এই বাসনাটা কেন আমাদের মনে ঘুরে ঘুরে আসে? কেননা আমরা চাই, আমাদের গহিনে যে আছে, তার সাথে আরেকটিবার দেখা হয়ে যাক– ঠিক এইভাবে, অতর্কিতে, আয়োজনহীন। আমরা অপ্রস্তুত হবো। তবু, আমাদের পালানোর পথ থাকবে না কোনো। কেননা, আমরা আসলে চাই না আমাদের আর পালানোর পথ থাকুক। কেননা, আমরা চাই, এমন একটা অলঙ্ঘনীয় কিছু ঘটুক যেন আমরা আর পালাতে না পারি।
তাই, কবিতায় বা গানে বা কল্পনায় এমনিভাবে দৃশ্যপট সাজায় আমাদের গহিন মন যেখানে আমরা হয় বৃষ্টিবন্দি, নয় কামরাবন্দি হয়ে থাকি। কেননা, এই হৃদয়ের রীতি এমনই যে, যার থেকে পালাতে চাই, আমাদের কল্পনার সকল পথ কেবল তারই দিকে যায়।
তাই পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে সব কথা বলে-কয়ে শেষ করে আমরাও নিঃশেষে বিভাজিত হওয়া গণিতের মতন হতে চাই।
৩.
২১-২২ বছর আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ি। তখনও মোবাইল ফোন হাতে হাতে চালু হয়নি। আমারও ফোন নেই। শামসুন নাহার হলে গণরুমে থাকি। রুমের ১৮ জন বাসিন্দার মধ্যে এক বা দুইজনের ফোন আছে। একদিন দুপুর বারোটা-একটার দিকে ক্লাস শেষে হলের দিকে ফিরছি। হেঁটে হল প্রভোস্টের বাসার গেট পার হচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার থেকে কিছুটা সামনে ধূসর চুলের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ ধীর পদক্ষেপে হাঁটছেন। পরনে সফেদ পাঞ্জাবি, সাদা সুন্দর লুঙ্গি, কাঁধের ওপর আরামসে রাখা আছে স্কার্ফের মতন একখণ্ড কাপড়।
লোকটিকে পেছন থেকে দেখে আমি ভাবছি, নিশ্চয়ই কারও দাদা বা নানা হবে। হয়তো নাতনিকে দেখতে এসেছেন। এইসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। রাস্তায় আর কেউ নেই। আমার আগেই এসে বয়স্ক ভদ্রলোক গেটের মুখে দাঁড়িয়েছেন। আমিও ততক্ষণে গেটের কাছাকাছি। গেটের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখি, আরে! গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আমার নানা! সেই সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটাই আমার নানা!
‘নানা আপনি’ বলে আমি লাফ দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম! কস্মিনকালেও ভাবিনি, নানা এভাবে আসবেন! নানা বলেন, ঢাকায় আসছিলাম কাজে। ভাবলাম, তোমারে একটু দেখে যাই! পান খাওয়া সুখী শ্যামলা বরণ নানার মুখ হাসিতে উচ্ছল হয়ে ওঠে।
এত বড় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এত বড় হল, আমি কোন রুমে থাকি, কীভাবে হলে কল দিতে হয়, কোথায় আমার ডিপার্টমেন্টের ক্লাস হয়, নানা কিচ্ছু জানেন না! শুধু জানেন, আমি এই হলে থাকি! এই ভরসায় খুঁজতে এসেছেন, আর ঘটনাচক্রে এসে আমার সাথেই দেখা!
আমি ছিলাম তাঁর প্রথম নাতনি। আমার ছেলেবেলায়, আশির দশকে, গ্রামে-মফস্বলে অত রিকশা ছিল না। গ্রামে প্রচুর পথ হাঁটতে হতো। গ্রামের পথে তো সাইকেলই ছিল প্রধান বাহন। মাল টানার জন্য গরুর গাড়ি। আর কিছু রিকশা। গ্রামের লোকেরা কৃষিকাজ করেই কূল পায় না, রিকশা চালাবে কেন!
সেই টলোমলো শৈশবে আমাদের বাসায় আমাকে দেখতে এসে নানা আমাকে রেখে যেতে পারতেন না। এমনও হতো দুপুরে নানার সাথে নানুবাড়িতে গেছি। কিন্তু রাতে আবার কান্না জুড়েছি। তখন রাতেই নানা আমাকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। সাত-আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে।
সেইসব দিনে রিকশা এবং বাসে ওঠার আগ পর্যন্ত হাঁটা পথটুকু নানা আমাকে সব সময় কাঁধে করে বইতেন। নানার চুল ছিল কদমফুলের মতন, ছোট ছোট। উনি চুলে নারিকেল তেল দিতেন না, সরিষার তেল দিতেন। কাঁধে উঠে আমার থুতনিটা আমি ঠেকিয়ে রাখতাম নানার মাথায়। নানুর বাড়ি আর আমাদের বাসায় এত ঘন ঘন আমাকে আনা-নেওয়া করতে হতো যে, নানার মাথার চুলের ঘষায় আমার থুতনির নিচে চামড়া উঠে গিয়েছিল। এইসব কাহিনি আমার মা-খালারা এখনও বলেন।
সেই নানা তার বড় নাতনিকে দেখতে এসেছেন! হঠাৎ রাস্তায় তার সাথেই দেখা হয়ে গেছে!
হঠাৎ রাস্তায় ঘটা একই হলে, একই গেটের মুখে ঘটা আরেকটা কাহিনি বলি। সেটিও ভালোবাসারই বটে।
প্রথম বর্ষের ঘটনা। একদিন দুপুরে ক্লাস শেষে হলে ফিরছি। গেট দিয়ে ঢুকতে যাব। হঠাৎ শুনি, আমার নাম ধরে কে ডাকে, ‘সোমা’! তাকিয়ে দেখি, এক ত্রস্ত যুবক। শত মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছেন ভিন্ন শহর থেকে। তাকে দেখেই, রাগ-বিরক্তি সব একসাথে মাথা চাড়া দিয়েছে। কাছে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, ভয়ে ওর হাত কাঁপছে। কথা বলার সময় কাঁপছে গলার স্বরও।
রাগ-বিরক্তির সাথে মায়াও হলো। নুসরাত ফতেহ আলী খান গেয়েছেন, ‘দিওয়ানা মেরে দিল হ্যায়, দিওয়ানে কো কেয়া ক্যাহিয়ে’! আমাকে ওর বলার কিছু নেই। আমি জানি, ও কেন এসেছে। সে-ও জানে যে, আমি জানি সে কেন এসেছে। অতএব, উপেক্ষা না করে, অপমান করে তাড়িয়ে না দিয়ে তাকে নিয়ে আরেকবার শমিতভাবে আলাপে বুঝ দেওয়াই সমীচীন মনে হলো।
দুই সহপাঠী, দুই বন্ধু। একজন যদি নিজের হৃদয়ের কাছে হয়ে পড়ে প্রতিরোধহীন তাকে দোষ দেওয়ার উপায় কী? ফতেহ আলী খানের ভাষায় যদি এক পক্ষের মনে হয়, ‘উঠাতে হ্যায় নাজার তো গিরতি হ্যায় বিজলি’ তো অন্য পক্ষের ঠেকাবার উপায় কী! তবে একজনের হৃদয় যখন আরেকজনের জন্য ‘জ্বালাতন’, তখন তো দাঁড়ি টানতে জানতে হয়।
কিন্তু তা কি আর সব সময় হয়? সব ঘটনা তো আর হল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রস্ত হরিণের ঘটনা দিয়ে শেষ হয় না। হঠাৎ রাস্তায় এমন গল্পের সূচনা হয়, যা স্বপ্নের ভেতরে সাপ হয়ে আসে। একই স্বপ্ন, একই সাপ, পুনরাবৃত্তি হতে থাকে বছরের পর বছর।
হঠাৎ একদিন পথের পাশে দুই যুবক দাঁড়িয়ে থাকবে। একজন এসে জিজ্ঞেস করবে, ‘হাই! হাউ আর ইউ?’ অপ্রস্তুত নবম শ্রেণির মুখ ও মগজ তখন বরফপানি খেলার মতন বরফ হয়ে বোবা হয়ে যাবে। মাথা নিচু করে সে তখন হাঁটায় গতি তুলবে। দুই সহগও হাঁটতে থাকবে পাশে। আলাপের অবতারণাকারীই কথা চালাতে থাকবে। সে আদতে ডাকহরকরা। পাশের জনের হৃদয়ের বার্তাবাহী। বেচাইন হৃদয় যার, সে নিজেই ক্রমে নিজের কথা বলতে শিখবে। হাত কেটে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে লোক দিয়ে চিঠি বাড়িতে পাঠাবে। কাটা হাতে ব্যান্ডেজ করে সে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন পথরোধ করবে। নিবেদন গৃহীত না হলে হবে আগ্রাসী।
সেই সব নিবেদন, সেই সব আগ্রাসনের ভীতি মনের তলানিতে জমা হয়ে ঘুমের ভেতর দেখা দেবে সাপ হয়ে। অজগরসম একটা বিরাটাকার হলুদরঙা সাপ, পিঠে যার ছোপছোপ কালচে দাগ, সে কেবল আমার দিকে আসতে থাকবে। একই স্বপ্ন। বারবার। বারংবার। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
হঠাৎ রাস্তায় আরও কত গল্প ঘটে! ‘বিফোর সানরাইজ’ সিনেমা তো হঠাৎ রাস্তারই স্বপ্নকাব্য! গল ফোর্ট থেকে ফেরার পথে দেখা হওয়া লঙ্কান যুবক নন্দসেনা, শাহজালালের মাজারে দেখা হওয়া মার্কিন জেফ, দিল্লির জামে মসজিদের সামনের রিকশাচালক দিলশাদ, ঢাকার আর্ট গ্যালারিতে দেখা হওয়া থতমত মুখ– এদের সাথেও তো হঠাৎই দেখা, পথে।
জীবন এক আশ্চর্য জাদুর কাঠি। দূর গ্রামে বেড়াতে গিয়ে মেঠো পথে ভরদুপুরে বাঁশঝাড়ের নিচে যখন হাওয়া বইছে শনশন, হঠাৎ কবিতার চিত্রকল্প সত্য হয়ে যায়, জীবন এসে কপালে চুমু খেয়ে যায়। হঠাৎ ভোরবেলায় রাস্তায় তিন বন্ধু মিলে খেলাচ্ছলে কপালে দিতে গিয়ে সিঁদুরের টিপ, আত্মায় লেগে যায় রঙের ছাপ।
৪
হঠাৎ রাস্তায় যা কিছু ঘটে, তার সব আসলে হঠাৎ নয়। ল অফ অ্যাট্রাকশনের দর্শন বলে, মনের গহিনে চেতনে-অবচেতনে তুমি যা ভাবো, যা খোঁজো, যা গোপন রাখো, তাই আসলে কোনো না কোনোভাবে তোমার দৃষ্টি কাড়ে। রুমিও সেই কথাই বলেছেন, তুমি যা খুঁজো, তা তোমাকে খোঁজে।
কাছাকাছি দর্শনেরই আরেকটা আলাপ দিয়েছেন কার্ল ইয়ং। সিংক্রোনিসিটি দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, আপাত অর্থে হঠাৎ অনেক ঘটনা ঘটে, যেগুলো পরস্পর সম্পর্কহীন বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতার্থে এদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিরাজমান। সেই সম্পর্ক বুঝতে হলে, ইউ হ্যাভ টু পে অ্যাটেনশন। ‘হঠাৎ’ সামনে আসা মানেই হঠাৎ ঘটা নয়। ফুল যেভাবে ফোটে, সেভাবেই সংসারে, মানবীয় সম্পর্কের ভেতরে অনেক কিছু ঘটে। এনার্জি, ফ্রিকোয়েন্সি আর ভাইব্রেশনে গড়া এ ব্রহ্মাণ্ডে আমরা দেখতে জানি না বলে, কত কিছুই ‘হঠাৎ’ বলে চোখ এড়িয়ে যায়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ন আম দ র পথ র প শ ল র মতন এস ছ ন একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্
ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।
সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ
চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।
জিইও কী?
জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!
এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল
অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।
* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া
* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর
* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি
* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ
এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব
বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে।
গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)
তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।
মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।
জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।
১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন
জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’
যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।
২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন
জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।
গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন- ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।
বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।
E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।
এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন
এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন
এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন
ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।
এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।
দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।
বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা
জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।
আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে-
‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’
অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’
যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।
এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।
জিইও’র ভবিষ্যৎ
খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।
তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।
উপসংহার
জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।
এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।
‘ভবিষ্যতের সার্চে র্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’
লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)
ঢাকা/ফিরোজ