একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির, সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন
Published: 17th, March 2025 GMT
আঙিনার এক পাশে মসজিদ, অন্য পাশে মন্দির। দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথ একটি। অভিন্ন আঙিনার এক পাশে মসজিদের অজুখানা, অন্য পাশে মন্দিরের শানবাঁধানো নলকূপ। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মুসল্লিরা। মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা চলে প্রাত্যহিক পূজা-অর্চনা। একই স্থানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের ধর্মীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেন। এ নিয়ে কখনো কারও কোনো সমস্যা হয়নি।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এ নিদর্শনের অবস্থান লালমনিরহাটে। শহরের পুরান বাজার জামে মসজিদ এবং পুরান বাজার কালীবাড়ি কালী ও দুর্গামন্দির একই আঙিনায় থাকা মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে নিজেদের ধর্মীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেন। মসজিদ ও মন্দিরের অভিন্ন আঙিনায় একদিকে যেমন মুসলিমদের জানাজা হয়, তেমনি লীলাকীর্তনসহ হিন্দুদের নানা অনুষ্ঠান চলে।
স্থানীয় বাসিন্দা, মসজিদ ও মন্দির–সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের পুরান বাজারে ১৮৩৬ সালে প্রথম কালীমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১৫ সালের দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নামাজ পড়ার জন্য মন্দিরের পাশে ২ থেকে ৩ ফুট দূরে একই আঙিনায় একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ তৈরি করেন। পরে সেটি জুমা মসজিদে রূপান্তরিত হয়, যেটি পুরান বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিত। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কালীমন্দিরের পাশে দুর্গামন্দির স্থাপিত হয়।
পুরান বাজার কালীবাড়ি কালীমন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী বলেন, তিনি ১০ বছর ধরে মন্দিরের দায়িত্বে আছেন। কখনো কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ দেখেননি। তাঁর সঙ্গে পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের সুসম্পর্ক আছে। তিনি বলেন, সাধারণত মসজিদের আজানসহ নামাজের সময় মন্দিরের উলুধ্বনি ও বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখা হয়। অন্য সময়ে স্বাভাবিক নিয়মে প্রথাসিদ্ধভাবে মন্দিরের সব ধর্মীয় কাজকর্ম করেন। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।
মসজিদ-মন্দিরের আঙিনায় কথা হয় স্থানীয় মুসল্লি জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করি। কোনো সমস্যা হয়নি। বোঝাপড়া ঠিক থাকলে কোনো সমস্যা হতে পারে না।’ লালমনিরহাটের আদিতমারীর মহিষখোচা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি বেশ কয়েক দিন আগে পুরান বাজার মসজিদ ও মন্দিরের আঙিনায় একজনের জানাজা পড়েছি।’
পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম আলাউদ্দিন আলাল বলেন, পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দিরে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়মিত তাঁদের নিজ নিজ ধর্মকর্ম করছেন। এখানে কখনো কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
মসজিদ কমিটির সহসভাপতি আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মসজিদ ও মন্দিরের কমিটির লোকজন যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে দুই পক্ষ বসে সিদ্ধান্ত নিই। আগের কমিটির লোকজনও তা–ই করেছেন। এটাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম কারণ। ভবিষ্যতেও এটা বজায় থাকবে ইনশা আল্লাহ।’
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৫ আগস্টের পর লালমনিরহাটে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর পাশাপাশি থাকা ওই মসজিদ ও মন্দিরের কথা জানতে পারেন। শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় তিনি সেখানে গিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে সম্প্রীতির বিষয়টি বুঝতে পারেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।