জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস পরিবর্তন করার একটি সুপারিশ করেছে। ছয়টি আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভুক্তসহ পরীক্ষার নম্বর পুনর্বণ্টন করে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয় সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ।

বহুদিন ধরেই বিসিএস প্রার্থীদের অভিযোগ যে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি সুবিধা পান। যে বিষয়টি নিয়ে তাঁদের আক্ষেপ, সেটি হলো গণিত। প্রার্থীরা বলছেন, গণিত বাদ দিলে ফ্যাকাল্টিভিত্তিক বৈষম্য দূর হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা কমিশনের প্রস্তাব করা বিসিএসের সিলেবাস নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে প্রার্থীর মেধা যাচাইয়ে ঘাটতি থাকবে। এই ক্ষোভ আমলে নিয়ে বিসিএস লিখিত অংশ থেকে গণিত বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই যুক্তিতে বিসিএসের সিলেবাস থেকে বাদ পড়েছে মানসিক দক্ষতাও।

এ পরিস্থিতিতে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের লিখিত পরীক্ষার বিষয় নির্ধারণ অধিকতর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করতে হলে একজন প্রার্থীকে ন্যূনতম চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমান ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। তবে যদি কোনো প্রার্থী এইচএসসি পাস করার পর তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি বা সমমানের কোর্স করে থাকেন, তবে তাঁকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার্স) পাস করতে হয়। এরপরই তিনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য হবেন।

মূল কথা হলো একজন প্রার্থী উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার পর সামগ্রিক জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। তাই বিসিএসের সিলেবাসকে মাধ্যমিক কারিকুলামের ভিত্তিতে বিবেচনা না করে স্নাতকভিত্তিক বিবেচনাই বেশি যুক্তিসংগত বলে দাবি রাখে। বিসিএসের সিলেবাস অনুসারে অর্জিত জ্ঞানকে মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত করে তিনটি ভাগে বিভাজন করা যায়।

বর্তমান সিলেবাস (৬টি বিষয়) ও মানবণ্টন (মোট ৯০০ নম্বর) অনুসারে মানবিক অনুষদ (বাংলা-২০০, ইংরেজি-২০০, বাংলাদেশ বিষয়াবলি-২০০, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি-১০০) ৭৭.

৭৮ শতাংশ এবং বিজ্ঞান অনুষদ (গাণিতিক যুক্তি-৫০, মানসিক দক্ষতা-৫০, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-১০০) ২২.২২ শতাংশ সিলেবাস-সুবিধা পেয়ে থাকেন।

সুপারিশ করা সিলেবাস (৬টি বিষয়) ও মানবণ্টন (মোট ৬০০ নম্বর) অনুসারে মানবিক অনুষদ (বাংলা রচনা-১০০, ইংরেজি রচনা-১০০, ইংরেজি কম্পোজিশনে ও প্রিসিস-১০০, বাংলাদেশ বিষয়াবলি-১০০, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি-১০০) ৮৩.৩৩ শতাংশ এবং বিজ্ঞান অনুষদ (সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও পরিবেশ ও ভূগোল-১০০) ১৬.৬৭ শতাংশ সিলেবাস-সুবিধা পেয়ে থাকেন।

গণিতভীতির কারণে আজ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবাই গণিত থেকে দূরে সরার চেষ্টা করছেন বা গণিতকে বাদ দিয়ে পথচলার নীতি অনুসরণ করছেন। এর জ্বলন্ত উদাহরণ বিসিএস থেকে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়টিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কর্তৃক বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা। এ ধরনের গণিতভীতির জন্য গণিত শিক্ষকেরা দায়ী নন এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করে আনন্দের সঙ্গে গণিতচর্চা ও শিক্ষা উপহার দেওয়ার সক্ষমতা একমাত্র গণিতবিদেরাই রাখেন বলে আমার বিশ্বাস।

বর্তমান ব্যবস্থায় মানবিকের একজন প্রার্থী বিজ্ঞানের প্রার্থী অপেক্ষা ৫৫.৫৬ শতাংশ বেশি সিলেবাস-সুবিধা পেয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় মানবিকের পক্ষে এ সুবিধা ৬৬.৬৬ শতাংশ বেশি। তাহলে স্পষ্ট যে বিজ্ঞানের প্রার্থীরা বর্তমান সিলেবাস ও মানবণ্টনের আলোকেই বড় ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অধিকন্তু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে বিজ্ঞানের প্রার্থীরা আরও বৈষম্যের শিকার হবেন তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

বিজ্ঞানের প্রার্থীদের উচ্চতর গণিত বিষয়ে জ্ঞান থাকায় গাণিতিক যুক্তিতে বেশি নম্বর পেয়ে বিসিএস পরীক্ষায় মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকেন বলে যে অজুহাত দেওয়া হচ্ছে, এর সঙ্গে একমত হওয়া যায় না।

বিসিএস পরীক্ষার গাণিতিক যুক্তির সিলেবাসের প্রতিটি কনটেন্ট মাধ্যমিকের গণিত (নবম-দশম শ্রেণি) অংশে বিদ্যমান রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের গণিত বিষয়টি মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসা শাখার সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক বিধায় গাণিতিক যুক্তি বিসিএসে বর্তমানের মতো বহাল থাকলেও কেউ বেশি সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নকারী যেন উচ্চতর গণিত থেকে কোনো প্রশ্ন না রাখেন, সে বিষয়ে সতর্ক রাখতে হবে।

আরও পড়ুনবিসিএস থেকে গণিত বাদ দেওয়ার সর্বনাশা চিন্তা কেন০৪ মার্চ ২০২৫

সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বর্তমানে ১০০ নম্বর নির্ধারিত। অথচ সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে আরও তিনটি বিষয়, যথা সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান ও ভূগোল যুক্ত করে মোট ১০০ নম্বরের বিজ্ঞান অংশ কমিশন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। সমানুপাতিক হিসাব করলে সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির (ভৌতবিজ্ঞান) জন্য কেবল ২৫ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মোট নম্বরের ৪.১৭ শতাংশ। এটি বিজ্ঞান বিভাগকে অবহেলার মাধ্যমে বৈষম্যকরণের নতুন মাত্রা বলে প্রতীয়মান হয়। শুধু তা-ই নয়, ব্যবসায় শিক্ষাকে একেবারে বাদ দিয়ে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুকূলে বিষয় নির্বাচন করে তাঁদের অগ্রাধিকার বেশি দেওয়া হয়েছে, যা বিসিএসের মতো পরীক্ষার ক্ষেত্রে কখনো কাম্য নয়।

বিসিএস থেকে গণিত বাদ দেওয়ার মূল কারণ পরীক্ষার্থীদের গণিতভীতি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে গণিতের শিক্ষক নয়, এমন শিক্ষক দিয়ে গণিত পড়ানো হচ্ছে। এখানে গণিত শিক্ষক বলতে যাদের গণিতের ওপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কমপক্ষে স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে তাঁদের বোঝানো হয়েছে। তাই ছাত্রছাত্রীরা গণিত পড়ছে কিন্তু শিখতে পাড়ছে না।

গণিতভীতির কারণে আজ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবাই গণিত থেকে দূরে সরার চেষ্টা করছেন বা গণিতকে বাদ দিয়ে পথচলার নীতি অনুসরণ করছেন। এর জ্বলন্ত উদাহরণ বিসিএস থেকে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়টিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কর্তৃক বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা। এ ধরনের গণিতভীতির জন্য গণিত শিক্ষকেরা দায়ী নন এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করে আনন্দের সঙ্গে গণিতচর্চা ও শিক্ষা উপহার দেওয়ার সক্ষমতা একমাত্র গণিতবিদেরাই রাখেন বলে আমার বিশ্বাস।

বিজ্ঞানের প্রার্থীদের তুলনায় অন্য প্রার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার মেধাতালিকায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই আমার প্রস্তাব হলো গণিত বাদ না দিয়ে বরং প্রত্যেক শাখার প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্ব বিসিএস ক্যাডারে বজায় রাখতে হলে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা শাখা হতে আবেদন করা প্রার্থীদের মধ্য থেকে আনুপাতিক হারে মেধাক্রম তৈরি করা যেতে পারে।

মাথাব্যথা হলে মাথা না কেটেই উপশমের ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান সরকার সংস্কারে বিশ্বাসী ও বৈষম্য বিরোধী। বিসিএসের মতো পরীক্ষায় সিলেবাসের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য রাখা উচিত নয়। মানবিক বিভাগের প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়া কোনো জনগোষ্ঠী নয় যে বিসিএস ক্যাডারে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য গণিত বাদ দেওয়ার কৌশল নিতে হবে। গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়টি বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হতে বাদ না দিয়ে বহাল রাখাই বেশি যুক্তিসংগত।

ড. মাহতাব উ. আহাম্মদ অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব স এস র স ল ব স ব স এস থ ক স প র শ কর দ র গণ ত পর ক ষ র ব স এস প র জন য ব যবস ব ষয়ট করছ ন ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ