জমি নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন হলেও নিয়োগ হয়নি বিচারক। ফলে এসব ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে লাখ লাখ মামলা। দীর্ঘদিন ধরে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারাধীন প্রায় চার লাখ মামলার বাদী-বিবাদী মিলিয়ে কয়েক লাখ মানুষ হয়রানির মধ্যে আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৫৪ জেলায় ভূমি জরিপ (ল্যান্ড সার্ভে) আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। ফলে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষরা আপিলের সুযোগ পাচ্ছেন। আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দেড় বছর পরও বিচারক নিয়োগ হয়নি। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে ৫৪ জেলায় গঠন করা হয় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল সংখ্যা বাড়লেও মামলাজট নিরসন হয়নি। কারণ, ৫৪ ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মধ্যে বিচারক নিয়োগ করা
হয়েছে মাত্র ১৩টিতে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারক নিয়োগ না হওয়ায় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা জমেছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৭০টি। আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা আছে ৮ হাজার ৫১২টি।
ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক হবেন জেলা জজরা। এ ছাড়া প্রয়োজনে সিনিয়র সহকারী জজ বা সহকারী জজদের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিচারক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার। এসব বিধান যুক্ত করে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনটি সর্বশেষ ২০২৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে।
২০০৪ সালে আইনটি একবার সংশোধন হলেও তখন ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। এতে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পর আপিলপ্রত্যাশীরা দিনের পর দিন দুর্ভোগ পোহাতে থাকেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্ট ৯০ দিনের মধ্যে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
বিচারকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আটকা
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচারকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আইন থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৫৪টি ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনালে ৫৪ জন জজসহ সহায়ক কর্মচারীর পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাত্র ২৬ জন জেলা জজসহ সহায়ক কর্মচারীর পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অনুমোদন করে। এখন সেই প্রস্তাব আটকে আছে অর্থ বিভাগে। একইভাবে ১৩টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে যুগ্ম জেলা জজসহ সহায়ক কর্মচারী নিয়োগের অনুমোদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিলেও অর্থ বিভাগ দেয়নি। অর্থ বিভাগের সাড়া মিললে প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত
সচিব কমিটির অনুমোদন লাগবে। পরে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পাওয়া গেলে পদ সৃষ্টির প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর পর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব পদে বিচারক নিয়োগ হবে। ফলে সব কাজ শেষ করে চূড়ান্ত নিয়োগ পেতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার সমকালকে বলেন, এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না, ফাইল দেখে বলতে হবে। প্রতিদিন অনেক চিঠি আসে, সব বিষয় মনেও রাখা যায় না।
বিচারাধীন প্রায় দেড় লাখ মামলা
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৬৪ জেলায় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৬ হাজার ২০৮টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৪৪ হাজার ১৬৬টি। অন্য আদালতে বদলি হয়েছে ৮০ হাজার ৫৭২টি। ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৭০টি বা ৭৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ১ লাখ ৪০ হাজার ১৭১টি মামলা।
সবচেয়ে বেশি মামলা আটকে আছে কিশোরগঞ্জে। সেখানে ৪৪ হাজার ১২২ মামলার মধ্যে ৩৪ হাজার ৭০৫টি নিষ্পত্তি হয়নি। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এসব মামলা। ৬ হাজার ৮৩০টি মামলা বদলি করা হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৮৭টি। চট্টগ্রামে দায়ের করা হয় ৫৬ হাজার ৫৮০টি মামলা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৭৭৫টি। বদলি হয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮টি। বিচারাধীন ২৬ হাজার ১৪৭টি। ময়মনসিংহে বিচারাধীন ২২ হাজার ১৬৩টি মামলা। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ১৭ হাজার ১০০টি।
১০টির বেশি জেলার জিপিরা (গভর্নমেন্ট প্লিডার) বলেন, জেলা পর্যায়ে আদালতের সংখ্যা কম থাকায় বিচারপ্রার্থীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রতি জেলায় আদালত ও বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঝালকাঠির মসিউর রহমান খান বলেন, ২০২২ সালে নলছিটির চড়ানতলি মৌজার একটি জমির মামলা করা হয়। তিন বছর পার হলেও এখনও শুনানিই শুরু হয়নি।
বিচারকের পদ সৃষ্টির কাজ দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের সমকালকে বলেন, নিয়মের অতিরিক্ত কিছু হলে সেটা গোপনীয়, এই মুহূর্তে বলা যাবে না। আমরাও চাই এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, জমির মামলা নিয়ে মানুষ মহাজটে পড়েছে। এগুলো নিষ্পত্তির জন্য প্রতি জেলায় একাধিক আদালত করতে হবে। পদ সৃষ্টি করে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পদ সৃষ্টিতে বেশি সময় লাগলে মামলার জট আরও বাড়বে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত বিচারক নিয়োগ করতে হবে।
জানা যায়, আইন তৈরির ৭৩ বছর পর ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে আগে হাইকোর্টে রিট করেছিল মানুষ। এখন হাইকোর্টের রিট মামলা নিজ নিজ জেলায় আপিল ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হচ্ছে। বিচারক নিয়োগ না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ও জটিলতা বাড়ছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।