জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) সাম্প্রতিক এক জরিপে দুটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। প্রথমত, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বা ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা। তবে এসব ঝুঁকি সত্ত্বেও সস্তা শ্রম ও বাজারসুবিধার কথা বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহ দেখিয়েছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী।
গত বছরের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা ১৭৫টি জাপানি কোম্পানি তাদের মতামত দিয়েছে। জরিপে দেখা যায়, ২০২৪ সালে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে এবং মুনাফারও উন্নতি হয়েছে। তবে স্থানীয় চাহিদা কমে যাওয়ায় চীন ও থাইল্যান্ডের মতো কিছু দেশে তাদের মুনাফা কমেছে। একই সঙ্গে চীনা ও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর কারণে তারা তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মোট ১৩ হাজার ৭২৭টি জাপানি কোম্পানি জরিপে অংশ নেয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এ অঞ্চলে ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোন দেশ তাদের কাছে প্রথম পছন্দের। জবাবে ভারতকে সবচেয়ে এগিয়ে রেখেছে জাপানিরা। প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি ভারতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী। এ তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও লাওস।
জাপানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে যে পাঁচটি বড় সুবিধা থাকার কথা বলেছেন, তার মধ্যে আছে সস্তা শ্রম, বাজার সম্ভাবনা, শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তি, ভাষাগত সুবিধা, করছাড় ও প্রণোদনাসুবিধা এবং বিশেষায়িত জনশক্তি। এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং বাংলাদেশ এই সুবিধা নিতে পারে অনায়াসে।
কিন্তু জরিপে ৯৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে ব্যবসার পরিবেশের জন্য ঝুঁকি মনে করেছে, সেটা সমাধান করা সহজ নয়। আর কেবল প্রশাসনিকভাবে এটা করাও যাবে না। এ জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যদি কোনো ব্যবসায়ী এখানে বিনিয়োগ করতে এসে প্রায়ই অবরোধ, যানজট ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েন, তাঁরা আসবেন না। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা এত দিন থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই অস্থিতিশীল পরিবেশ রয়েই গেছে, মাত্রা কিছু কমলেও। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই জাপানি বিনিয়োগকারীদের এমন মন্তব্য এসেছে। গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় থেকে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রয়েছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতিরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিছু পরিবর্তন আবার বাংলাদেশে জাপানের স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
জাপানি ব্যবসায়ীরা ব্যবসার বাধা হিসেবে যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, তার সমাধান করা কঠিন নয়। আবার এর সব কটির সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতাও নেই। বিদ্যুতের ঘাটতি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ সমস্যার সমাধানে অর্থের প্রয়োজন স্বীকার করি। কিন্তু অস্পষ্ট ব্যবস্থাপনার নীতি স্পষ্ট করা কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন নেই। এখানে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। বহু বছর ধরে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ওয়ান–স্টপ সার্ভিসের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু বাস্তবে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
রাজনৈতিক সরকার ব্যবসায়ীদের সামনে প্রতিশ্রুতির মুলা ঝুলিয়ে বছরের পর বছর পার করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে আশা করি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
টিনএজ সিনড্রোম: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক নীরব সংকট
এক সময় ছিল, যখন সন্তানের আবেগ, দুষ্টুমি বা হঠাৎ রাগ দেখে বাবা-মা মুচকি হেসে বলতেন—“বয়স হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু আজ, সেই দুষ্টুমি পরিণত হয়েছে এমন আচরণে, যা অনেক সময় বাবা-মা পর্যন্ত চেনেন না। সন্তান চোখে চোখ রাখে না, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, কথা বললে রাগে ফেটে পড়ে। এই চিত্র এখন বিশ্বব্যাপী। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আমরা এক ‘Adolescent Syndrome’ বা ‘Teenage Behavioral Crisis’-এর মুখোমুখি, যা বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
আচরণগত বিপর্যয়ের পেছনে বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ সিনড্রোমের প্রধান কারণ তিনটি:
হরমোনের দোলাচল: ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের ওঠানামা টিনএজারদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হরমোনাল পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, যা আচরণে অতিরিক্ত আবেগ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণ বিকাশ: ১৩-১৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কের যুক্তিবোধ ও নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অংশ (prefrontal cortex) এখনও গঠনের পর্যায়ে থাকে। ফলে তারা আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়, ঝুঁকি নেয়, এবং কখন কী বলতে হবে—তা বোঝে না।
প্রযুক্তির নীরব আগ্রাসন: TikTok, Instagram, Snapchat—এসব প্ল্যাটফর্মে মেয়েরা দিনে গড়ে ৬–৮ ঘণ্টা সময় কাটায়। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়া সৌন্দর্য ধারণা, জনপ্রিয়তার চাপ, ফিল্টার সংস্কৃতি তাদের আত্মপরিচয়কে বিকৃত করে তুলছে।
কেন বেশি দেখা যায় মেয়েদের মধ্যে?
Emotional Sensitivity: মেয়েরা আত্মপরিচয় ও আত্মমূল্যায়নে বেশি স্পর্শকাতর।
Beauty Pressure: সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের শরীর, ত্বক, স্টাইল—সবকিছু নিয়েই এক অনিয়ন্ত্রিত চাপ কাজ করে।
Hormonal Impact: মাসিক চক্র ও হরমোন ওঠানামা তাদের মুড, আবেগ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বাবা-মা কি আগের তুলনায় বেশি সমস্যায়?
হ্যাঁ, এবং এর পেছনে রয়েছে পরিবারে সংলাপের ঘাটতি। অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের আধিপত্য। পিতামাতার নিজের মানসিক চাপ। বিকৃত প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা। আজ অনেক অভিভাবক জানেন না—কীভাবে সন্তানের কাছে পৌঁছাতে হয়। তারা নিজেরাই কর্মব্যস্ত, ক্লান্ত, মানসিকভাবে নিঃশেষ।
বিশ্বের অবস্থা কী বলছে?
জাপানে টিনএজ আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সুইডেনে, গত ১০ বছরে কিশোরীদের বিষণ্ণতা বেড়েছে ৪৭%। যুক্তরাষ্ট্রে, CDC বলছে—“Teenage girls are experiencing record levels of sadness, violence, and suicidal thoughts.” বাংলাদেশে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্ণতা বেড়েছে প্রায় ৫০% (মনোরোগ ইনস্টিটিউট, ২০২৩)।
তাহলে বাবা-মা কী করবেন?
শুনুন, শাসন নয় – সন্তানকে সময় দিন, তার কথার পেছনে আবেগ বুঝুন।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ করুন – নিজেরাও মডেল হোন প্রযুক্তি ব্যবহারে।
কাউন্সেলিংয়ে ভীতি নয় – প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিন।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যও রক্ষা করুন – সন্তানকে বোঝাতে গেলে নিজের ভেতরে শান্তি থাকা জরুরি।
একটি প্রজন্ম যেন না হারিয়ে যায়। এই সংকট নিছক পারিবারিক নয়—এটি এক সামাজিক দায়। টিনএজারদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা বোঝা না গেলে, আমরা এক ‘চুপ করে থাকা বিষণ্ণ প্রজন্ম’ হারিয়ে ফেলব। সন্তান যখন বিদ্রোহ করে, সে আসলে জানিয়ে দেয়— ‘আমি ভালোবাসা চাই, বোঝার মানুষ চাই।’ আমাদের দায়িত্ব তাদের ভাষা বুঝে নেওয়া।
তারা//