সেহরির সময় মুসলিমদের জাগিয়ে তোলেন অমুসলিম যাদব
Published: 23rd, March 2025 GMT
ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাস। গোটা মাস জুড়েই সুবহে সাদিকের আগে সেহরি এবং সূর্যাস্তের পর ইফতার করে থাকেন মুসলিমরা। আর গ্রামের মুসলমানরা সেহরির জন্য যাতে সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই স্থানীয় এক হিন্দু পরিবারের।
গোটা গ্রামের হিন্দুরা যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকে, তখন ওই রমজান মাসে ঘুমকে বিলাসিতা হিসাবেই মনে করে উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার ছোট গ্রাম ‘কৌরিয়া’র হিন্দু ধর্মাবলম্বী গুলাব যাদবের পরিবার।
৪৫ বছর বয়সী গুলাব যাদব এবং তার ১২ বছর বয়সী ছেলে অভিষেক। রমজান মাসে ঘুম পরিত্যাগ করে
প্রতিদিন রাত ১টায় হাতে টর্চ এবং লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাবা ও ছেলে। পায়ে হেঁটে গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতেই প্রতিটি মুসলিম বাড়িতে থামেন এবং হাঁক দেন। ওই পরিবারগুলো সেহরির জন্য জেগে আছে এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই বাপ-বেটা পরের দরজায় গিয়ে হাঁক দেয়।
আর এভাবেই গত ৫০ বছর ধরে এই গুরু দায়িত্ব পালন করে আসছে যাদবের পরিবার। ১৯৭৫ সালে গুলাবের বাবা চিরকিত যাদবের শুরু করা একটি ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন পরবর্তী প্রজন্ম।
অতীতে রমজানের সময় বেশিরভাগ মসজিদে লাউডস্পিকার ব্যবহার করে রোজাদারদের জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়ে আসছিল, কিন্তু শব্দদূষণ নিয়ে শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশের ফলে ধর্মীয় স্থানগুলোতে শব্দদূষণের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
সেক্ষেত্রে, যাদবের এই নিবেদিত প্রচেষ্টা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিজের শৈশবের কথা স্মরণ করে গুলাব যাদব বলেন, ছোটবেলায় তিনি কখনই পুরোপুরি বুঝতে পারেননি কেন তার বাবা রাতে বাইরে যেতেন, সেহরির জন্য লোকদের জাগিয়ে তুলতেন। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে এই ঐতিহ্যের পিছনের গভীর অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন গুলাব। তিনি বলেন, “এখন আমি এটা করে অনেক শান্তি পাই।”
পেশায় একজন দিনমজুর গুলাব যাদব বছরের বেশিরভাগ সময় দিল্লিতে কাজ করে কাটান। কিন্তু রমজান এলে তিনি তার পরিবারের পাঁচ দশকের পুরোনো রীতিনীতি বজায় রাখার জন্য তার গ্রামে ফিরে আসেন। এমনকি গুলাবের বাবা যেমন তার জন্য করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই তিনিও তার সন্তান অভিষেকের মধ্যেও সেই দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে চলেছেন। প্রতি রাতে, তিনি অভিষেককে সাথে নিয়ে বের হন এবং তাকে মুসলিমদের পরিবারের পবিত্র বিভিন্ন রীতিনীতির ঐতিহ্যের গুরুত্ব শেখান। গুলাবের অভিমত, “বাবার পর আমি যেমন এই দায়িত্বটা পালন করে আসছি, তেমনি আমি চাই আমার পরে আমার ছেলেও এই কাজটি চালিয়ে যাক।”
গুলাব যাদব জানান, “বাবা মারা যাওয়ার পর, আমার বড় ভাই কয়েক বছরের জন্য এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর থেকে আমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে চলেছি এবং প্রতি রমজান মাসে আমি এই কাজটি করার জন্যই গ্রামে ফিরে আসব।”
স্বাভাবিকভাবেই একদিকে গুলাব যাদবের এই কর্মকাণ্ড বা প্রচেষ্টা যেমন গ্রামের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে তেমনি তার মুসলিম প্রতিবেশীরাও তাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে দেখে আসছে। যাদবের প্রতিবেশী শফিক জানান, “সেহরির জন্য মানুষকে জাগিয়ে তোলা একটি মহৎ কাজ। গুলাব ভাই নিশ্চিত করেন যে সেহরিতে অংশ নিতে কেউ যেন বাদ না পড়েন। গোটা গ্রামে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরে দেখার পর ফের আরেক রাউন্ড ঘুরে দেখে নিশ্চিত করেন যে তারা সবাই সেহরি খেয়েছে কিনা। এর চেয়ে পবিত্র আর কী হতে পারে?”
যাদবের কাজকে প্রশংসা করে শফিকের প্রশ্ন, যখন গীতা এবং কোরআন- উভয়ই প্রেমের বার্তা দেয়, তখন হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে কেন বিভেদ থাকবে? তার অভিমত, যেহেতু রমজান ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ, তাই পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখতে সাহায্য করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গুলাব যাদব।
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর রমজ ন ম স র পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।
আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’
এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।